ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অলৌকিক এক জীবনেই বামন এবং দৈত্য

নিয়ন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১০, ১০ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অলৌকিক এক জীবনেই বামন এবং দৈত্য

রূপকথায় বামন এবং দৈত্যের কাহিনি আমরা অনেক পড়েছি। সেখানে বামন এবং দৈত্যের আকার, ব্যবহার এবং বৈশিষ্ট্য আলাদা হলেও বাস্তবে এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি জীবদ্দশায় বামন এবং দৈত্য (লম্বা অর্থে) উভয় আকৃতি পেয়েছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন ঘটনা একটিই রয়েছে।

মেডিকেল সায়েন্সের ব্যতিক্রম ব্যাপারগুলো সবসময়ই বিশেষজ্ঞদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমগুলো এতোটাই বিরল হয় যে, এ সম্পর্কে কেউ খুব বেশি জানেন না। অর্থাৎ পুরো বিষয়টিই অজানা। সঙ্গত কারণে গবেষণার জন্য এই ব্যাপারগুলো বিশেষজ্ঞদের কাছে অধিক গুরুত্ব পায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এমন ঘটনায় রেকর্ড বুকে নাম লেখানো লোকের সংখ্যা খুব কম। ব্যতিক্রম শুধু অ্যাডাম রেইনার। তিনি ১৮৯৯ সালে অস্ট্রিয়ার গ্রেজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পরপরই তার পিতামাতা বুঝতে পারেন, ছেলে শারীরিকভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে জন্মেছে। বামন হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার বাবা-মার কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন এবং ভালোবাসা পেয়েছিলেন।

১৯১৮ সালে যখন অ্যাডামের বয়স ১৮ বছর, তার উচ্চতা পরিমাপ করা হয়েছিল ৩ ফুট ৭.৯ ইঞ্চি। সে বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অ্যাডাম সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তার খর্বকায় উচ্চতার জন্য সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা কিছু পরীক্ষা করেন। এবং তাকে বামন হিসেবে তালিকাবদ্ধ করেন। রিপোর্টে তারা লিখেছিলেন, স্বল্প উচ্চতার জন্য তিনি কখনোই দক্ষ সৈনিক হতে পারবেন না। এই রিপোর্টে একটি অদ্ভুত ব্যাপার লেখা ছিল। বামন হওয়া সত্ত্বেও অ্যাডামের হাত এবং পা শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক বড় দেখা গেছে।

এক বছর পর ১৯১৯ সালে অ্যাডামের উচ্চতা দুই ইঞ্চি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ ফুট ৯.৯ ইঞ্চি। ১৯২০ সালে ২১ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর সবাই ভেবেছিল অ্যাডামের উচ্চতা সম্ভবত আর বাড়বে না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করে। কাকতালীয়ভাবে অ্যাডামের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তাও আবার এক-দুই ইঞ্চি না; ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ৩১ বছর বয়সে এসে তার উচ্চতা হয় ৭ ফুট ১ ইঞ্চি। যতো দিন যাচ্ছিল অ্যাডামের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছিল।

অ্যাডামের এই রোগের নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেও চিকিৎসকরা এর কূল-কিনারা করতে পারেননি। সবশেষে ১৯৩০ সালে চিকিৎসক উইন্ডহলজ এবং ম্যান্ডল অ্যাডামের আরো কিছু পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, অ্যাডামের পিটুইটারি গ্রন্থিতে একটি টিউমারের জন্য তার উচ্চতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তারা আরো উল্লেখ করেন, এই টিউমারটি এক্রোম্যাগলি নামক একটি রোগের উদ্ভব ঘটায়। এজন্য তার শরীরের অন্যান্য স্বাভাবিক অঙ্গগুলোর অনুপাতে হাত এবং পা অস্বাভাবিক ছিল। বিখ্যাত রেসলার আন্ড্রে দ্য জায়ান্ট এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

এক্রোম্যাগলি আক্রান্ত লোকেদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য কিছুটা এরকম- অস্বাভাবিক বাঁকা চোয়াল, বিশাল কপাল, স্বাভাবিকের চেয়ে ঘন ঠোঁট এবং দাঁতগুলো এমন যেন প্রত্যেকটা একে অপরের থেকে আলাদা।

১৯৩১ সালে চিকিৎসকরা অপারেশনের মাধ্যমে তার টিউমার অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কেননা দীর্ঘ দশ বছর ধরে অ্যাডামের শরীরে বড় হচ্ছিল  টিউমার। মারাত্মক ঝুঁকি উপেক্ষা করে চিকিৎসকেরা অপারেশন করেছিলেন এবং সফলভাবে টিউমারটি অ্যাডামের শরীর থেকে অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর সবাই ভেবেছিল, অবশেষে অ্যাডামের ক্রমাগত উচ্চতা বৃদ্ধির বোধহয় সমাপ্তি ঘটল।

বেশ কিছুদিন পর অ্যাডাম রেগুলার চেকআপের জন্য চিকিৎসকের  কাছে যান। তখন তার উচ্চতা বৃদ্ধির সমস্যা প্রায় সেরেই গিয়েছিল। কিন্তু তার মেরুদণ্ডের বক্রতা লক্ষণীয়ভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আরো কিছুদিন পর চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন, অ্যাডামের উচ্চতা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। তবে এবার আগের চেয়ে অনেকটা ধীর গতিতে।

দুর্ভাগ্যবশত, অপারেশনের কয়েকমাস পর থেকে অ্যাডামের স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে। তার একটা চোখ অন্ধ হয়ে যায় এবং শ্রবণশক্তি কমতে থাকে। তার মেরুদণ্ডের অবস্থা দিন দিন এতো খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, বাকি জীবন তাকে বিছানায় শুয়ে কাটাতে হয়েছে। অবশেষে অ্যাডাম ১৯৫০ সালের ৪ মার্চ অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় ৫১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর সময় তার উচ্চতা ছিল ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি।

অ্যাডামের বামন থেকে দৈত্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম অলৌকিক ঘটনা। আজ অবধি রেকর্ডবুকে বামন এবং দৈত্য হিসেবে একসঙ্গে উভয় রেকর্ডের একমাত্র মালিক হিসেবে অ্যাডাম রেইনারের নাম টিকে আছে।



ঢাকা/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়