ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কালরাতে অকুতোভয় পুলিশ সদস্যদের প্রথম প্রতিরোধ

মাকসুদুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ২৫ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১১:২০, ২৫ মার্চ ২০২১
কালরাতে অকুতোভয় পুলিশ সদস্যদের প্রথম প্রতিরোধ

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের তালিকা

২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রথম টার্গেট করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স।  তারা নারকীয় গণহত্যা শুরু করে।  কিন্তু অকুতোভয় পুলিশ সদস্যরা রক্ত দিয়ে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।  যে নির্মম স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে রাজাবাগ।  স্মৃতির স্মারক হিসেবে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’।

মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) সরেজমিন দেখা যায়, জাদুঘরে সেই দিনের যুদ্ধে ব্যবহৃত ওয়ারলেস সেট, ওয়াকিটকি, অস্ত্রশস্ত্র এমনকি শহীদ পুলিশ সদস্যদের রক্তমাখা জামা-কাপড়।  এরই মধ্যে অনেক শহীদের ছবিও স্মৃতির স্মারক হয়ে আছে।

জাদুঘর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ওই দিন স্বাধীনতাকামী সর্বস্তরের বাঙালির মতো পুলিশের মধ্যেও পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি ছিল। নিজেদের মধ্যে তারা এ জন্য তথ্য আদান-প্রদান করতেন।  যা পাঠানো হতো রাজারবাগে। এরই মধ্যে খবর আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বের হচ্ছে।  তখনি সংগঠিত পুলিশ সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন প্রতিরোধের। 

২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তথ্য আসতে থাকে। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর মর্টারের আক্রমণের মুখে পিছু হটে অনেক পুলিশ সদস্য অস্ত্র গোলাবারূদ নিয়ে রাজারবাগ ত্যাগ করেন। শহরের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় পুলিশের পেট্রোল দলকে। তারা বিভিন্ন তথ্য পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেতারের মাধ্যমে রাজারবাগে জানাতে থাকেন। সবশেষ তারা জানতে পারেন পাকিস্তানি সেনারা রাজারবাগে হামলা করবে।  বাঙালি পুলিশ সদস্যরা নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ এবং নিজেদের করণীয় ঠিক করেন। এরই মধ্যে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের টহলরত পুলিশ পেট্রোল সেনাবাহিনীর একটি কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে এগুচ্ছে জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পুলিশের আরেকটি পেট্রোল দল খবর দেয় রমনা পার্কের (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ৭০ থেকে ৮০টি পাকিস্তানি যান পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুলিশের পেট্রোল কারটি ভিন্ন পথে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পৌঁছে এ সংবাদ দেয়। পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। 

রাত সোয়া ১১ টার দিকে সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানগুলো রাজারবাগের আশপাশে এসে অবস্থান নেয়। এ খবর বেতার মারফত পুলিশের সবগুলো মহকুমাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে রাজারবাগের অস্ত্রাগারের ঘণ্টা (পাগলা ঘণ্টা) বেজে ওঠে। বিভিন্ন ব্যারাক ও ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন পুলিশ সদস্যরা। অস্ত্রগারের তালা ভেঙে সবার মাঝে দেওয়া হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এরপর পুলিশ সদস্যরা রাজারবাগের চারদিক, ব্যারাক ও বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়।

পুলিশের নথিতে আরও আছে, এরই মধ্যে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে থেমে থেমে গুলির শব্দ আসতে থাকে। পুলিশ সদস্যরা শত্রুর চূড়ান্ত মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়। পাকসেনাদের কনভয় রাজারবাগ গেটের সামনে এসে পৌঁছায়। পুলিশ কোয়ার্টার সংলগ্ন দিক থেকে প্রথম গুলিবর্ষণ হয়। একই সময় শাহজাহানপুর এলাকা থেকেও গুলির শব্দ আসতে থাকে। ব্যারাকের ছাদে অবস্থান নেওয়া পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। শুরু হয় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। পুলিশের প্রতিরোধে কিছুক্ষণের মধ্যে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী।  

এরপর পাকিস্তানি সেনারা মর্টার ও ভারী মেশিনগান দিয়ে হামলা শুরু করে। ৪টি ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেনারা ট্যাংক বহরসহ ঢুকে যায় প্যারেড গ্রাউন্ডে। পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেন। একটি গ্রুপ অস্ত্র ও গোলাবারূদ নিয়ে মালিবাগ, চামেলীবাগ দিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের অপর একটিদল সমানতালে পাকিস্তানিদের ট্যাংক কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে লড়ে যায়।

প্রায় ৪ ঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধে পুলিশের অর্ধশতাধিক সদস্য শহীদ হন। বন্দি হন প্রায় দেড়শ’ জন।

পুলিশ সেদিন জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছিল উল্লেখ করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘তাদের বুকে ছিল দেশকে স্বাধীন করার স্পৃহা। ওই সময় পুলিশের হাতে বাংলাদেশের পতাকাও দেখা গেছে। আর যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মত্যাগ ভোলার নয়।’

ঢাকা/মাকসুদ/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়