‘মনে রেখো না তারে’
শেখ হারুন অর রশিদ || রাইজিংবিডি.কম
ফাইল ফটো
শেখ হারুন অর রশিদ : বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে প্রেম করা যে কি মধুর তা যে বিয়ে করেনি তাকে কি করে বুঝাবো ? কাতাড়ে ফকিরের বিয়োগব্যাথায় ধুলি বিবি মনের অজান্তে এভাবেই তার যৌবনের স্বামী সুখের কথা বলতে থাকে ৷
যৌবনে কাতাড়ে ফকিরের বুকে মাথা রেখে ধুলি বিবি ঘুমিয়ে পড়তো ৷ চড়ুই, টুনটুনি, বুনো শালিক আর দোয়েলের ডাক শুনলেও তার ঘুম ভাঙতো না ৷ কাতাড়ে ফকির আলতো ভাবে ধুলি বিবির মাথা নাড়িয়ে বলতো- ধুলি, সকাল হয়েছে, এখনই উঠে পড়ো ৷ তখন এপাশ ওপাশ করে ধুলি কাতাড়ে ফকিরকে কাছে টেনে নিতো ও বলতো- এখনও সকাল হয়নি। আরেকটু ঘুমাই ৷ যৌবনের এই ভালোবাসার রাত কখন শেষ হতো ধুলি বিবি বুঝতে পারতো না ৷ এমন সুখের মাঝে তাদের দাম্পত্য জীবন অনেকদিন অতিবাহিত হলো ৷
কিন্ত এত সুখের মাঝেও কেন যেন তাদের বুকটা খালি খালি লাগতো একটা সন্তানের অভাবে ৷ অবশেষে দাম্পত্য জীবনের ৬০ বছর পরে বৈশাখের এক সকালে ধুলি বিবির কোল জুড়ে এলো আহমদ ফকির ৷ আনন্দে আত্মহারা ধুলি বিবি ৷
ছেলেকে কোলে নিয়ে ধুলি বিবি অনুভব করতো স্বর্গীয় সুখ ৷ ধুলি বিবি আর কাতাড়ে ফকিরের সংসার আনন্দে ভরে উঠলো ৷ আস্তে আস্তে আহমদ ফকির যৌবনে পদার্পণ করে ৷ এমনি এক বসন্তে কাতাড়ে ফকিরও বিদায় নেয় ৷
ছেলে আহমেদ ফকিরকে আকড়ে ধরে ধুলি বিবির নতুন পথচলা শুরু হয় ৷ দুরন্ত আহমদ কিছুতেই ঘরে থাকতে চায় না ৷ প্রায়ই রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে কার ধ্যানে মগ্ন থাকে আহমদ ফকির ৷ রাস্তার ওপাশে ছিলো ষোড়শী কন্যা অমেলার বাড়ি ৷ধুলি বিবি ভরদুপুরে রাস্তার পাশে আহমকে দেখে বলে- আহমেদ,
এখানে বসে থাকো কেন? অমেলা তো এই পথে চলাফেরা করে, তুমি কি অমেলাকে ভালোবাসো?
আহমদ কোনো কথা বলেনি ৷ মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে অন্যদিকে চলে যায় ৷
গভীর রাত ৷ আহমদ ফকিরকে কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল ধুলি বিবি ৷হঠাত জেগে উঠে দেখে আহমদ পাশে নাই ৷ অজানা আশঙ্কায় কেপে ওঠে সে ৷ হাতে মোমবাতির মিটিমিটি আলো জ্বালিয়ে ছেলেকে খুজতে বের হয় সে ৷ তার কেন যেন মনে হয় আহমদ সেই কৃষ্ণচূড়া তলায় বসে আছে ৷
সেখানে গিয়ে দেখে আহমদ ফকির হাটুর ভিতর মাথা গুজে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছে ৷ আহমদের গায়ে হাত দিয়ে বলে- বাড়ি চলো, ভোর হতে অনেক বাকি। আহমদ ভয় পেয়ে জেগে উঠে ৷ ধুলি বিবি মনে মনে ভাবে- নিশ্চয়ই আহমদ অমেলার প্রেমে পড়েছে ৷ ধুলি বিবি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আহমদ বলে ওঠে - মা, অমেলার রূপ যেন এই কৃষ্ণচূড়া গাছকেও হার মানায় ৷ মনের অজান্তে কখন যে অমেলাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানি না ৷ অমেলার চোখের চাহনিতে কখন যে হারিয়ে গেছি নিজেই বুঝতে পারিনি ৷
আহমদের এমন কথা শুনে ধুলি বিবি বলে- অমেলাকে তোর ভালোবাসার কথা বলেছিস?
লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আহমেদ বলে- বলিনি মা ৷
নির্বাক চাহনিতে আহমদ বলে- বলে কি আর ভালোবাসা হয় মা? হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে হয়, ভালোবাসাকে বুঝতে হয় ৷ সে কি আমাকে দেখে বোঝে না যে আমি তাকে ভালোবাসি?
সেই কৈশোরে অমেলার জন্য বুচ ফলের মালা নিয়ে অপেক্ষা করতাম ৷ হাসি মুখে মালা নিয়ে সে চলে যেত কিন্তু কিছুই বলতো না ৷ হয়ত আজও সে বুঝলো না ৷
মা, বৃষ্টি হলে সবকিছু ভিজে যায় কিন্ত আমার শূন্য বুক তো ভিজে না ৷ প্রেম যে কি জিনিস তা যে প্রেমে পড়েনি তাকে বুঝানো যায় না ৷
শীতের বিদায় লগ্নে বসন্তের আগমনের সজীবতায় আম্রমুকুলের ঘ্রাণে মধুমাছির গুঞ্জনে কৃষ্ণচূড়ার লাল আবিরে প্রকৃতি যখন মুখরিত ঠিক তখনই আমেলার বিয়ের বাজনা বেজে ওঠে ৷ সেই কৃষ্ণচূড়া তলায় বসে অমেলা আহমদকে বলে - কাল আমার বিয়ে ৷ তুমি আসবে ৷ তোমার বুচ ফলের মালার অপেক্ষায় থাকবো ৷ তোমার মালা ছাড়া আমি শ্বশুর বাড়ি যাবো না।
আহমদের দু চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হয় অঝোর ধারায় ৷ অমেলা অবাক হয়৷ প্রশ্নোত্তরে আহমদ বলে- তুমি চলে যাচ্ছো, তাই এরকম কান্না আমার, আর কিছুই না ৷
অমেলা বলে - হ্যা, শ্বশুরবাড়িই যাবো ৷ তুমি আমার জন্য দোয়া করবে কিন্তু ৷
অমেলা চলে যেতে থাকে ৷ আহমদ ফকিরের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, চোখ হতে থাকে দৃষ্টিহীন ৷
আহমদ ফকির হাটু গেড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে কাদতে থাকে ৷ চিৎকার করতে থাকে- অমেলারই রূপ, অমেলারই রূপ... ৷
ধুলি বিবি অনেক কষ্টে আহমদকে বাড়ি নিয়ে আসে ৷ সেই ঘটনার পর থেকে আহমদ ফকির মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ৷ধুলি বিবি অনেক চেষ্টা করেও আহমেদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন করতে পারিনি ৷সারাদিনই আহমদ ফকির প্রলাপ করতে থাকে- অমেলারই রূপ, অমেলারই রূপ ৷
শেষপর্যন্ত দুশ্চিন্তায় আহমদ ফকিরের মা ধুলি বিবি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে ৷ সাত দিন পর আহমদ ফকিরের মা মারা যায় ৷মারা যাওয়ার আগে সে আহমদ ফকিরকে একটাই কথা বলে যায়- আহমদ, আমি চলে যাচ্ছি ৷ তুমি চিরদিনের জন্যই অমেলাকে ভুলে যাও ৷ মনে রেখো না তারে ৷
লেখক : সিনিয়র অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট খুলনা ৷
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ মে ২০১৪/শামসুল/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন