ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘দেশভাগই পরবর্তী কালের যাবতীয় সন্ত্রাস ঘটিয়েছে’

অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ১৩:১১, ১৬ নভেম্বর ২০২১
‘দেশভাগই পরবর্তী কালের যাবতীয় সন্ত্রাস ঘটিয়েছে’

বাংলাসাহিত্যে হাসান আজিজুল হক বিশিষ্ট নাম। গল্প, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার ও উপন্যাসে ব্রাত্যজন, প্রান্তিকজনের জীবন, কৃষ্টি ও সংগ্রাম তুলে এনেছেন বলিষ্ঠভাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও দেশভাগ তার সাহিত্যের অন্যতম বিষয়বস্তু। গল্পের নিজস্ব ভাষা, উপস্থাপন ভঙ্গি, জীবন দেখা ও দেখানোর জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ছোটগল্পই তার কাজের প্রধান অঞ্চল। এ জন্য কখনো কখনো তাকে ‘ছোটগল্পের রাজপুত্তুর’ বলা হয়। অনেক পরে হলেও দীর্ঘদিনের ছোটগল্পের চরাচর তিনি মিশিয়েছেন পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের বিশাল প্রান্তরে। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে তিনি ঔপন্যাসিকের শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন দর্শন বিভাগে। তার সাহিত্যে দর্শনের উন্মিলন দেখা যায়। আজ এই জীবনঘনিষ্ঠ কথাসাহিত্যিকের জন্মদিন। টেলিফোনে তার এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ গল্পকার অলাত এহসান

অলাত এহসান : স্যার, আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক-মুক্তিযুদ্ধের যে সাহিত্য, তা আসলে কতটা হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন? আপনার সর্বশেষ উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ মুক্তিযুদ্ধের না হলেও, একটা রেশ পাওয়া যাবে। সম্প্রতি আলী আহমদ এটি অনুবাদ করেছেন।

হাসান আজিজুল হক : অনুবাদটা কি তুমি পড়েছো?

অলাত এহসান : না। বইটা মাত্রই অনুবাদ হয়ে ফ্রাঙ্কফুট বই মেলায় গেল। মনে হয়, আপনার এই বই এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যারের গল্প-উপন্যাস অনুবাদ হয়ে অনেক আগেই বিশ্ব পাঠকের কাছে পৌঁছানো দরকার ছিল।

হাসান আজিজুল হক : আসলে ভালো অনুবাদ তো হয় না। আবার আদৌও অনুবাদ হয় না। এতো দিন পরে ‘ফায়ারবার্ড’ হলো। অনুবাদের কোয়ালিটি কেমন হয়েছে আমি তো কমপিটেড নই সেটা জাজ করার। তাই সেটা বলতে পারবো না। আর দিল্লি থেকে অনুবাদ হয়েছে ‘টুয়েলভ শর্ট স্টোরিস অব হাসান আজিজুল হক’। আসলে এ নিয়ে আমি আর কি বলতে পারি।

অলাত এহসান : না, তা নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আসলে কতটা সাহিত্য হয়েছে কিংবা যতটা হওয়ার দরকার ছিল ততটা হয়েছে কিনা?

হাসান আজিজুল হক : মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে সেই অর্থে তেমন কিছু হয়নি। আসলে সাহিত্যকর্ম যেটা- সেটা হয়নি। যেমন মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে লেখা হলেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের গল্প নয়।

অলাত এহসান : তার মূল উপজীব্য দেশভাগের পরের সময়টা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ও স্বপ্ন ভঙ্গের সময়।

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, স্বপ্ন ভঙ্গের সময়টা বা যাই হোক গ্রাম সমাজ নিয়ে লেখা আর কি, সেখানে ঠিক এ নয়। তার আগে যেটা ‘চিলেকোঠার সেপাই’।

অলাত এহসান : উনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থান নিয়ে।

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, তাতে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপার নেই। তবে কয়েকটা মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের পরের গল্প ইলিয়াসের উল্লেখযোগ্য আছে। যেমন ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘রেইনকোর্ট’ এমন কয়েকটা গল্প সে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখেছে; কয়েকটাই গল্প। আর আমার একটা বই-ই আছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পের নাম ‘নামহীন গোত্রহীন’। তারপর লিখেছি ‘বিধবাদের কথা’, কেউ তেমন পড়ে নাই। কেন পড়ে নাই তা জানি না। সেখানে দুই বিধবার কথা আছে, একদম মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা গল্পটা। তবে লোকের নজর এড়িয়েছে, কী জানি বলতে পারবো না কারা পাঠক, কী সমাচার।

আর মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমাদের মুটোমুটিভাবে প্রধান লেখক, গদ্য লেখক যারা আছে; সৈয়দ শামসুল হক, কবি। তবে সৈয়দ হক অনেক আগে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখেছিলেন ‘নিষিদ্ধ লোবান’, এ রকম দু-একখানা বই। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তো তার হয়নি। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডে। তার লেখাতেও মুক্তিযুদ্ধ সেভাবে আসেনি। ইলিয়াসের কথা তো বললামই, মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ গল্পেই বেশি আছে, উপন্যাসে নাই। হ্যাঁ, শওকত ওসমানের দু-একটি গল্প আছে মুক্তিযুদ্ধের ওপরে, উপন্যাস আছে ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’; সেও উল্লেখযোগ্য  কিছু বলে আমার মনে হয় না।

অলাত এহসান : এটা তো তার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লেখা। এ ছাড়া তাঁর ‘দুই সৈনিক’, ‘নেকড়ের অরণ্য’ ও ‘জলাংগী’ উপন্যাস আছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। তাছাড়া আনোয়ার পাশার উপন্যাস। সেটাই তো মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস?

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, আনোয়ার পাশার উপন্যাস তো মুক্তিযুদ্ধের মুখে। ওকে তো মেরেই ফেললো- তাই না! ওকে তো বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে হত্যা করেনি, বোধ হয় আগেই মেরেছে।

অলাত এহসান : না, ডিসেম্বরেই তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তবে উপন্যাসটা যুদ্ধের প্রথম দিকের লেখা।

হাসান আজিজুল হক : ওটা তো কিছু অসাধারণ উপন্যাস নয়, আর ও তো কেবল দেখলো। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ ওগুলো স্কেচের মতো আর কি, ভালো ভালো স্কেচ হয়তো-বা। আর বড় বড় উপন্যাসে যেগুলো হয়েছে যুদ্ধ নিয়ে, ওটাকে তো তা বল যায় না।

অলাত এহসান: সেলিনা হোসেনের কয়েকটি উপন্যাস আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু সেই অর্থে সাহিত্যে কি মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি-অর্থনীতি এসেছে?

হাসান আজিজুল হক : না। সেভাবে আসে নাই কারণ ব্যাপক অভিজ্ঞতা থাকা লোক খুব কম। যারা পুরো অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল তাদের মধ্যে ঔপন্যাসিক তেমন একটা ছিল না। আনিসুজ্জামান সাহেব, মুটোমুটি, বেশ ভালভাবেই যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি তো আর কথাসাহিত্যের লোক নন। তারপরে আর কার কথা বলবো...। শওকত আলীও তাই, দু-একটা গল্প মুক্তিযুদ্ধের ওপরে আছে আরকি। তারপরে তারপরে তারপরে... ‘আমার যত গ্লানি’ রশিদ করিমের উপন্যাস, সেটা তো মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তীকালের একটা...।

অলাত এহসান: মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

হাসান আজিজুল হক : ‘জীবন আমার বোন’কে কোনো ক্রমেই মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলা চলে না, এটা যে যা-ই বলুক। এগুলো সবই প্রকারন্তরে লেখা আর কি। সরাসরি যেমন এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস আছে। ‘অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘থ্রি কমরেডস’ বলে যে বইটা আছে, সেটাও তো একটা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালের আর কি। বিদেশে খুব আছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র লেখা বিখ্যাত বই ‘আ ফেয়ারঅয়েল টু আর্মস’, তারপর স্প্যানিস সিভিল ওয়্যারের ওপর লেখা ‘ফর হুম দ্যা বেল টোলস’ তাই না? উনি তো লিখেছেন যুদ্ধের ওপরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপরে তার লেখা বোধ হয় নাই। না নাই,  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর লেখা দেখি না, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওপর লেখা দেখি।

অলাত এহসান : যুদ্ধ নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে এই নামগুলো এসেই যায়। তবে সবচেয়ে যেটা আসে তা হলো, লিও তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসটির কথা। ওটাও যুদ্ধ নিয়ে। আমাদেরটা আরো নিবিড়, মুক্তিযুদ্ধ। তারপরও আমাদের দেশে তেমন এপিকধর্মী লেখা নেই কিন্তু।

হাসান আজিজুল হক : না না না, আমি তো উল্লেখই করলাম না তলস্তয়কে। কারণ ওটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে একটা, ওর নাম উচ্চরণ করাটাও তো স্পর্ধার বিষয়। দস্তয়েভস্কি তো তার আগেকার লেখক। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ যুদ্ধ হয়ে যাওয়ার অনেক দিন পরে লেখা। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিচ’ এর যুদ্ধটা বোধ হয় ১৮১২-তে, নেপোলিয়ান আক্রমণ করেছিলেন রাশিয়ায়, বছর তিনেক পরেই যুদ্ধ শেষ, ভার্সাই চুক্তি হয়ে গেল। আর ১৮২৮-এ তলস্তয়ের জন্ম, আর ৩৫ বছর বয়সে তিনি উপন্যাসটা লিখেছিলেন। তারপরও অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন।

অলাত এহ্সান : তাহলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ ধরণের একটা এপিক লেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষার আছে কী?

হাসান আজিজুল হক : এমন হতে পারে যে, শুধু বিস্মরণেই শেষ হবে। মাঝে মাঝে আমার সেইটাই মনে হয়- বিস্মরণেই শেষ। অপেক্ষা করে লাভ হবে কি না জানি না। আমি তার কোনো লক্ষণ দেখছি না। মুক্তিযুদ্ধোত্তর যে বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছি তাতে তো মনে হচ্ছে যে, মুক্তিযুদ্ধ বৃথা করা হয়েছিল- অন্ধকার তো সব। এখন এসব নিয়ে লিখতে কেউ আগ্রহী নয়, আমি দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কারো আগ্রহই নেই। ওই যে মুখের একটা চলতি স্লোগান হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। হোয়াট ইজ দিস ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’? কাউকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? কী চেতনা সঞ্চয় করেছে। তো সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রটা কী হওয়া উচিত, এই রাষ্ট্রে কি সেটা হয়েছে? আমাকে জিজ্ঞেস করলে তো আমি স্ট্রেইট বলে দেব।

অলাত এহসান : এ জন্য শেষ পর্যন্ত আপনাকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, আমি বলি। আমি তো তেমন লোক দেখছি না যে, মুক্তিযুদ্ধের ওপর তথ্যধর্মী বিশাল কিছু লিখলো। আর আমার গুণাগুণতি আয়ুর মধ্যে এ রকমভাবে যদি মস্তিষ্ক-স্মৃতি এবং কলম এখনো পর্যন্ত ধরতে পারছি, ব্যবহার করতে পারছি তাতে করে আমি একটি আশা পোষণ করি বটে যে, একটা বড় উপন্যাস লিখবো; তাতে মুক্তিযুদ্ধও থাকবে। জানি না সেটা কি হবে, বরং বলা মুশকিল।

অলাত এহসান : মামুন হুসাইন আর শাহাদুজ্জামানকে অনেক সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়...।

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ। কিন্তু তারা লিখছে কই? মামুন হুসাইন তো তেমন কিছু মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত লিখেন নাই। ব্যাপারটা হচ্ছে মামুন খুব ট্রিপিক্যাল লেখক তো, যেমন কমলকুমার মজুমদার- ট্রিপিক্যাল লেখক। ওরা পাঠক প্রিয় তো হয় না, ব্যাপাকভাবে পঠিতও হয় না। আর এক ধরনের অসাধারণ স্বচ্ছতা না থাকলে এই ধরনের বড় উপন্যাস লেখা চলে না আর কি, তাই না? অসাধারণ এক স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সেখানে শাহাদুজ্জামানও অনেক কারিগরি করে; আর মামুন হুসাইন অনেকটাই ভাষা নিয়ে, ভাবনা নিয়ে, তারপর গল্পের কাঠামো নিয়ে, কাঠামোহীনতা নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে। কাজেই আমি নট শিওর- মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলতে যে ধরনের বিশাল উপন্যাসের কথা ভাবছি সে রকম উপন্যাস লিখিত হবে কি না আমার সংশয় আছে।

অলাত এহসান : গল্প-উপন্যাস ছাড়াও কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ-গবেষণা এই বিষয়গুলো আছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধ কতটা এসেছে এবং কতটা আসতে পারতো তা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? এখন তো আবার মুক্তিযুদ্ধের দলীয়করণের একটা ব্যাপার আছে। আবার এই দলীয়করণের ভেতর দিয়ে প্রজেক্ট রাইটিং আছে, তাই না?

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধকে আমরা পরবর্তীকালে মনে-প্রাণে গ্রহণ কি করেছি? কী কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? বাঙালি সত্তা। বাঙালিদের একটা আলাদা স্টেট হবে- তাই না? তারপর মুসলমান পরিচয় পরবর্তী পরিচয়, সম্প্রদায়ের পরিচয়, সেটা নিয়ে রাষ্ট্রের কিছু করার থাকবে না। রাষ্ট্র হবে বাঙালিদের একটা রাষ্ট্র। পৃথিবীতে একটা গৌরব যে, তার নিজের ভাষাটাই সেই জাতির নাম, তাই না? তো আমাদের সেটা ছিল। এ রকম কিন্তু বোধ আমাদের লেখকদের সঙ্গে কথা বলে, আমাদের ইন্টেলেকচুয়্যালদের সঙ্গে কথা বলে সেই বোধটা পাওয়া যায় না। সবাই একটা ধরতাই বুলি বলে খুব মুক্তিযুদ্ধ চালায়। কিন্তু এই ধরতাই বুলি দিয়ে তো আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লেখা যাবে না। আমার সংশয়টা সেখানেই। দুই পাহাড়ের খাদে পড়ে গেলে যা হয়।

অলাত এহসান : নাটকে কি উল্লেখযোগ্য কাজ আছে কিনা? সেলিম আল দীন স্যারের মতো নাট্যকার ছিলেন। তো, নাটক কি মুক্তিযুদ্ধকে ধরতে পেরেছিল, আপনি কী বলবেন?

হাসান আজিজুল হক : নাটকে আমার মনে হয় না খুব বেশি ধরতে পেরেছিল। নাটক এমন মিশ্র মাধ্যম, এটা মঞ্চস্থ হয়, এটা কেউ পাঠ করে না। নাটকে যেটা মঞ্চস্থ হয় সেটার নাম হচ্ছে স্ক্রিপ্ট, সেটাকে উপন্যাস বা গল্প বলে না। তো নাটকে যেটা এসেছে স্ক্রিপ্ট হিসেবে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’তে কবিতার মতো করে বলা যায়, গাওয়া যায়, মানে গীতিনাট্য। হয়েছিল এক রকম ভালই, কিন্তু জানি না, নাটক বলতে আমি যেটা বুঝি, আমাদের হেনরিক ইবসেন বা এ রকম বড় বড় নাট্যকার যারা আছেন সেরকম নাট্যকার তো আমি...। আর সেলিম আল দীন নানা রকমের এক্সপেরিমেন্ট করেছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ওপর আলাদা ইনফ্যাসিস দিয়ে খুব বেশি কিছু সে করেনি আরকি।

অলাত এহসান : কবিতা দিয়েও কি আমরা মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করতে পেরেছি, আপনার কী মনে হয়?

হাসান আজিজুল হক : কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ? আমাকে চেপে ধরে প্রশ্ন করলে আমি তো বাজে কথা বলতে পারবো না।

অলাত এহসান : না, সেটা নয় নিশ্চয়ই। আসলে আপনি স্যার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই লিখছেন। এখনো লিখছেন। আপনার দেখা সেই পঠন-পাঠনের ভেতর দিয়ে আপনি যা দেখেছেন তা-ই জানতে চাচ্ছি।

হাসান আজিজুল হক : আ... মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা আছে কিন্তু তার সংখ্যা এবং পরিমাণ কম। সংখ্যাও কম, পরিমাণও কম।

অলাত এহসান : আমাদের দেশের সাহিত্যের কিন্তু একটা বিশেষ দিক ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব থেকেই লিখছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে এসেও সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এরপরও কেন আমাদের ভাবতে হচ্ছে কোনো মধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বা এসেছে কিনা? উপন্যাসের জন্য না হয় আমরা আরো কিছু সময় ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-গবেষণায় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে আরো বেশি পেতে পারতাম।

হাসান আজিজুল হক : বটেই তো, কিন্তু সেটা হয় নি। তার দু’টো কারণ হতে পারে-মুক্তিযুদ্ধের ইমপ্যাক্ট। যেমন সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার, ফাস্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার, সিভিল ওয়ার ইন স্পেন, লাতিন আমেরিকায় স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য এক-একটা লড়াই, তারপর বিশাল উপনিবেশকে উৎখাত করে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ এই সব দিকগুলো। এইসব বলে আমাদের লাভ নেই, এই সবের তুলনায় আমরা পরিধীতে খাটো। কাজেই এই পরিধীর মধ্যে জানি না মহাকাব্যিক বিশাল কিছু রচনা হওয়া সম্ভাবনা কতটুকু, সেটা নিয়ে আরো ভাবতে হবে। আর স্বপ্ন দেখেই যে উপন্যাস রচনা করা যাবে, তা না। আবার যতই দূরে চলে যাবে ততই তলস্তয়ের মতো লোক তো আর বেশি পাওয়া যাবে না- ফিকে হয়ে যাবে বলে একটা আশঙ্কা হয়। পরবর্তীকালে হবে কি না জানি না, যাকে বলে যায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবো, এটা হয়ে যেতে পারে আরকি।

অলাত এহসান : এটা কিন্তু স্যার আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যে অবস্থা-বাস্তবতা তৈরি হলো, তাতে করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বেশি কাজ করার উৎসাহটা আমরা হারিয়ে ফেললাম।

হাসান আজিজুল হক : কেন যে হারিয়ে ফেললাম জানি না। তুমি কি আমার ‘বিধবাদের কথা’টা পড়েছো?

অলাত এহ্সান : না। আমি সম্প্রতি পড়ছি আপনার প্রথম উপন্যাস ‘শামুক’।

হাসান আজিজুল হক : ওতো সতেরো বছর বয়সের, ওতো বালকের লেখা! তবে আমি যেটা করি, পার্টিশন নিয়ে আমার খুব বেশি লেখা আছে। ‘আগুনপাখি’ তো পার্টিশনের ওপরই লেখা। দেশভাগের বিরোধীতা আমি বরাবরই করে এসছি, এখনো করি। এবং ওই দেশভাগই পরবর্তী কালের যাবতীয় সন্ত্রাসগুলো ঘটিয়েছে। সব দুর্ঘটনা-অন্যায়ের কারণ হয়েছে। সেই জন্য সবই এমন হালকা হয়েছে এখন। আর এখন রাষ্ট্র এমন হয়ে গেছে যে, একটা শক্ত অবস্থান তো থাকবে, সেই অবস্থানটাও নেই। যেমন বাংলা ভাষা। আচ্ছা, এটা তো বাঙালিদের একমাত্র রাষ্ট্র। সবারই ভাষা বাংলা। কাজেই পাকিস্তান থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা নেওয়ার পরেও বাংলাদেশের প্রায় বিরানব্বই ভাগ কিংবা আরো বেশি, পঁচানব্বই ভাগ মানুষের ভাষাই বাংলা, তাই না। তাহলে বাংলা ভাষায় জোরটা সর্বোচ্চ দেওয়ার কথা, সেটা কিন্তু নাই। আমাদের রাষ্ট্রের মধ্যে নাই, আমাদের বইপত্রের মধ্যে নাই, উচ্চস্তরের সামাজিকতার মধ্যে নাই। কাজে কাজেই আমাদের যেটাকে এলিট কালচার বলে সেটা এখনো ইংরেজিয়ানাতে ভরপুর। আমি কোনো দিন যাই না, তবু আমাকে জোর করে সোনার গাঁ হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল একবার। এই এবারে একটা বক্তৃতা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে এত বিরক্ত বোধ করেছি যে, বেয়ারাগুলোও ইংলিশে কথা বলে আরকি, আর আমি তো জাতচাষা, কাজেই আমি তাদেরকে বলি যে, ‘কান্ট স্পিক ইন বেঙ্গলি ইন ইওর লেঙ্গুয়েজ? ডু ইউ নো দ্যাট? তোমার মায়ের কাছে কি ভাষা শিখেছো?’ তারা বলে, ‘স্যার এখানে বইরের লোক বেশি আসে...।’

বাইরের লোক আসে তো বাংলায় কথা বলো। ফরাসি দেশে গেলে বাইরের লোক বলে ইংরেজি বলবে না, স্প্যানিশ বলবে না, কিচ্ছু বলবে না, ফরাসিতে কথা বলবে। ফ্রাঙ্কফুটে গিয়ে নামলাম ‘আই ইংলিশ জিরো’ বললো একজন জার্মান। আমি যেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আই ডোন্ট স্পিক ইন ইংলিশ’ সে সোজা বলে দিলো। এখন ব্যাপার হচ্ছে যে, আমি ইংরেজি ভাষা শিখেছি। যেহেতু উপনিবেশের সময় আমার জন্ম। কাজেই শিখতে হয়, শিখেছি। লিখতে-টিখতে দিলে পারবো। ইংরেজি মাধ্যমে যেহেতু গোটা পৃথিবীকে পাচ্ছি, কাজেই ইংরেজি না শিখে আমাদের চলছে না। অশিক্ষিত হয়ে থাকতে হচ্ছে। শিক্ষিত হতে গেলে ইংরেজিটা আমাদের পড়তে হচ্ছে। সেই দিক থেকে ইংরেজি আমার অত্যন্ত প্রিয় ভাষা। কিন্তু আমি কৃতদাস হিসেবে তো আর ইংরেজি বলবো না। আমি তো ইংরেজি ভাষার দাসত্ব করবো না। আমি ভুল ইংরেজি লিখলে লিখবো- তাতে কী হবে?

অলাত এহসান : হ্যাঁ, আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ একে বলছেন ভাষায় অংশগ্রহণের অধিকার। যেমন নাইজেরিয়ার লেখক আমোস টুটুওলা লিখেছেন। জেমস জয়েস আঞ্চলিক ইংরেজিই তুলে এনেছেন লেখায়।

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, ভুল ইংরেজি লিখলে লিখবে। আমি বরং সঠিক বাংলা লিখতে পারি কি না, সেটাই ‘মাস্ট বি ইওর টেস্ট’।

অলাত এহ্সান : গত নভেম্বরে ঢাকা লিট ফেস্টে যখন আপনি এলেন, তখন একটা প্রশ্ন আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল যে, বাঙালি যারা ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করছে তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ কতটা কাজ করছে, এ নিয়ে আপনি কি ভাবেন?

হাসান আজিজুল হক : আমার মনে হয় যে, ওখানে কোনো কমিটমেন্ট বা কোনো বাঁধা ধরা বা বাধ্যতা কিছু আছে। এদের মধ্যে ইংরেজিয়ানাই বেশি। দেশ-সমাজ-বাংলাদেশ-বাংলা ভাষা এসব নিয়ে এদের আগ্রহ অনেক কম। আমি এরপর থেকে আর ওই ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছি না।

অলাত এহসান : অনেক লেখককে প্রতিদিন দেখলেও আপনাকে মাত্র একদিন দেখেছি। এটাই কি কারণ?

হানান আজিজুল হক : হ্যাঁ, আমি বলে এসেছি যে, আমি নিজে বাংলায় কথা বলবো, যারা বুঝতে পারে পারবে। না পারলে পাশের একজনকে বলবে যে, ভাই একটু ইংরেজি করে বুঝিয়ে দাও। কিংবা আমাকেও যদি বলে যে, বাংলায় বলে আমি ইংরেজিতে বুঝিয়ে দেব পরে। তো এই সমস্ত কিছু অসত্য আমরা সব সময় করে যাচ্ছি। জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিকারের আত্মসম্মানটুকু হলো না, বাঙালি হিসেবে আত্মসম্মান বোধ জাগলো না।

অলাত এহসান : যারা ইংরেজিতে লিখছে, তারা তো বাঙালি হিসেবেই লিখছে। বিশ্ব বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি প্রতিনিধি হিসেবে তাদেরকেই দেখছে। এভাবে তাদের উপস্থিতি ঘটছে। আবার আমাদের বাংলা সাহিত্যের যথাযথ অনুবাদও হচ্ছে না, তাই না?

হাসান আজিজুল হক : না, তা হচ্ছে না। হওয়া উচিত ছিল। এখন দেখা যাক ওরা যদি কিছু করে-টরে, এরই মধ্যে ওরা করছে-টরছে দু-চারটে, ওইযে ‘বেঙ্গল লাইটস’(ম্যাগাজিন) করার চেষ্টা করছে। ওরা যদি একটা সেন্টার-মেন্টার করে তাহলে হয়তো হবে।

 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়