ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাজনৈতিক শক্তিতে বদরুল ছিল বেপরোয়া

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৪, ৯ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজনৈতিক শক্তিতে বদরুল ছিল বেপরোয়া

আরিফ সাওন ও আহমদ নূর : খাদিজাকে উত্যক্ত করে গণপিটুনির শিকার হয়েছিল বদরুল আলম। এই গণপিটুনিকে সে ছাত্রশিবিরের হামলা বলে প্রচার করেছে, যা পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগে তার উচ্চ পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতা-কর্মীদের সহানুভূতি অর্জনে সহায়ক হয়েছে।

 

একপর্যায়ে বদরুল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গোবিন্দগঞ্জের আয়াজ উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়।

 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম গত ৩ অক্টোবর সিলেটের মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজের পুকুরপাড়ে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক (পাস) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা বেগম নার্গিসকে কুপিয়ে পালানোর সময় আবার গণপিটুনির শিকার হয়। আদালতের আদেশে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

 

খাদিজাকে কোপানোর পর প্রথমে ছাত্রলীগ থেকে দাবি করা হয় সে তাদের নেতা বা কর্মী নয়। পরে অবশ্য তাকে এই সংগঠন থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে আয়াজ উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ে তার খণ্ডকালীন শিক্ষকতার চাকরিও চলে যায়।  

 

বদরুল যে ঘটনা ঘটিয়েছে সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সে মনে করেছে রাজনৈতিক পরিচয়ই তার আসল খুঁটি। যে কারণে সে এতটা সাহস পেয়েছে। এ ছাড়া পরিবার থেকে সঠিক শিক্ষা পেলে এ ধরনের অপরাধ করতে তার বিবেকে বাধা দিত।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, ‘প্রেমের ক্ষেত্রে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ব্যর্থ হয়। তাই বলে সবাই এ ধরনের ঘটনা ঘটায় না। ছাত্রলীগে নেতার পদ থাকায় এই রাজনৈতিক পরিচয়টাকে বদরুল খুঁটির জোর বলে মনে করেছে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তার বেড়ে ওঠাটাও ভালো হয়নি। পরিবারে তার সঠিক পরিচর্যা হয়নি বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

 

অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের সন্তান বদরুল। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সেই কেবল উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পেরেছে। মেধার কারণে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি  বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। এ সময় খাদিজাদের বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকার সুযোগ আসে তার।

 

সে ওই বাড়িতে স্কুল শিক্ষার্থীদের পড়াতে শুরু করে যাদের মধ্যে খাদিজাও ছিল। সেখান থেকেই খাদিজাকে ভালো লাগা এবং প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া। খাদিজা বিষয়টি গ্রহণ না করে পরিবারকে জানিয়ে দিলে তারা বদরুলকে বাদ দিয়ে দেন। তারপরও স্কুলে যাওয়ার পথে খাদিজাকে প্রায়ই বিরক্ত করত সে। যে কারণে ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি এলাকাবাসীর কাছে তাকে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছিল।

 

কিন্তু ১১ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে শিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগের একটি সংঘর্ষের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার ওপর হামলা হয়েছে বলে ক্যাম্পাসে এসে দাবি করে বদরুল। তাকে কাছে টেনে নেন শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের বর্তমান সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ। দুজনের বাড়ি একই জেলায় হওয়ার সুবাদে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও ছিল।

 

সে কারণেই ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিতে তাকে সিনিয়র সহসম্পাদক পদ দেওয়া হয়। এই পদ পাওয়ার পর দাপট বেড়ে যায় বদরুলের। পড়াশোনা শেষ করার আগেই ছাতকের আয়াজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে চাকরিও হয়। এরপর সোমবার ঘটল খাদিজার ওপর হামলার নির্মম ঘটনা।

 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্কার প্রকল্পের মনোবিজ্ঞানী ড. সাবিনা সুলতানা এটাকে একটা নৃশংস ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। মনস্তাত্ত্বিক (সাইকোলজিক্যাল) কোনো সমস্যার কারণে বদরুল এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই সাইকোলজিক্যাল কোনো বিষয় ছিল, যার কারণে ঘটনাটা ঘটেছে। তবে মূলত সমস্যা কী ছিল তা না জেনে বলা মুশকিল।’

  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার কারণ যাই থাকুক, সে হামলা করেছে। আমার মনে হয় না যে, সে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। সে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। এটা ‍সুস্থ মানুষের কাজ না। যাকে ভালোবাসে তার ওপর এইভাবে প্রতিশোধ কেউ নিতে পারে না। আমি মনে করি, এগুলো বিকৃত ও অসুস্থ মস্তিষ্কপ্রসূত।’

 

তিনি বলেন, ‘এক জনকে ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে না। এখানেই শেষ। তাকে অমানবিকভাবে কুপিয়ে জীবন শেষ করে দিতে হবে, এটা কিসের ভালোবাসা? তারা ভালোবাসার সংজ্ঞা জানে না। কাউকে ভালোবাসার আগে তাদের ভালোবাসার সংজ্ঞা জানা দরকার।’

 

বদরুলের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের   মনিরগাতি মনিপুর গ্রামে। তার বাবা সাইদ আহমদ মারা গেছেন। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করতে তিনি একবার সৌদি আরবে কাজে গিয়েছিলেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর মারা যান।

 

মনিরগাতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে বদরুল। এরপর মনিরগাতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। এইচএসসি পাস করে ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ আবদুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ থেকে।

 

বদরুল সম্পর্কে শাবিপ্রবির অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাবেদ আহমদ বলেন, ‘সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন তাকে একটু বোকা স্বভাবের দেখা গেছে। পরে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার পর তার উচ্ছৃঙ্খল জীবন শুরু হয়। এ বছরের মে মাস থেকে সে বেপরোয়া হতে থাকে। বিশেষত সে খুব বদমেজাজের বলে তাকে সবাই ভয় পেত।’

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ‘হামলার ধরন দেখে মনে হয়েছে তার উদ্দেশ্য ছিল টার্গেট কিলিং। আগে নারীদের এসিড সন্ত্রাসের শিকার হতে হতো। কয়েকটি ঘটনা থেকে দেখা যায়, এখন কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে। ধরন চেঞ্জ হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে চাপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে টার্গেট কিলিংয়ের ধরন থেকে বদরুল প্রলুব্ধ হতে পারে।’

 

এখন বদরুলের পাশে কেউ নেই। তার পরিবারও আইনি সহয়তা দেওয়ার জন্য তার পাশে দাঁড়াবে না। দেশের মানুষ তাকে ধিক্কার দিচ্ছে। সবাই তার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছে। অপরদিকে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খাদিজার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আরো ২ থেকে ৩ সপ্তাহ গেলে হয়তো একটা পর্যায়ে আসবে।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ অক্টোবর ২০১৬/আরিফ সাওন/আহমদ নূর/শাহনেওয়াজ/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়