ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অরিত্রীর আত্মহত্যা: বিচারের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়বেন বাবা

মামুন খান   || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:০৯, ৩ ডিসেম্বর ২০২১  
অরিত্রীর আত্মহত্যা: বিচারের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়বেন বাবা

অরিত্রী অধিকারী। ফাইল ছবি

বড্ড অভিমানী মেয়ে অরিত্রী অধিকারী। তাই অভিমান নিয়েই অকালে চলে গেলো সবাইকে ছেড়ে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি বুকে আঁকড়েই বেঁচে আছেন হতভাগ্য মা-বাবা। তাদের মতে, অরিত্রীর সাথে অন্যায় আচরণ করে তাকে পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষিকা। আর এ অন্যায়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী। বিচারের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন তিনি।

তিন বছর আগে ২০১৮ সালের এই দিনে (৩ ডিসেম্বর) শিক্ষকদের দ্বারা বাবা-মার অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন অরিত্রী অধিকারী। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে ডিবি পুলিশ। 

২০১৯ সালের ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলম। চার্জ গঠনের ২৯ মাস পার হলেও মামলাটিতে এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত। সর্বশেষ বুধবার মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এজন্য আদালত আগামী ৪ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেন।

মামলা সম্পর্কে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বলেন, ‘তিন বছর হলো মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। মা-বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করে চলে গেলো। সে তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু আমরা তো তাকে ছাড়া মোটেই ভালো থাকতে পাচ্ছি না। শিক্ষকরা এমন দুর্ব্যবহার করেন জানা ছিল না। তারা আমাদের কোনো কথা বলারই সুযোগ দিচ্ছিল না। শুধু বারবার বলছিল, কোনো কিছু শুনবো না কাল এসে মেয়ের টিসি নিয়ে যাবেন। সেই কথাটা এখনো কানে বাজে। সেদিন যদি তারা আমাদের আলাদা ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলতেন তাহলে আর মেয়েকে হারাতে হতো না।’

দিলীপ অধিকারী বলেন, ‘মেয়েকে তো আর ফিরে পাবো না। তবে তার সাথে যারা খারাপ ব্যবহার করেছে, অন্যায় আচরণ করেছে যার জন্য ওকে পৃথিবী ছেড়ে অকালে চলে যেতে হয়েছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয় সে জন্য লড়ে যাবো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি। একার লড়াই হয়ে যাচ্ছে। তবুও হাল ছাড়ছি না। আমাকে লড়ে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবো। যেন ভবিষ্যতে আর কোনো মা-বাবাকে এ অবস্থা দেখতে না হয়।’

অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী বলেন, ‘এক একটা দিন করে তিনটা বছর হয়ে গেলো মেয়েটা আমাদের কাছে নেই। কতদিন তাকে দেখি না। ওকে ছাড়া ভীষণ কষ্টে দিন কাটছে। হাঁটতে, চলতে ওর কথা মনে পড়ে। রান্নাঘর বা বারান্দায় যখন দাঁড়িয়ে থাকি, তখন যদি কোনো শিক্ষার্থীকে দেখি স্কুল ড্রেস পড়ে যাচ্ছে, তখন মনের ভিতর হাহাকার শুরু হয়। তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। চোখে জল চলে আসে।’

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাবিনা আক্তার (দিপা) বলেন, ‘এটি একটি আলোচিত মামলা। বাবা-মাকে শিক্ষকরা অপমান করছিল। সেই অপমান সইতে না পেরে অরিত্রীকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অরিত্রীর বাবা-মা মেয়েকে হারিয়েছে। যার সন্তান যায় সেই বুঝে কষ্টটা। আমরাও তো দুঃখ প্রকাশ করছি। তারপরও যেহেতু মামলাটি আমাদের আদালতে রয়েছে সেহেতু চেষ্টা করছি ভুক্তভোগী পরিবারটা যেন ন্যায়বিচার পায়। মামলাটির বিচারকাজ শেষ করতে আমরা তৎপর আছি। আমাদের বিচারকও যথেষ্ট সিনসিয়ার। মামলাটিতে ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সাক্ষী এনে মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত এগিয়ে নেব। মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয় এবং ভুক্তভোগীরা যেন ন্যায় বিচার পায় এজন্য আমরা চেষ্টা করে যাবো।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।

অরিত্রীর আত্মহত্যায় ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে, এমন অভিযোগে অরিত্রীকে পরদিন তার মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ওই দিন স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। মেয়ের টিসি নিয়ে যেতে বলেন। পরে প্রিন্সিপালের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে শান্তিনগরে বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা অরিত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামলায় তিন জনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ৫ ডিসেম্বর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে ৯ ডিসেম্বর জামিন পান হাসনা হেনা। ১৪ জানুয়ারি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।

২০১৯ সালের ২০ মার্চ নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার। আর শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে অভিযুক্ত করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তার অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এদিকে দুই আসামির বিরুদ্ধে যে ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছে উক্ত ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে।

/এনএইচ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়