ইছামতী: বইটি কেন এখনও প্রাসঙ্গিক
সানিয়া ইসরাত || রাইজিংবিডি.কম
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তার রচিত পথের পাঁচালি ও অপরাজিত বাংলা সাহিত্যের দুই অমূল্য সম্পদ। ‘ইছামতী’ উপন্যাসটিও তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যেই পড়ে।
‘ইছামতী'’ উপন্যাসটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত শেষ উপন্যাস। এ উপন্যাস রচনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে মরনোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করে।
গভীর মমতায়, শ্রমে, দক্ষ, শিল্প কুশলতায়, প্রকৃতি ও জনজীবনের ছবি তিনি এঁকেছেন। ভাষাগত মাধুর্যতা, উপস্থাপন শৈলী ও চারিত্রিক বৈচিত্রতার ব্যাপকতা তার রচনার বিশেষত্ব।
প্রকৃতির লতা পাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই সমহিমায় ওঠে এসেছে বিভূতিভূষণের কথাশিল্পে। তার উপন্যাস পড়ার পর পাঠক এতটাই অভিভূত ও তৃপ্ত হন যে বিভূতিভূষণের বর্ণিত অপরূপ ছবি নিজের চোখে না দেখলেও তা জীবন্ত হয়ে পাঠকের মনের পর্দায় ভেসে থাকে। এখানেই মূলত তার শিল্প সাফল্য।
ইছামতী একটি ছোট নদী। ইছামতীর যে অংশটুকু যশোর ও নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, ঔপন্যাসিক সেই অংশটুকুর রূপবৈচিত্র্য অত্যন্ত নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। ইছামতী নদীর ধারের পুরো গ্রাম নিয়েই মূলত উপন্যাসটি রচিত।
ভারতবর্ষে ইংরেজদের দীর্ঘ দিন শাসন-শোষণের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। নীলচাষ নিয়ে বাংলার দরিদ্র কৃষকের ওপর যে লোমহর্ষক নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে ‘ইছামতী’ উপন্যাসটি গড়েই ওঠেছে সেই সময়ের অত্যাচারের কথা নিয়ে। ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি প্রকাশিত হয়। নীলদর্পণ নাটকেরও মূলবিষয়বস্তু ছিল কৃষকদের ওপর অকথ্য ভাষায় নির্যাতনের ইতিহাস নিয়ে।
ইছামতী নদীর ধারের এক গ্রাম মোল্লাহাটিতে ইংরেজরা তাদের নীলকুঠি স্থাপন করে। সেই কুঠির দায়িত্বে ছিলেন অত্যাচারী ইংরেজ লর্ড শিপ্টন সাহেব। তার নির্দেশেই গ্রামের দরিদ্র কৃষকের ধানী জমিতে নীলচাষের জন্য বাধ্য করা হতো। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে ইংরেজরা তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিত। সহায় সম্বলহীন দরিদ্র কৃষকের দুঃখ দুর্দশার সীমা থাকত না। দীর্ঘ দিন ধরে তারা এই অন্যায় অবিচার দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিল।
একসময় গ্রামে গ্রামে বাংলার সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ে। চারদিকে যখন নীলবিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে, ঠিক সেই সময় ইংরেজরা তাদের নীলকুঠি বিক্রি করে পালিয়ে যায়। সেই নীলকুঠি কিনে নিয়েছিল বাংলার ব্যবসায়ী বণিক সম্প্রদায়। ইংরেজরা নীলকুঠি বিক্রি করে চলে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দরিদ্র কৃষকের দুঃখ দুর্দশার ইতি হয়নি। একের পর এক জমিদার, জোতদার বিভিন্ন শাসকশ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ অর্থ আত্মসাৎ করে ক্রমেই ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়, কিন্তু কৃষকদের অবস্থা একই থাকে। এতকাল পরে এসেও শাসন-শোষণ থেকে রেহাই পায়নি সাধারণ মানুষ।
শুধু পরিবর্তন হয়েছে শোষণ করার পদ্ধতিটুকু। এ দেশের শাসক-শোষক শ্রেণী নিজেদের শোষণ প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জনগণকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তত্ত্বের অবতারণা করে বিভ্রান্ত করেছে। তারা নিজেদের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের অধিপতি হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা করেছে। এভাবেই পর্যায়ক্রমে শোষণ প্রক্রিয়া চলছে ভবিষ্যতেও হয়তো চলবে। এর শেষ কোথায়?
আমরা সবাই সুদিনের অপেক্ষায় আছি, একদিন হয়তো আসবে যেদিন ধনী, গরিবের মাঝে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সবাই একই শ্রেণিভূক্ত হবে। যেখানে আইনের স্বচ্ছতা থাকবে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি দূর হবে। কেউ অন্যায় করলে জনগণ তার সুবিচার পাবে।
পরিশেষে, ইছামতী উপন্যাসটি পড়ে যেকোনো বয়সের পাঠকের হৃদয় জয় করতে পারবে, এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি। তাই প্রত্যেকের একবার হলেও উপন্যাসটি পড়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। কারণ, ইছামতী শুধু একটি উপন্যাস নয়, এটি বাঙালি জাতির নিপীড়নের দলিল, সেই সাথে মুক্তিসংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করেছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ (স্নাতক ২য় বর্ষ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাবি/মাহি
আরো পড়ুন