ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘মানুষ শর্টকাটে খ্যাতি অর্জন করতে চায়’

সমীর চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০২, ২৩ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘মানুষ শর্টকাটে খ্যাতি অর্জন করতে চায়’

কবি জয়দুল হোসেনের (বাঁয়ে) সঙ্গে রাইজিংবিডির ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি সমীর চক্রবর্তী (ছবি : সঞ্চয়)

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় বটবৃক্ষ কবি ও ছড়াকার জয়দুল হোসেন। ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুরের তালুকদার বাড়িতে তার জন্ম। বিংশ শতাব্দির আশির দশকে লেখালেখি শুরু। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই তার অবাধ বিচরণ। তবে কবিতা ও গবেষণাধর্মী কাজে তার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। তার নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গড়ে উঠেছে বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

 

এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১২টি। তার মধ্যে স্বরবৃত্তে স্বরাঘাত (ছড়াকাব্য-১৯৮৮), খান মোহাম্মদ ফারাবী (জীবনীগ্রন্থ-১৯৯৫), ভালোবাসার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ-১৯৯৭), সময় অসময় দুঃসময় (ছড়াকাব্য-২০০২), পূর্ণদৈর্ঘ্য কবিতা (কাব্যগ্রন্থ-২০০৪), বারোমাসি ছন্দছড়া (ছড়াকাব্য-২০০৬), মুক্তিযুদ্ধের স্মারকচিত্র : নির্যাতন ও গণহত্যা (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ-২০০৭), সপ্তডিঙা (প্রবন্ধগ্রন্থ-২০০৮), সমুদ্র তীরে একা (কাব্যগ্রন্থ-২০১১), মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া (মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস-২০১১) ও সাম্যবাদী মন (কাব্যগ্রন্থ-২০১৩) উল্লেখযোগ্য।

 

কবি জয়দুল সম্পাদিত গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকার মধ্যে হরলাল রায় স্মারকগ্রন্থ (১৯৯২), এ কে এম হারুনুর রশীদ স্মারকগ্রন্থ (২০১০), ডা. ফরিদুল হুদা স্মারকগ্রন্থ (২০১১), জন্মশতবর্ষে অদ্বৈত মল্লবর্মণ (২০১৪), তিতাস তুমি কেমন আছো (যৌথ সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থ-১৯৯৯) ত্রিপুরা, ভারত, সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা (অনিয়মিত ত্রৈমাসিক) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। দেশ বিদেশে বহু সম্মাননা ও পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

 

দেশের গুণী এই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি সমীর চক্রবর্তী। রাইজিংবিডি পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

 

সমীর : কেমন চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা?
জয়দুল : অনেকটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় যে জোয়ারটা থাকার কথা, তাতে কোথায় যেনো একটা ভাটা পড়ছে। কারণ হতে পারে, এখানে ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত না। সুযোগও তেমন নেই। তবে সুযোগ না থাকলেও শিল্পসংস্কৃতি যে বিকশিত হবে না, তা নয়। সুযোগ তৈরি করে নিতে হয়। তবে সেই সুযোগ তৈরি করে নেওয়ার মত লোকজনের অভাব রয়েছে এখানে।

 

 

সমীর : সাহিত্য একাডেমি সম্পর্কে কিছু বলুন।
জয়দুল :
১৯৮৩ সাল। তখন আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের ছাত্র। তখন খুরশেদুল ইসলাম, সান্তনু কায়সার, অধ্যাপক হরলাল রায়, ডা. ফরিদুল হুদা এবং অধ্যাপক হারুনুর রশিদরা শিল্প সাহিত্য নিয়ে প্রায়ই আড্ডায় বসতেন। তাদের আড্ডায় উঠে আসে সাহিত্যের সাংগঠনিক চর্চার প্রয়োজনীয়তা। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের উদ্যোগে ওই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে সাহিত্য একাডেমি। আমিসহ কয়েজন জুনিয়রও এ দলে যোগ দেই। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক হরলাল রায়, আমি ছিলাম সম্পাদক।

 

সমীর : সাহিত্য একাডেমি কী কী বিষয় নিয়ে কাজ করে?
জয়দুল : সাহিত্য সংস্কৃতির প্রায় সব শাখাতেই আমরা কাজ করি। বৈশাখী উৎসব, অদৈত উৎসব, নিয়মিত নাট্যচর্চা, আবৃত্তি, গুণীজন সম্মাননা এবং দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্মেলন সাহিত্য একাডেমির নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। তা ছাড়া খান মুহাম্মদ ফারাবী স্মৃতি সম্মেলনের মাধ্যমে তিন বছর ধরে সাহিত্য একাডেমি দেশের খ্যতনামা কবি সাহিত্যিকদের সম্মানা জানাচ্ছেন। এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে কবি সাইয়িদ, কবি আসাদ চৌধুরী এবং শান্তনু কায়সারকে সম্মাননা জানানো হয়েছে।

 

সমীর : আগরতলার সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক কেমন?
জয়দুল : আগরতলার সঙ্গে এ দেশের মানুষের সম্পর্কটা খুব বেশী দিনের নয়। আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরেই এ সম্পর্ক গাঢ় হতে শুরু করে। দেশে একমাত্র আখাউড়া স্থলবন্দর নোম্যান্স ল্যান্ডে দুদেশের মানুষ এক সঙ্গে গণজাগরণের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। বাঙ্গালীদের প্রতি আগরতলা মানুষের একটা উৎসাহ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কলকাতা থেকেও আমাদের নিয়ে অনেকেই আগ্রহ দেখান। এর একটা কারণ হতে পারে কলকাতার মানুষরা শিল্প সংস্কৃতিতে আগরতলার প্রতি তেমন মূল্যায়ন করেন না। ফলে ক্ষোভ থেকেই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আগরতলার শিল্প সংস্কৃতি এগিয়ে যাচ্ছে। কলকাতার লেখকরা এ দেশের লেখকদেরও একটা সময় মূল্যায়ন করত না। তবে এখন তারা মূল্যায়ন করতে বাধ্য। কারণ এ দেশে অনেক শিল্প সংস্কৃতির বোদ্ধা জন্ম গ্রহণ করেছেন। আমাদের আশার কথা হলো আমরা নিজের এবং রাষ্ট্র ভাষায় সংস্কৃতি চর্চা করি। কিন্তু কলকাতার লেখকরা আঞ্চলিক ভাষায় সংস্কৃতি চর্চা করে।

 

সমীর : দুই বাংলার সংস্কৃতি বিকাশে সরকার কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
জয়দুল : লেখকরা উদারবাদ ও আন্তর্জাতিকবাদে বিশ্বাসী। যেহেতু দুই দেশের বাঙ্গালীরা কাছাকাছি অবস্থান করেন সে কারণেই উভয় দেশের কবি সাহিত্যিকদের সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক। আর তাদের মাধ্যমেই দুই দেশের সম্পর্ক ছড়িয়ে গেছে জনগণের মাঝেও। ভিসা প্রক্রিয়া আরো সহজ করার মধ্য দিয়ে সম্পর্কটা আরো গাঢ় করা যাবে।

 

 

সমীর : ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে আপনার স্বপ্নের কথা বলুন।
জয়দুল : কেউ কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী বলে থাকেন। তবে রাজধানী হতে হলে সকল সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সংস্কৃতি চর্চাও হতে হবে। সরকার এবং প্রশাসন এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিল্পকলা এবং শিশু একাডেমি কার্যক্রম জেলা উপজেলা পর্যন্ত বেগবান করতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কাজ বাড়াতে হবে। মাইকেল মধুসুধন দত্তের জন্ম ভূমিতে মাইকেল মেলা, কুষ্টিয়ায় লালন মেলা হয়। সেই হিসেবে আমাদের এখানেও সরকারিভাবে আলাউদ্দিন খা মেলা, অদৈত মেলা হতে পারে।

 

সমীর : সাহিত্য সংস্কৃতির কোন শাখায় আপনি কাজ করতে আগ্রহবোধ করেন?
জয়দুল : যখন যেখানে কাজ করি তাই ভালো লাগে। তবে গবেষণা ও কবিতা নিয়ে কাজ করতে বেশি ভালো লাগে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোক সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটিতে আমি সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছি। আমার মনে হয়েছে এ অঞ্চলের ২০ শতাংশও বইটিতে উঠে আসেনি। ফলে লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে আমার। কারণ এ দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অনেক সমৃদ্ধ।

 

সমীর : সাহিত্য সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এগিয়েছে না পিছিয়েছে?
জয়দুল : পিছিয়েছে বলা যায়। কারণটা চর্চার অভাব। তা ছাড়া এখন মানুষ শর্টকাট পদ্ধতিতে খ্যাতি অর্জন করতে চায়। সে কারণেই এখন আলাউদ্দিন খা, আয়াতআলী খার মত মানুষ সৃষ্টি হয় না।

 

সমীর : এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলুন?
জয়দুল :  মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ অঞ্চল ছিল তীর্থভূমি। তবে শত্রু পক্ষের অবস্থানও এখানে প্রবল ছিল। কারণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বড় অংশ সীমান্ত নিয়ে গঠিত। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জেলার কসবা, আখাউড়া, বিজয়নগর অংশ দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রবেশ করেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গেরিলা অপারেশনে যেতেন।

 

সমীর : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জয়দুল : আপনাকে এবং রাইজিংবিডির সকল পাঠককেও ধন্যবাদ।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ব্রাহ্মণবাড়িয়া/২৩ আগস্ট ২০১৫/সমীর চক্রবর্তী/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়