ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আমার ক্ষণিকের অতিথি

তামান্না হাফিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমার ক্ষণিকের অতিথি

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| তামান্না হাফিজ ||

মিসেস করিমের জন্য আজকের দিনটা অন্য রকম। অনেক ভালোলাগা, ভালোবাসার দিন আজ। তিনি এভাবেই মনে রাখতে চেয়েছিলেন আজকের দিনটাকে। সকাল বেলা, রং-চা হাতে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসলেন। ড্রয়ার খুলে গহনার বাক্স থেকে শুকনো বকুল ফুলের মালাগুলো বের করে আয়নার সামনে সাজিয়ে রাখলেন। ঘ্রাণটা হারিয়ে গেছে, কিছু ফুল ঝরে গেছে, রংটা এমন বাদামি হয়ে গেছে যে আসল রং বোঝাই যাচ্ছে না। এসব কিছুর পরেও মিসেস করিমকে এ ফুলের মালাটা জীবনের অনেক গল্প যেন বলে যাচ্ছে। গল্পের প্রতিটা মুহূর্তের কথা মনে পরে যাচ্ছে, সেই এক বছর আগের কথা।

সেদিন সকালে করিম সাহেবের সাথে মিসেস করিমের বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিল, বড় মেয়ে হিয়াকে নিয়ে। হিয়া রাগ করে বাবার বাড়ি চলে এসেছিল সেদিন। মিসেস করিম,  তার সাহেবকে বলেছিলেন, শফিক আর মেয়েকে নিয়ে বসতে। এ রকম হলে তো আর হয় না। করিম সাহেব বলেছিলেন, ‘ওদের সমস্যা ওদের সমাধান করতে দাও, ওদের মাথা ঠাণ্ডা হলে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

সেদিন সন্ধ্যা বেলা শফিক এসে হাজির। তখনও করিম সাহেব বাড়ি ফেরেননি। শফিক এসে কিছুক্ষণ বসার ঘরে বসে ছিল। মিসেস করিম ভেবেছিলেন, হিয়া খুশি হয়ে দেখা করতে গেছে। কিন্তু পরে বুয়ার মুখে শুনেছিলেন,  হিয়া শুধু চা দিয়ে চলে এসেছে। তখন মিসেস করিম তাড়াতাড়ি উঠে বসার ঘরে গিয়েছিলেন। শফিক তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে হেসেছিল। মিসেস করিম জামাইয়ের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে তোলার জন্য সহজ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘শফিক, এসেছ! ভালোই হলো, আজ সন্ধ্যায় আর একা একা বসে চা খেতে হবে না।’

শফিক ছেলেটা ভালো। জামাই হলেও মন খুলে কথা বলে সব সময়। এমনিতেও সে খুব সরল, আদব কায়দা জানা ছেলে। যে কারণে মিসেস করিম এমনকি তার স্বামী কেউই শফিকের সঙ্গে যে কোনো আলোচনা করতে দ্বিধা বোধ করেননি।

শফিকই প্রথম কথা বলে- ‘দুপুরে বাবা এসেছিলেন অফিসে। বললেন, আজ রাতে সবাই একসঙ্গে খাবেন। তাই চলে এলাম।’
‘বেশ করেছ।’ বলেই মিসেস করিম শফিকের দিকে তাকান। ভালো করে বোঝার চেষ্টটা করেন ওর মনের অবস্থা। প্রসঙ্গটা এখনই ওঠাবেন কিনা ভাবতে থাকেন। এমন সময় শফিকই প্রথম বলে, ‘মা, আসলে সেদিন হঠাৎ আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হিয়ার সঙ্গে একটু বেশি হইচই করে ফেলেছিলাম। বুঝতে পারিনি ও এভাবে রিঅ্যাক্ট করবে।’
মিসেস করিম নরম গলায় বলেন, ‘এটা তোমাদের নিজেদের ব্যাপার। সব সংসারেই এসব হয়। তাই বলে  মেয়েটা যদি এভাবে চলে আসে, সেটা ভাল দেখায় না।’

এ কথার কী উত্তর দেবে শফিক ভেবে পায় না। সে চুপচাপ বসে থাকে।
‘তোমার কি হিয়ার সাথে কথা হয়েছে?’ মিসেস করিম জানতে চান। পরক্ষণেই বলেন, ‘যাও হিয়া ঘরেই রয়েছে। কথা বলো।’

শফিক উঠে হিয়ার ঘরে চলে যায়। মিসেস করিম গিয়ে ঢোকেন রান্নাঘরে। সেদিন রাতে বাসায় এমনিতেই ভালো রান্না হচ্ছিল। কারণ সেদিন তাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল। স্ত্রীর হাতে রান্না করা খাসির রেজালা করিম সাহেব খুব পছন্দ করেন। যে কারণে কোনো অনুষ্ঠান হলে মিসেস করিম এই আইটেম রাখার চেষ্টা করেন।
রান্না ঘরের কাজ সারতে সারতে সেদিন রাত হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে করিম সাহেবও চলে এসেছিলেন। রান্নাঘর থেকে বেডরুমে ঢুকেই মিসেস করিম বকুল ফুলের ঘ্রাণ পেয়েছিলেন। এখনও সেই ঘ্রাণ চোখ বন্ধ করলে পান তিনি। সেদিন চারদিকে তাকিয়ে খুঁজেছিলেন ঘ্রাণের উৎস। আশপাশে তাকিয়ে পেয়েও গিয়েছিলেন;  দরজার পাশে যে ড্রেসিং টেবিলটা ছিল, সেখানেই রাখা ছিল অনেকগুলা বকুল ফুলের মালা। মিসেস করিম আপনমনেই বলেছিলেন, ‘ওহ! মনে আছে তাহলে?’

করিম সাহেব বাথরুম থেকে বের হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘একা একা কার সঙ্গে কথা বলছ?’
‘না, বলছিলাম হঠাৎ ফুল আনলে যে?’
‘আরে, আজকে একটা বিশেষ দিন। তাই আনলাম।’
‘তুমি তো ভুলে যাও প্রতি বছর। তাই বললাম।’
‘তা ঠিক। তবে তোমার জ্বালায় আর ভুলে থাকতে পারছি কই?’ করিম সাহেব হেসে ফেলেছিলেন।
সেই হাসিতে যোগ দিতে দিতে মিসেস করিম বলেছিলেন, ‘শফিক এসেছে।’
‘তাই নাকি! তাহলে তো ভালোই হয়েছে। জলদি খাবার দাও। সবাই একসঙ্গে খাব আজ।’

খাবার টেবিলে সবাই ছিল সেদিন। হিয়া, শফিক, করিম সাহেবের বড় ছেলে তানভীর, ছেলের বউ শায়লা, আর ছোট ছেলে তন্ময়। এমন ভরা টেবিল দেখে করিম সাহেবের মুখে যে শান্তির হাসি ফুটে উঠেছিল তা আজও মনে পড়ে। খেতে খেতে তন্ময়ই বলেছিল, ‘বাবা, মার জন্য কি গিফট আনলে?’
‘আগে বল, তোর মা আমার জন্য কি গিফট এনেছে?’
‘মা এতো কষ্ট করে সবার জন্য রান্না করল। আর কী চাই?’

এমন ছোট ছোট অনেক কথাই হয়েছির সেদিন। তারপর রাতে হিয়াকে নিয়ে ফিরে গিয়েছিল শফিক। পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় তন্ময় ঘরে এসে মিসেস করিমকে বলেছিল, ‘মা, তোমাকে মোবাইলে একটা এফ.এম. স্টেশন ধরিয়ে দিচ্ছি। একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য বাবার পক্ষ থেকে।’
মিসেস করিমের ভালোই লাগছিল শুনতে। অনেকেই প্রিয়জনের জন্য এসএমএস করে বিশেষ গান শোনানোর অনুরোধ করছিল। কেউ জন্মদিনে বন্ধুদের উইশ করছিল। মিসেস করিম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুনছিলেন। হঠাৎ তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। রেডিওর মেয়েটি বলছে, ‘ধানমণ্ডি থেকে মি. করিম লিখেছেন, তুমি আমার জীবনে অতিথি হয়ে এলে। জানি না কীভাবে জীবনের এতোগুলো সময় পার করে দিলাম তোমার সাথে। তুমি সাথে ছিলে বলেই সময়টা এতো অল্প মনে হয়েছে। মিলি এভাবেই থেকো সারা জীবন আমার সাথে। এরপর করিম সাহেব মান্না দের ‘পাথরে লেখ নাম গানটি শুনেতে চেয়েছেন। এবং গানটি তিনি উৎসর্গ করেছেন মিলির নামে। লিসেনার্স আমরা এখন মিলি ম্যাডামের উদ্দেশ্যে গানটি প্লে করছি।’

গান শেষ হওয়ার পরই তন্ময় ফোন করে জানতে চেয়েছিল, ‘মা শুনেছ?’
‘এ সব তোর কাজ, তাই না?’ মিসেস করিম জানতে চেয়েছিলেন।
‘আরে না। আমি শুধু বাবাকে একটু হেল্প করেছি। যাই হোক, বাবাকে ফোন দাও।’
ছেলের মনে না করিয়ে দিলেও হতো। মিসেস করিম ছেলের সঙ্গে কথা বলার পর এমনিতেই স্বামীকে ফোন দিতেন। তার মনে পড়ে গেল,  বিয়ের পর পর যখন করিম সাহেব উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন দুই বছর তখন এভাবে চিঠি লিখতেন। প্রতিটি চিঠিতেই তিনি  মিলিকে ‘অতিথি’ বলে সম্বোধন করতেন। চোখে পানি এসে গিয়েছিল মিসেস করিমের।

সকাল কেটে গেল মান্না দের সেই গানটি গুনগুনিয়ে। দুপুরের দিকে এসেছিল ফোনটা।  আর সঙ্গে সঙ্গে মিসেস করিমের কণ্ঠটা রুদ্ধ হয়ে গেল। করিম হাসপাতালে। না, সেদিন হাসপাতালে গিয়ে করিমকে সে পায়নি। এরপর বকুল ফুলের মালাটা যেদিন শুকিয়ে গেল, মিলি তার গহনার বাক্সে গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। এটা তার ক্ষণিকের অতিথির শেষ উপহার।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়





রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়