ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য

ইউনুস কানন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য

কাপ্তাই লেকে ঝুলন্ত ব্রিজ

|| ইউনুস কানন ||

প্রকৃতির স্রষ্টা ঈশ্বর আর শহরের স্রষ্টা মানুষ- পার্বত্য অঞ্চল রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে গিয়ে এই বোধে আরো সিদ্ধ হয়েছি আমি। তিন জেলায় অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড় আছে। এসব পাহাড় ঘিরে বাস করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।

পাহাড়ে গিয়ে নিজের কাছে নিজে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হই। এতকাল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা এসব পাহাড়ে বাস করছে অথচ সেখানকার পাহাড়ি পরিবেশ অটুট রয়েছে কীভাবে? প্রথমে মনে হলো, নৃ-গোষ্ঠীর লোকের সংখ্যা কম বলে এটা হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? ঘুরতে ঘুরতে ভাবছিলাম। এক সময় মনে হলো, প্রশ্নের জটটা খুলতে সক্ষম হয়েছি। বুঝতে পারলাম, এখানকার পাহাড়গুলো আর নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা মিশে গেছে পাহাড়ি রূপ, রং ও গন্ধে।

পার্বত্য জেলা শহর থেকে গ্রামের দিকে গেলে জনশূন্যতা ও নির্জনতা পেয়ে বসে। শহরের জনজট সেখানে নেই। বাঙালি এবং নৃ-গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে যথেষ্ঠ অমিল থাকার কারণে সহজেই তারা বাঙালিদের চিনে ফেলে। পাহাড়ে বাঙালিদের অবাধ চলাফেরা তারা সন্দেহের চোখে দেখে। জন্মের পর থেকে তারা একটা নিজস্ব ধারা, পরিবেশ ও সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বড় হয়, যা তারা ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রাখে। কেউ তাদের সংস্কৃতি এবং ভিটেমাটিতে ভাগ বসাক, এটা তারা চায় না।

রাঙামাটি শহরের অদূরে একটি চায়ের দোকানে বসেছিলাম। সেখানে কথা হয় স্থানীয় যুবক বিধান চাকমার (২২) সঙ্গে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপনি বা আপনারা বাঙালি সংস্কৃতি গ্রহণ করতে চান কি না?’ তার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘চাকমারা কেন বাঙালি হতে যাবে?’ তাতেই বোঝা গেল তারা তাদের নিজেদের জাত, বৈশিষ্ট্য, গোত্র সর্বোপরি সংস্কৃতিতে সন্তুষ্ট।


ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে তিনটি জেলার সড়ক যোগাযোগ বেশ উন্নত। একজন নতুন পর্যটকের কাছে পাহাড়ের এই রাস্তাগুলোতে চলাচল করা স্বপ্নের মতো। মানিকছড়ি ও সাতছড়ি পাহাড় অতিক্রম করার সময় মনে হয় নাগরদোলায় চড়ছি। গাড়ি একবার ওপরের দিকে উঠছে আবার নিচের দিকে নামছে, আবার উঠছে, আবার নামছে। অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায়। পুলকিত হয় মন। শঙ্কাও কাজ করে। ‘যদি এই পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে গাড়ির ইঞ্জিন হঠাৎ বিকল হয়ে যায়, তবে কী হবে?’ কিন্তু যখন দেখলাম আমার পাশের সিটে বসে পাহাড়ের এক লোক নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, তখন আমার ভয় কিছুটা কেটে গেল। তা ছাড়া পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢালে যারা গাড়ি চালায়, জানতে পারলাম তারা যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ফলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ‘নাগরদোলায় চড়ছি’ ভেবে বসে রইলাম আর দেখতে থাকলাম পাহাড়ি সৌন্দর্য।

পাহাড়ের সরু রাস্তার দুই পাশে দেবদারু, ঝাউ, রেইনট্রি, ইউক্যালিপটাস আর শাল-সেগুনের ছড়াছড়ি। মাঝে মধ্যে বাঁশের ঝোপঝাড়, ঘন জঙ্গল, অপরিচিত পাখির ডাক- সত্যিই মনোহারি, দৃষ্টিগ্রাহী। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে হুতোম প্যাঁচা ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট পাহাড়ের কোথাও কোথাও কুঁড়েঘর চোখে পড়ে। বাঁশ ও কাঠের বেড়া দিয়ে তৈরি, ওপরে খড়কুটোর ছাউনি। এসব ঘরেই নৃ-গোষ্ঠীদের বসবাস। জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, এরা কীভাবে এখানে বেঁচে থাকে? এদের কি কোনো ভয়ডর নেই? পরক্ষণেই মনে হলো, না, এরা প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির কোলেই এরা সুন্দর।  

রাঙামাটির মূল শহরে কিছু সরকারি দালানকোঠা আছে। কিছু বড় বড় বাড়িও দেখা যায়। শহরের আশেপাশে কিছু রিসোর্ট আর কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির স্বাদ নিতে হলে, যেতে হবে পাহাড়ের গভীরে। শুভলং, প্যাদা টিং টিং বা ঝুলন্ত সেতুতে যেতে চাইলে সঙ্গী পেয়ে যাবেন। আলোচিত এসব স্থানে মানুষের আনাগোনা বেশি। তবে পাহাড়ি অঞ্চলে ঘোরার সময় গাইড থাকা ভালো।


রাঙ্গামাটিতে গোষ্ঠী হিসেবে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তনচঙা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আগেই বলেছি, তারা বাঙালিদের আলাদা চোখে দেখে। তা ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঢুকতে সংকোচ বোধ হতে পারে, ভয় পেয়ে বসতে পারে। এখানে কোনো সমতলের ছোঁয়া নেই। ছোট ছোট পাহাড়, ছোট ছোট কুঁড়েঘর। অধিকাংশ ঘরে বাঁশ বা তক্তার বেড়া, ওপরে খড়কুটোর ছাউনি। অবশ্য এখন টিনের ছাউনি দেখা যায়। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয়রা বাহন হিসেবে নিজেদের তৈরি ছোট ছোট ডিঙি নৌকা ব্যবহার করে। নৌকার জন্য ঘাট বলে তেমন কোন জায়গা নেই। পাহাড়ের গাছগুলোতে পেয়ারা, আমলকি, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা পেকে আছে, কিছু তলায়ও পড়ে আছে। পাহাড়ি এই জনপদ পশুপাখিদের জন্য অভয়ারণ্য। লিচু এবং আমের বাগানে পাখিদের কোলাহল লেগে থাকে। এর মধ্যে কোথাও ঢালু আবার কোথাও খাড়া পথ ধরে হাঁটতে হয়। তখন সত্যিই মনটা শিহরণে ভরে যায়।

অনেকেই ভ্রমণের জন্য পছন্দনীয় ঋতু হিসেবে শীতকাল বেছে নেন। বাংলাদেশে ভ্রমণের জন্য শীতকাল উপযোগী। কারণ পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তি শীতে একটু কম বোধ হয়। তবে কেউ যদি পাহাড়ি জনপদ ও প্রকৃতির সত্যিকার সৌন্দর্য দেখতে চান, তবে গ্রীষ্মকালে যেতে পারেন। গ্রীষ্মে ভরা যৌবন নিয়ে সাজে পার্বত্য অঞ্চল। কিন্তু শীতে দেখতে হয় পাতাঝরা, রংচটা প্রকৃতি। এখন শরৎকাল। সবুজের বান ডেকেছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে। পাহাড়ের চূড়ায় যেন দিগন্ত মিশে গেছে। আবার পাহাড়ের পাদদেশের খাদে খাদে স্বচ্ছ জলরাশি ফুরফুরে বাতাসে দুলছে-ফুলছে।



লেখক : গদ্যকার, চট্টগ্রাম থকে।
 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/রাসেল পারভেজ/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়