ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক

ইসরাত জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১০, ২১ জুন ২০২১  
গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক

ফার্মেসি শুধু একটি শব্দ নয়, এটি স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা। এ বিষয়টি মূলত রসায়নের সাথে জীববিজ্ঞানের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। অন্যথায় ফার্মেসি বিষয়ে পড়াশোনাকে ওষুধ নিয়ে পড়াশোনাও বলা হয়। ফার্মাসিস্ট বলতে যারা ওষুধ তৈরি এবং তা কিভাবে সংরক্ষণ করা উচিত, কিভাবে ব্যবহার করা উচিত তা নিশ্চিত করে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসাগত প্রয়োগ নিশ্চিত করে সর্বদিকে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাদের বোঝায়। 

একজন শিক্ষার্থী যখন বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা করেন, তখন তাকে এসব বিষয়ে গভীর ভাবে মনোযোগ সহকারে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। ফার্মেসি স্নাতক শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ‘Study in pharmacy and fly to America’ এমন একটি স্লোগান নিয়ে এই ফার্মেসি স্নাতক এর যাত্রা শুরু। ধীরে ধীরে প্রতিটি পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টিকে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং অনেক স্টুডেন্ট এখনো অধ্যায়নরত এবং প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এখনো মানুষ মনে করে ফার্মেসি মানে একটি ঔষধ দোকান নিয়ে বসা এবং সেখানে বসে ওষুধ বিক্রি করা। বাংলাদেশে তিন ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট আছে। ‘A’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট তারা, যারা ফার্মেসির উপর বি.ফার্ম ও এম.ফার্ম করেছে। তারা চার বছর যাবৎ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি কিভাবে করতে হয় এসব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন। এদের মূলত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বলা হয়। 

একটি ওষুধ তৈরিতে কোন কোন উপাদান কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কতটুকু ব্যবহার করতে হয়, সে ওষুধ কোন রোগের ক্ষেত্রে কিভাবে প্রয়োগ করলে রোগ নির্মূল হয়ে যায়, সে বিষয় নিয়ে মূলত তারা পড়াশোনা করেন। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা মূলত এইচএসসি পাসের পর এই ক্যাটাগরিতে ভর্তি হতে পারেন। এই ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টদের "Pharmacy Council of Bangladesh" থেকে A-গ্রেড ফার্মাসিস্ট রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয়ে থাকে, এই রেজিস্ট্রেশন নম্বর শুধু পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে দরকার হয় তা নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে এটি বিশেষ অবদান রাখে। এরা তাদের B-Pharm ও M-Pharm ক্লাস থেকে ফার্মাকোলজিক্যাল, টক্সিকোলোজিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি, বায়োফার্মাসিটিক্স সমৃদ্ধ জ্ঞান অর্জন করে এবং পরবর্তী সময়ে ইন্টার্নির মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে রোগীর স্বাস্থ্যসেবায় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। 

রোগীর ওষুধবিষয়ক জিজ্ঞাসা যেমন, ডোজ বা মাত্রা, মাত্রার সমন্বয়, ওষুধ সেবনের নিয়মাবলি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ ওষুধের যাবতীয় নির্দেশনাবলি রোগীকে দিয়ে থাকেন। ‘A’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টের পরেই ‘B’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টের স্থান। এই ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট তারা যারা ফার্মেসির উপর তিন বছর ডিপ্লোমা করেন। এটির অন্য নাম “Diploma in Pharmacy Course”। ‘B’ ক্যাটাগরি ফার্মাসিস্টের পরেই ‘C’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টের স্থান। এই ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট তারা যারা মূলত ছয় মাসের জন্য ফার্মেসি কোর্স করেন। যেকোনো ধরনের ওষুধের দোকান পরিচালনার জন্য মূলত এই কোর্স করা আবশ্যক। 

প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস পালন করা হয়। International Pharmaceutical Federation (FIP) এর উদ্যোগে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত তুরস্কের ইস্তাম্বুলের একটি সম্মেলনে এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর।


বর্তমান বাংলাদেশে ওষুধ  শিল্প একটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো ওষুধ উৎপাদন হয়। যা দেশের অভ্যন্তরে ৯৮ শতাংশ ওষুধ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এই শিল্পের এত উন্নতিতে সবচেয়ে বড় অবদান ফার্মাসিস্টদের। একমাত্র ফার্মাসিস্টরাই পারে একটি দেশের ওষুধ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ নামক শব্দটা নিয়ে আসতে। এই ওষুধ শিল্পে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে A-গ্রেড ফার্মাসিস্ট। উন্নত বিশ্বের সাথে যদি আমরা বাংলাদেশের A-গ্রেড ফার্মাসিস্টদেট অবস্থান তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, সেই সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এদের অবস্থান খুবই নগণ্য। 

উন্নত বিশ্বে A-গ্রেড ফার্মাসিস্টরা এমবিবিএস ডাক্তারের পাশাপাশি রোগীর স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ওষুধ সম্পর্কিত উপদেশ ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে এসব ক্ষেত্রে A-গ্রেড ফার্মাসিস্টদের খুব কমই লক্ষ করা যায়। এদেশে A-গ্রেড ফার্মাসিস্টদের বেশিরভাগই লক্ষ করা যায় ওষুধ ফ্যাক্টরিতে কর্মরত অবস্থায়। 

এই করোনা মহামরিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় অনেক বড় অবদান রেখেছে। এ মহামারিতে যখন প্রতিটি মানুষ নিজের ঘরে অবস্থান করছেন নিজেকে সুরক্ষার কথা এবং নিজের পরিবারকে সুরক্ষার কথা চিন্তা করে, সেখানে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ক্ষেত্রে অন্যরকম চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা নিজেদের কথা চিন্তা না করে, নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে শুধু দেশের মানুষের কথা ভেবে এ করোনা মহামারিকে প্রতিহত করার জন্য মুখে মাক্স বেঁধে ছুটে গিয়েছেন ওষুধ ফ্যাক্টরিগুলোতে ওষুধ তৈরি করতে। 

যখনই এই অদৃশ্য শক্তি একের পর এক দেশকে গ্রাস করে লাখ লাখ মানুষের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে করোনা রোগীর চিকিৎসায় নতুন ওষুধের কথা বলা হচ্ছে। এসময়ে আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছিল এবং এখনো করে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, যেন দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ এই মহামারি থেকে রক্ষা পায়, যেন তারা প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো নিতে পারে।

বাংলাদেশে ‘A’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টদের চাকরি ক্ষেত্রে তেমন একটা সুবিধা না থাকায় তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করা। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদের অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এভাবে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর ফলে শুধু যে মেধা পাচার হচ্ছে তা নয় বরং বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বর্তমানে যে অবস্থানে রয়েছে, সে অবস্থান থেকে অনেক ভালো অবস্থানে যাওয়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে, সে সম্ভাবনাটা বাস্তবায়ন না হয়ে বরং শুধু সম্ভাবনায় থেকে যাওয়ার অবস্থা দেখা দিতে পারে। 

‘A’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টদের উপর যদি আরও ভালোভাবে নজর দেওয়া হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই শিল্পে আরও ভালো অবস্থানে যেতে পারবে। বাংলাদেশের কমবেশি প্রত্যেকটি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের উদ্দেশ্য থাকে যেন তারা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেন, যেন বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারেন এবং তার পাশাপাশি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারেন। তাদের এই উদ্দেশ্য সফল হওয়া তখনই সম্ভব, যখন তাদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে। 

ওষুধ শিল্পের সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে এবং দেশের মেধা যাতে বাইরের দেশে পাচার না হয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ রেখে সরকারকে অবশ্যই গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের দেশে শুধু বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালে ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ বা ‘ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট’ দেখা যায়। শুধু বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল নয় বরং দেশের প্রত্যেকটি হাসপাতালে যেন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা অবস্থান করেন স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য এবং নিশ্চিত করতে পারেন, সরকারের সে দিকেও নজর দিতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ।

চট্টগ্রাম/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়