ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘গ্রিন ও টেকসই জ্বালানির খোঁজ করছে বাংলাদেশ’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ৫ আগস্ট ২০২২  
‘গ্রিন ও টেকসই জ্বালানির খোঁজ করছে বাংলাদেশ’

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশ বিকল্প গ্রিন ও টেকসই জ্বালানির খোঁজ করছে বলে জানিয়েছেন সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।

বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) রাতে সিআরআই’র আয়োজনে ‘লেটস টক অন গ্রিন ট্রানজিশন’ অনুষ্ঠানে এ কথা জানান তিনি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানি নয়, আমরা গ্রিন ও টেকসই জ্বালানির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা কেমন হবে, কিভাবে আমরা সেই চাহিদা মেটাবো, তা বোঝার চেষ্টা করছি আমরা। এ বিষয়ে আমাদের সহায়তা করছে জাপান। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সোলার প্যানেল ব্যবহারে সচেতনতা তৈরি করছে।’

‘যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা বাসা-বাড়ি তাদের সোলার প্যানেল ব্যবহার করে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করলে মোট বিদ্যুৎ খরচ ২০ শতাংশ হ্রাস করতে পারে।’

নসরুল হামিদ বলেন, ‘আপনি যে সোলার প্যানেল ব্যবহার করবেন আপনার ভবনে, সেখান থেকে যেই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, তা আমাদের দিয়ে দেবেন। সেটি যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। আপনার মোট বিদ্যুৎ ব্যবহার থেকে সেই পরিমাণ বিদ্যুতের বিল মাইনাস করা হবে। এতে ২০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ বিল বাঁচানো সম্ভব।’

‘দেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেই সোলার প্যানেলগুলো স্থাপিত হয়েছে, তার ৫০ শতাংশ খরচ সরকার দিচ্ছে। বাকি ৫০ শতাংশ আবার ব্যক্তিগত লোন হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে। অর্থাৎ সোলার প্যানেল অতি স্বল্প খরচে ব্যবহার করা সম্ভব।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে আগে যেই নতুন প্রযুক্তি আসতে কয়েক দশক লেগে যেত, এখন কয়েক মাসের মধ্যে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। এ কারণেই আমরাও তা ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, এরপর হাইড্রোজেন প্ল্যান্ট, সামনে হয়ত নতুন আরও কিছু আসবে। সেটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।’

গ্রিন ট্রানজিশনে যাওয়ার দায় শুধু বাংলাদেশের একার নয়, মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম ও খনিজসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, ‘ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র বা উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা যখন উন্নত হচ্ছিলো তখন কার্বন নিঃসরণ সর্বোচ্চ ছিল। তারা যত উন্নত হয়েছে, কার্বন নিঃসরণের গ্রাফ নিম্নগামী হয়েছে। অর্থাৎ উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের ঋণাত্মক একটি বিষয় রয়েছে। কিন্তু, তারা এখন আমাদের কার্বন নিঃসরণের জন্য চাপ দিচ্ছে। এই দায়িত্ব কি আমাদের একার? মোটেও নয়।’

কার্বণ নিঃসরণ কমানোর জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তার ব্যয় অনেক, জানিয়ে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা কি না খেয়ে থেকে গ্রিন ট্রানজিশনে যাব? মোটেও নয়। এই দায় তাদেরও। তাই বলে কি উন্নত হতে গিয়ে আমরাও তাদের মতোই কার্বন নিঃসরণ করব? সেটিও নয়। আসলে তাদের কথা ছিল, এসব উন্নত প্রযুক্তি ও সহায়তা আমাদের দেবে। কিন্তু তারা সেটি করছে না। এর দায় তাদেরও।’

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকটের ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। এক্ষেত্রে আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিল কি না? এমন এক প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, ‘বলতে পারেন এখন যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ৫ বছর আগে নিলে আমাদের বর্তমান গ্যাস সংকট থাকত না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তখনো বৈশ্বিক এই সংকটের প্রভাব পড়ত। তবে সরকার যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করেছে, তার ফলাফল ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে।’

সরকার এলএনজি আমদানি বেশি দামে করায় জ্বালানি খাতে সংকট তৈরি হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য মিক্সড সোর্স খুবই জরুরি। এ কারণেই এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। আপনার হাতে যত বেশি অপশন থাকবে, সিদ্ধান্ত নেওয়া তত সহজ হবে।’

মিক্সড জ্বালানির প্রসঙ্গ তুলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধের পর জার্মানি তার ২৫ শতাংশ গ্যাস বিতরণ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। বিকল্প জ্বালানি খুঁজছে সবাই। বিশেষত সামনের শীতের জন্য। একই অবস্থা যুক্তরাজ্যের। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ১২-১৩ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকত। সাময়িক সমস্যার জন্য এখন কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। অর্থাৎ প্রাথমিক ধকল সামলে উঠেছি আমরা। ২০০৯ সালে আমরা স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি বিদ্যুৎ খাত নিয়ে। সম্প্রতি জাপানের সহায়তায় আমরা আরেকটি পরিকল্পনা করছি।’

কার্বন নিঃসরণ ও দূষণ হ্রাসে ইলেকট্রিক যানবাহন
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশও গ্রিন সাসটেইনেবল এনার্জি ব্যবহার করতে চায়। এ ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয় ইলেকট্রিক যানবাহন বা ই-ভেহিকেল।

এ বিষয়ে নসরুল হামিদ বলেন, ‘এরই মধ্যে ই-ভেহিকেলের জন্য চার্জিং স্টেশন স্থাপনের কাজ করছি আমরা। এটি দুর্দান্ত একটি বিষয় হবে। আপনি যে পথ পাড়ি দিতে ৮০ টাকা খরচ করতেন, সেই পথ পাড়ি দিতে ১০ টাকা খরচ হবে।’

ই-ভেহিকেল নিয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করছে বলে জানান তিনি।

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সবয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত পাবলিক পরিবহনগুলোকে। বিশেষত বাস, ট্রেন এবং কারগুলো যেন ইলেক্ট্রনিক হয়। একবার ভেবে দেখুন, কী পরিমাণে সাশ্রয় হবে।’

দূষণ হ্রাসের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করলে তার বর্জ্যের কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসতে হাসতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, ‘দেখুন, পরমাণু কেন্দ্রের জ্বালানি যারা সরবরাহ করবেন, তারাই বর্জ্য নিয়ে যাবেন। এমনভাবেই চুক্তিটি হয়। সুতরাং, এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’

এ সময় নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেজ এমাউন্ট যেন গ্রিননির্ভর হয়, সেই চেষ্টা করছি আমরা। বর্তমানে আমাদের বেজ ১২ হাজার মেগাওয়াট। ধীরে ধীরে এটি আরও বাড়ানো হবে।’

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য ৯ আগস্ট একটি বড় দিন বলেও মন্তব্য করেন নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালে দেশের পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র ব্রিটিশ সেল কোম্পানির কাছে ছিল। তখন বঙ্গবন্ধু এই গ্যাস ক্ষেত্রগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন। প্রায় ৪ বিলিয়ন পাউন্ড অর্থ ব্যয়ে সেটি সম্পন্ন করেন তিনি। তার এই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে ৪০০ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি সহায়তা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।’

১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানে উল্লেখ আছে, শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে এভাবে বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার কথা বলা নেই।’

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়েশা খান, ইয়ুথ এনভারমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভলোপমেন্ট সোসাইটির ( ওয়াইইএসডিএ)- প্রেসিডেন্ট রেবেকা সুলতানা এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) উপাচার্য অধ্যাপক তানভীর হাসান।

তরুণরা যাতে দেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে পারেন এবং নিজেদের ভাবনা ও সমস্যাগুলোর কথা নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছাতে পারেন, সেজন্য সিআরআই ২০১৪ সাল থেকে নিয়মিত আয়োজন করে আসছে ‘লেটস টক’। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদকে নিয়ে এর আগে বেশ কয়েকবার ‘লেটস টক’ আয়োজন করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে আয়োজন করা হল ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা’।

পারভেজ/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়