পাঁচ বছর পর || তানভীর আহমেদ সিডনী
তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম
অলংকরণ : সংগৃহীত
দূরে কোথাও করুণ সুরে বাঁশি বাজছে। কম্পিউটারে কেউ একজন টাইপ করছে। কি-বোর্ডের শব্দ। কারো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। চেয়ার সরায় একজন-
পুরুষ : ও কি উঠছ যে! বসবে কি কিছুটা সময়?
নারী : ব্যস্ত তুমি অনেক।
পুরুষ : মোটেই না, তোমার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি।
নারী : তাহলে কম্পিউটার আর তার কি-বোর্ড!
পুরুষ : একেবারেই অপ্রয়োজনীয় কাজের ভাব। কম্পিউটারে থাকলে আমার মন স্থির থাকে। ছুটে যায় না। আমার হাত যেখানেই থাক, মন তোমার কাছে বান্ধা আছে।
নারী : বাহ্! বলো কেন বসিয়ে রেখেছ।
পুরুষ : তোমায় দেখব বলে।
নারী : দেখেছ তো অনেক দিন, আজ আর বিশেষ কী প্রয়োজন?
পুরুষ : নেই, প্রয়োজন নেই। তারপরও তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই আমার সময় থেকে খানিকটা অংশ।
নারী : শুনেই মন কেমন যেন হয়ে যায়।
পুরুষ : আছে কি মনে? বলেছিলে একদিন- আমার সঙ্গে সময় কাটাতে তোমার আমোদ লাগে।
নারী : ভুলিনি সে কথা।
পুরুষ : এর পরের কথাগুলো।
নারী : তাও কি ভোলা যায়?
পুরুষ : না যায় না। তাইতো তোমার সঙ্গে কাটাই দীর্ঘ সময়। ভালোবাসায় আর ভালো লাগায়। কিন্তু ভাগ্য আমাকে তা করতে দিল না।
নারী : চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে থাকতে, বলেছিলাম বললে খুলে দিতে পারি সব। কেন জানি না, সে সময় তোমার সব কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
পুরুষ : হ্যাঁ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সামনে বসে থাকতে।
নারী : বিনিময়ে তোমায় দিয়েছি অনেক কিছু?
পুরুষ : তোমার শরীরের সব বাঁক ছুঁতে দিয়েছিলে?
নারী : আর?
পুরুষ : আর!
নারী : বলো, তোমার মনে কি ভাসে না কিছু?
পুরুষ : ভুলে গিয়েছিলাম। ভরা সন্ধ্যায় ঝিরঝির বাতাসে তোমার নাভির চারপাশে আলপনা এঁকেছিলাম। হ্যাঁ, কালো কালি আর তোমার বাদামি চামড়া। মানবীর শরীরে চকমক করে উঠেছিল সে চিত্রকর্ম। সেসব ভুলে যাইনি।
নারী : এখনো মনে হয় তোমার সামনে বসে থাকি, যেমন পাঁচ বছর আগে বসে থাকতাম। ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই তোমার আঙুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। সেসব ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে।
পুরুষ : তারপর এক ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল আমাদের, অভিযুক্ত হলাম। আলো থেকে অকস্মাৎ আঁধারে। ওহ্ কি ভয়াবহ সে সময়! জেলে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে।
নারী : বিশ্বাস করো, প্রথম নয় রাত ঘুমাতে পারিনি। রাত হলেই ভয় আমাকে আক্রমণ করত, মনে হতো একা আমি।
পুরুষ : কেন তোমার প্রতিবেশী, আর তোমার ঘরে ভাগাভাগি করে থাকা ফর্সা মেয়েটা?
নারী : ওরা সারা দিন পরিশ্রমের পর মরার মতো ঘুমাত আর জেগে থাকার সময়ে সিঁড়ি খুঁজত, ওপরে চলবার সিঁড়ি। যা সবাই খোঁজে।
পুরুষ : প্রথম রাতে আমাকে বসিয়ে রেখেছিল থানার বারান্দায়, সে ছিল ভয়ংকর ঠান্ডার রাত, শরীর জমে যায়। কিন্তু কিছু করতে পারিনি; চুপচাপ বসে কাঁপছিলাম। একসময় শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল।
নারী : ওহ্ আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। কাউকে ডাকতে পারতাম না। তারপর কামাল এল, ভরসা পেলাম। এবার বোধ হয় শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারব।
পুরুষ : বাঁশিওয়ালা, জেলে থাকতেই ওর কথা শুনেছি।
নারী : জানো, ও আসার আগে একটি রাতও ঘুমাতে পারিনি। প্রতি রাতেই ঘুম ভেঙে যেত, বিছানায় বসে থাকতাম ভোরের জন্য। কামাল ছিল আমার ঘুম। ওর সঙ্গে কথা বলার পর রাজ্যের ঘুম নামত চোখে।
পুরুষ : সে ঘুমের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছ তুমি।
নারী : অস্বীকার করব না, তারপর ওর সঙ্গে সংসার শুরু করলাম। আজ চার বছর কামালের সাথে, সুখে আছি কি না বলতে পারব না।
পুরুষ : আমার কথা জানে তোমার স্বামী?
নারী : নাহ্ পুরুষ কখনো স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গে ভাগ করতে চায় না।
পুরুষ : আচ্ছা প্রেমিকাকে ভাগ করে? বলতে পারো? আরে না, এর উত্তর তোমার জানা নাই। সাবধান, আমার সব যেন না জানে। একটু কাছে আসবে।
নারী : কেন?
পুরুষ : আগের মতো আদর করব। তোমার সঙ্গে কাটানো সে রাতের মতো।
নারী : ভুলে যেও না, অন্যের ঘর করি। আমার আশ্রয় কামাল।
পুরুষ : কিন্তু?
নারী : না, তোমায় সুখ দিতে গিয়ে কাউকে ঠকানোর পাপ ঠিক হবে না।
পুরুষ : একবারের জন্য।
নারী : নাহ্।
পুরুষ : তুমি কি আমায় আগের মতো ভালোবাসো? পাঁচ বছর আগে যেমন করে ভালোবাসতে, ঠিক তেমন?
নারী : ভালোবাসি তোমাকে, অস্বীকার করব না।
পুরুষ : তবে কাছে আসতে ভয় কেন? শঙ্কা কেন?
নারী : তোমায় ভালোবেসে মনকে অশুদ্ধ রেখেছি, ঠকিয়েছি ওকে। আর শরীর দিলে...।
পুরুষ : বুঝতে পেরেছি যা বলতে চাও। জানো, জেল থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেখানে, যেখানে আমরা প্রতিদিন বসতাম, জারুল গাছটা মরে গেছে। অথবা সভ্যতার নামে শিকড় থেকে উপড়ে নিয়েছে কেউ। অন্ধ বাউলের খোঁজ কেউ দিতে পারেনি। ওখানে যে নতুন বাজার হয়েছে! কেউ কিছু বলতে পারল না।
নারী : গাছটা কেটে ফেলার পর অন্ধ বাউল আর আসেনি। এখন কেউ সেখানে গান করে না। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল গত বছর।
পুরুষ : আমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল? কিংবা অন্য কিছু, যাতে আমার প্রসঙ্গ আছে।
নারী : ওর সব মনে ছিল, তোমরা যে দেহতত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে সে অংশটুকু বলেছিল। তোমার সেই কথা, জীবনের সন্ধান যে জীবনই দিতে পারে- কোনো কিছুই ভুলে যায়নি।
পুরুষ : আহ্ তবে একজন মনে রেখেছে, সেটাই বা কম কিসে?
নারী : সে যেতে চেয়েছিল জেলে কিন্তু তার আগেই ওর ফ্লাইটের তারিখ নির্ধারিত হয়। এখন লন্ডনে আছে সে। ওখানকার একটা মদের দোকানে হাসন আর করিমের গান শোনায়।
পুরুষ : তুমি তো দেখছি ওর সব খবর রাখো। হাহ্ অন্ধ বাউল, প্রকৃতি থেকে চলে গেলে পণ্যে। আচ্ছা লন্ডনের পানশালায় যখন গান গাও তখন কি জারুলের ঘ্রাণ পাও? কিংবা রুশ ভোদকার বোতলে ঝিরঝির বাতাস? দেখ কি শ্যাম্পেনের বোতলে শখের হাঁড়ি? বাউলের আর কোনো খবর?
নারী : নাহ্ শেষ খবর আমার কাছে নেই।
পুরুষ : ওহ্ আমরা অনেক খবরই রাখতে পারি না।
নারী : এখন কী করবে ঠিক করেছ?
পুরুষ : এখনো চূড়ান্ত কিছু ভাবিনি। মাছের ঘের করব। নানা জাতের মাছ আমার পুকুরে নাচবে, গাইবে- পাড় থেকে দেখব।
নারী : যে মানুষ নাগরিকতাকে আশ্রয় করেছে- সে কেমন করে নাগরিক জীবনের বাইরে যাবে। যতবার বলেছি, প্রত্যাখ্যান করেছ। বলেছ, গ্রাম তোমার জন্য নয়। নাগরিক জীবনই তোমার সবচেয়ে বড় সত্য।
পুরুষ : নাগরিক জীবন আমাকে জেল দিয়েছে, পাঁচটি বছর কেটে নিয়েছে। এ জীবনকে আর বিশ্বাস করা যায় না। মানুষকেও না।
নারী : তাই মাছেদের সাথে থাকবে?
পুরুষ : তেমনই ইচ্ছে, কথা হয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শুরু করে দেব।
নারী : কবে যাবে?
পুরুষ : এখনো ঠিক করিনি।
নারী : যাবার আগে একবার আমার সঙ্গে দেখা করে যেও। জীবনটাকে আবার নতুন করে শুরু করা যায় না?
পুরুষ : প্রতিবার ঘুম ভাঙলেই নতুন করে জীবন শুরু করি। জীবনের নিয়মই যে তা।
নারী : তা যা বলেছ। আগের চেয়ে একটু সাদা হয়েছে?
পুরুষ : হ্যাঁ ওখানে আলোয় কম থাকতাম, অন্ধকারের বাসিন্দা বলেই গায়ের রং বদলে গেছে।
নারী : হবে হয়তো, আমার হাত একবার ছুঁয়ে দেখবে না?
পুরুষ : ছুঁয়ে দেখতে চাই অনেক কিছুই, কিন্তু তুমি পরস্ত্রী। তাই আর হলো না। জেল থেকে বের হবার সময় সদর দরজা থেকে তোমার জন্য কামিজ কিনেছিলাম।
নারী : বলো কী?
পুরুষ : হ্যাঁ, তুমি একটু মুটিয়ে গেছ, এখন মনে হচ্ছে গায়ে লাগবে না।
নারী : কই দাও!
পুরুষ : কম্পিউটার টেবিলের নিচে রেখেছিলাম, এই নাও। অবশ্য না হলে বদলে আনতে পারো। দোকানের ঠিকানা আছে।
নারী : তোমার আর সব উপহারের সঙ্গেই থাকবে এটাও।
পুরুষ : চিঠিগুলো?
নারী : নাহ্ ওগুলো পুড়িয়ে ফেলেছি। এগারটা চিঠি কাঁটার মতো আমার শরীরে বিঁধে ছিল।
পুরুষ : পাঁচ বছরে বদলেছে অনেক কিছুই।
নারী : তা বলতে পার। কিন্তু মন বদলায় না। প্রথম দিনের মতোই বেঁচে থাকে সে।
পুরুষ : দারুণ, মানুষ বদলায় কিন্তু তার মন প্রথম দিনের মতোই।
নারী : যাবার আগে তোমাকে একটা অনুরোধ করতে চাই।
পুরুষ : বলো।
নারী : একটা প্রেম করো, না না বিয়ে করো।
পুরুষ : কী যে বলো?
নারী : হ্যাঁ, সংসার হলে পাঁচ বছরের গ্লানি মুছে যাবে। ভুলে যাবে তোমার প্রতি যারা অন্যায় করেছিল তাদের কথা, একটা অন্য রকম পৃথিবী।
পুরুষ : সব কি ভেবে বলছ?
নারী : কেন নয়? ভেবেচিন্তেই বলছি তোমাকে। নতুন জীবনে পা রাখতে পারবে। নতুন মানুষ, নতুন পৃথিবী।
পুরুষ : বোঝনি তুমি! যে আগুনে পুড়ছ, সে আগুন জ্বালাতে চাইছ আমার মনে।
নারী : মানে?
পুরুষ : খুব সহজ। যখনই নতুন কারো সঙ্গে সময় কাটাতে চাইব, দেয়াল হবে তুমি।
নারী : আমি তো থাকব না তোমার সামনে?
পুরুষ : থাকবে তোমার স্মৃতি, যে অনবরত জ্বালাবে আগুন। এ তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি- রাতে খাবার টেবিলে যখন তোমরা কথা বলো, আমাদের কথা মনে হয় না তোমার। কিংবা থাক সে প্রসঙ্গ তুলতে চাই না।
নারী : আহ!
পুরুষ : আর্তনাদ করো না। বিছানায় লুটোপুটি খাবার সময় কখনো আমার হাত খোঁজনি তুমি, কিংবা অস্বস্তি হয়নি।
নারী : আজ কি আমাকে পোড়াবেই?
পুরুষ : নাহ্ আর কিছু বলব না। তোমার কাছে শেষ বিদায় নিয়ে যাব। তার আগে আমার কয়েকটি কথা শুনতে বলব তোমাকে।
নারী : বলো।
পুরুষ : পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।
নারী : নাহ অপরাধী তুমি নও, আমি। আমার জন্যই এত বড় অপরাধ করেছিলে। আর সেই আমিই তোমার জীবনে নেই। জানি তোমার কষ্ট কতটুকু।
পুরুষ : আরে ধুর, জীবনের সব আশা সত্য হয় না। কিছু আশা দূরে থাকে, যাকে ছোঁয়ার জন্য আমাদের প্রাণ আইটাই করে। হয়তো এটাই বাঁচার সূত্র।
নারী : মাঝে মাঝে আমার মনে হয় সব রেখে দূরে চলে যাব। কেউ কেউ জানবে, ছিল একজন, যে মরে গেছে।
পুরুষ : হুম! মৃত্যুকেই আপন করতে চাও তুমি?
নারী : হয়তো বা।
পুরুষ : তাহলে তো বেঁচে থাকাটাই স্মৃতি হবে তোমার। সে যাক, আজকের মতো বিদায় নিলাম। দেখা হবে পরে কোনো একদিন।
নারী : হয়তো বা।
পুরুষ : আজ আসি তাহলে, ভালো থেকো।
নারী : তুমিও সুখে থেকো। বিদায়!
পুরুষ : বিদায়! তোমার বিশ্বাস না হলেও আমি বলতে পারি- হয়তো আমাদের দেখা হবে ঠিক পাঁচ বছর বাদে, আবার খানিকটা সময় একসঙ্গে কাটাব।
নারী : ঠিক তাই! এমন স্বপ্ন নিয়েই তো বেঁচে আছি। তোমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে বলে যাই শেষ কথা- মোছনি তুমি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৬/এএন/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন