ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

কেমন করে এলো বন্ধু দিবস

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০২, ৩ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেমন করে এলো বন্ধু দিবস

রুহুল আমিন : একটি বই একশ’ বন্ধুর সমান.. কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান- এ পি জে আব্দুল কালাম।

জীবনে চলার পথে সংশয়হীন সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। বন্ধু মানে নিশ্চয়তা, বন্ধু মানে পথ চলার স্বপ্ন সারথী। বন্ধু মানে সীমাহীন নির্ভরতা। যাকে অবলম্বন করা যায়। দুর্দিনে পাশে পাওয়া যায়। আনন্দের দিনে উদযাপনে সঙ্গী হয়। যাকে নির্দ্বিধায় বলা যায় দুঃখের কথা, বেদনার কথা। আর কাউকে যে কথা বলা যায় না সে কথা, বন্ধুকে বলা যায় নির্ভয়ে। বন্ধু মানে চরম তৃষ্ণার ক্ষণে এক আজলা জল।

তাইতো কবি বন্ধুকে খোঁজেন এভাবে-

‘আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম যে আমার

পিতৃশোক ভাগ করে নেবে, নেবে

আমার ফুসফুস থেকে দূষিত বাতাস’

বন্ধুত্বের এই নির্ভরতায় এক সময় স্বীকৃতির দাবি উঠল। বছরের একটি দিন বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের একটা রেওয়াজ চালু হতে থাকল গত শতাব্দিতে। তবে বন্ধু দিবস উদযাপনের সুনির্দিষ্ট দিন নিয়ে বির্তক আছে। ঠিক কোন দিনে বন্ধু দিবস পালন শুরু হয় তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে।

কিংবা কী করে এলো বন্ধু দিবসের ধারণা। একথা সত্য যে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশেই শুধু নয়, বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশেই প্রতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম রোববার উদযাপন করা হয় বন্ধু দিবস হিসেবে। বন্ধুত্ব আদিম যুগ থেকে থাকলেও। বন্ধুত্বের কেতাবি এই উদযাপন কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়।

বন্ধু দিবসের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই যে ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেন সেটি হলো- ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য সে দেশের সরকারকে দায়ী করা হয়। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার।  পরদিন সেই ঘটনার প্রতিবাদে ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। আর সেই থেকেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে আমেরিকান কংগ্রেস ১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বেশকিছু দেশ বন্ধু দিবসের সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করে নিতে থাকে।

আরেকটি মতবাদ হলো- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিশৃঙ্খলা ও হিংস্রতা মানুষের মধ্যে অনেকটাই বন্ধুর অভাব তৈরি করেছিল। ফলে ওই রকম এক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধু দিবস নির্ধারিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

আবার অন্য এক মতে, বন্ধু দিবসের ধারণা ও উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ১৯১৯ সালে সর্বপ্রথম আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে প্রথম ‘বন্ধু দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়েছিল। এ দিনটির মধ্য দিয়ে পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের মধ্যে কার্ড, উপহার বিনিময় করত। আর তখন থেকেই নাকি বন্ধু দিবসের উৎপত্তি।

আরেকটি মত হলো, ১৯১০ সালে জয়েস হলের প্রতিষ্ঠিত হলমার্ক কার্ড বন্ধু দিবস পালনের রীতিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিল।

১৯৫৮ সালে আন্তর্জাতিক নাগরিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড বিশ্বে শান্তির উদ্দেশে প্যারাগুয়েতে ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেয়। প্যারাগুয়ের রাজধানী থেকে ২০০ মাইল দূরের পূয়ের্তো পিনাস্কো শহরে বন্ধুদের নিয়ে আয়োজিত সাদামাটা এক ডিনার পার্টিতে বিশেষ এই প্রস্তাবটি রেখেছিলেন ড. আর্টেমিও ব্রাকো।  ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আর্টেমিও ব্রাকো এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

অবশ্য ওই রাতেই ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডসিপ ক্রুসেড প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি ৩০ জুলাই বিশ্বব্যাপী বন্ধু দিবস পালনের জন্য জাতিসংঘেও প্রস্তাব পাঠায়। বন্ধু দিবসের ছড়িয়েপড়া ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠা থেকে তখন নিজেদের দূরে রাখতে পারেনি জাতিসংঘও। তার প্রমাণ ১৯৯৭, মতভেদে ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আনানের স্ত্রী ন্যানে আনান  বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র  ‘উইনি দ্য পুহ্’-কে বন্ধুত্বের বৈশ্বিক প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেন।

তবে ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডসিপ ক্রুসেডের দাবির  প্রায় পাঁচ যুগ পর ২০১১ সালের ২৭ জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৩০ জুলাইকে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। তবে এখনো বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগস্টের প্রথম রোববারই বন্ধু দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আবার কোনো কোনো দেশে  ৮ এপ্রিল বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

বন্ধু দিবস উৎপত্তির সবচেয়ে চমকপ্রদ ও রাজনীতিঘনিষ্ট দাবিটি হলো- বন্ধুত্বের টান থেকে নয় উল্টো বাণিজ্যিক উদ্যেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ‘বন্ধু দিবস’ পালনের প্রথা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সালে। সে সময় ২ আগস্টকে বন্ধু দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, ওই দিনটিতে নিজ নিজ বন্ধুদের শুভেচ্ছা কার্ড, ফুল ও উপহার দেওয়ার জন্য মার্কিন জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার হাওয়ার্ড হল। আর এই সম্পূর্ণ বিষয়টির প্রচারেরর দায়িত্ব নিয়েছিল দেশটির ‘গ্রিটিং কার্ড ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন’। কিন্তু ক্রেতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বাণিজ্যিক উদ্যেশ্যে গড়ে তোলা ওই ‘বন্ধু দিবস’প্রথা।

পরবর্তীকালে ১৯৩৫ সালে দ্য ইউনাইটেড স্টেটস কংগ্রেস আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে ‘জাতীয় বন্ধু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘জাতীয় বন্ধু দিবস’ পালনের প্রথা শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে বিষয়টি পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

যেভাবেই বন্ধু দিবসের উৎপত্তি হোক না কেন। এই দিনে আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনে হলেও বন্ধু বন্ধুকে স্মরণ করে, কাছে থাকে, আড্ডা দেয়। বন্ধু দিবসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হলুদ গোলাপ আর ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের মতো বিষয়গুলোও। এই ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের ধারণাটিও এসেছে আমেরিকা থেকেই। দেশটির আদিবাসীদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্যান্ড দেওয়ার রীতি চালু ছিল। বন্ধুদের জন্য তার ব্যান্ড তৈরি করে। বন্ধুত্বের প্রতীক যে হলুদ গোলাপ সেই হলুদ রং হলো আনন্দের প্রতীক। অবশ্য হলুদ গোলাপ মানে শুধু আনন্দই নয়, প্রতিশ্রুতিও। পদ-পদবিতে আটকে থাকে না বন্ধুত্ব। আর এই সম্পর্কের কোনো রূপান্তরও নেই। বয়সও কোনো হেরফের তৈরি করে না বন্ধুত্বে। বন্ধুত্ব শর্তহীন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুলাই ২০১৭/রুহুল/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়