ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিলুপ্তপ্রায় টাঙ্গাইলের বিখ্যাত লৌহজাত শিল্প

হাসান সরকার ছালেহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৫, ২০ জুন ২০২১  
বিলুপ্তপ্রায় টাঙ্গাইলের বিখ্যাত লৌহজাত শিল্প

গৃহস্থালি ও কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের লৌহজাত পণ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল  টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার পাকুটিয়া এলাকা। পাওয়ার টিলার অর্থাৎ ট্রাক্টরের ফাল আবিষ্কার করে এক সময় শুধু দেশে নয় সারা বিশ্বে হই চই ফেলে দিয়েছিল এই অঞ্চলের কামারেরা। বর্তমান বিশ্বে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নানা রকম আবিস্কার হওয়ার কারনে, এই শিল্পিরা আজ কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

কর্মকার এক শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়। যদিও এখন তারা ভিন্ন পেশায় জড়িত। পূর্বে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাটি, লোহা,পিতল ও কাসার কাজ করত। যারা মাটি দিয়ে বিভিন্ন রকম পণ্য যেমনঃ হাড়ি,পাতিল,কলসি,ফুলের টব,মাটির ব্যাংকসহ বাচ্চাদের খেলনা,পুতুল,ঘুটি ঘটি,ঘোড়া বাঘ ও গরুর গাড়ি এগুলো বানানোর কাজ করেন তাদের কুমার বলা হয়। যারা স্বর্নের কাজ তথা,নানা রকম অলংকার বানানোর কাজ করেন তাদের স্বর্নকার বলে। আর যারা লোহার নানা রকম নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বানানোর কাজ করেন তাদের কামার বলা হয়। আজ বলব এই কামারদের কাজ বা তাঁদের শিল্প নিয়ে।

অতীতে কৃষিকাজ শুরু হওয়ার সঙ্গেই দেশে কামার পেশার উৎপত্তি ঘটে। প্রচলিত লোক কাহিনি মতে,শূদ্র মহিলার সঙ্গে দেবশিল্পি বিশ্বকর্মার প্রণয় থেকে কামারের জন্ম হয়। কামারদের মধ্যেও আবার কয়েকটি শ্রেনী রয়েছে। বিয়ে করার ক্ষেত্রে এখনো তারা সেই স্বশ্রেণী বেছে নেয়। বসুন্দরি,রানা,গঙ্গালিরি এবং বাহাল ইত্যাদি। এই চার শ্রেণীরও আবার বিভিন্ন স্তর বা শ্রেণী আছে।

যাই হোক আমরা এসবের খুব গভিরে না গিয়ে কামারদের তৈরি জিনিসপত্র গুলো দেখে নেই। দা,বটি,ছুরি,কাস্তে,শাবল খুন্তি,কুড়াল,হাতুর,লাংগল,ট্রাক্টরের ফাল,শিকল, পেরেক, চাপাতি কোদাল,লোহার কড়াই সহ যাবতিয় নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক রকম লোহার যন্ত্রপাতি তাদেরই তৈরি ।

পাকুটিয়া এলাকা ঘুরে জানা যায়, এই এলাকায় প্রায় ২৫০ টি পরিবার লোহার কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু প্রযুক্তিগত যন্ত্রের কাছে তাদের হস্তশিল্প হার মেনে যাওয়াই, এখন মাত্র ৪০-৫০টি পরিবার এই পেশাতে যুক্ত আছেন। বাকিরা একেক জন একেক পেশায় জড়িয়ে গেছেন।

ভিন্ন পেশায় যুক্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, আসলে লৌহজাত পেশায় প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় । কিন্তু এতেকরে তাদের কোন সমস্যাও ছিল না। কেননা পৈতৃক সূত্রেই তাদের এই কাজে অনেক টান ছিল। কিন্তু ন্যায্য মুজুরি বা পারিশ্রমিক পেলে এই কাজ ধরে রাখা সহজ হত। বর্তমানে তাদের বাইরেও অনেক জাতের মানুষ এই পেশাতে এসে, সস্তায় নিম্ন মানের পণ্য বিক্রি করায় তার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ ভালো-মন্দ তা বিচার না করে কম দামের জিনিসের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। এরফলে  ভালো মানের জিনিসের দামও অনেক কমে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন প্রকৃত কামারেরা।

এছাড়াও তাদের সন্তানরাসহ সমাজের চোখে এই পেশা নিম্নমানের বলে ধারনা করা হয়। এজন্য কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তাদের পছন্দমত পেশার দিকে অনুপ্রাণিত করছেন। কারণ অতীত ধরে বসে থাকলে তাদের সংসার আর চলবেনা। এখন হাতে বানানো লোহার এসব পণ্যের মূল্য কম। তাছাড়া নাম ও মান কোন কিছুই নেই। তাই এসবের প্রতি যে দরদ ভালবাসা ছিল তা দিন দিন কমেই যাচ্ছে। তারপরেও যারা একটু নিম্নবিত্তের তাদের অন্য কোন উপায় না থাকায় এই কাজ করেই জিবিকা নির্বাহ করছেন।

সারদিন কাজ করে খুব অল্প আয়ে জীবন চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন তারা। আয়ের ব্যপারে হয় জানতে চাইলে তারা বলেন, “সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৫/৬ টা পর্যন্ত কাজ করলে ৩৫০-৫০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু সমস্যা হলো মাসের প্রতিদিন আমরা একই রকম কাজ পাইনা। দেখা যায় কোন মাসে ১০/১৫ দিন ও বসে থাকতে হয়”।

পাকুটিয়ার সবচেয়ে নামকরা কামারের বংশধর অতুল কর্মকারকে এই শিল্পের ধ্বংসের কারন জানতে চাইলে তিনিও একই রকম মত প্রকাশ করেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে অন্য পেশায় আছেন। তিনি এখনো তার পেশা কোন রকমে একাই ধরে রেখেছেন।

অতুল কর্মকার আরও বলেন, “আসলে এই কাজ একা করা সম্ভব নয়। কমপক্ষে দুজন প্রয়োজন এই পেশাকে সচল রাখতে। একটা কারিগর রাখলে তার পারিশ্রমিক দিতে হয় ৫০০/৬০০ টাকা। তবুও কাজ করে সকাল ৮-থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। দুই জনে কাজ করলে মোটামুটি ১০০০/১৫০০ টাকার কাজ করা যায়। কিন্তু সবসময় শ্রমিক পাওয়া যায়না। আবার শ্রমিক পেলেও তেমন কাজ পাওয়া যায়না। তাই আমি নিজেই টুকটাক যা পারি করি।“

অতুল কর্মকারের নাতির সাথে কথা বলে তার কাছে জানতে চাই এই পেশাকে তিনি ধরে রাখবেন কিনা?

উত্তরে তার নাতি বলেন,”আসলে আমার দাদু এই কাজ করে এটাই আমরা চাইনা। দেখতেও ভালো দেখায় না। আমার বন্ধুদের বাপ চাচারা চাকরি করেন। আর আমরা এসব করি বললে সমাজও নিচু চোখে দেখেতাই এটাতে আগ্রহ নেই’।

অতুল কর্মকারের নাতি শিক্ষিত হওয়াই তাকে জিগ্যেস করি, লৌহজাত এমন পণ্যকে ই-কমার্সের আওতায় নিয়ে আসলে এই শিল্প নিয়ে কিছু করা যায় কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে বর্তমান যুগে আবার খাঁটি পণ্যের টান বাড়ায় এটা হয়ত সম্ভব। কিন্তু তার জন্য বেশ পুঁজি ,উন্নতমানের যন্ত্রপাতির ব্যাবহার ও ৪/৫ জন লোক নিয়ে কাজ করালে ভালো একটা প্রডাকশন বের করা সম্ভব। এই পুঁজিটা আমায় কে দেবে বলেন?’

অবশেষে আমরা যা বুঝতে পারলাম দেশ ডিজিটাল হয়েছে হয়ত। কিন্তু আমাদের সমাজ ও সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনা ডিজিটাল না হওয়ায় এবং কোন সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের আরও সচেতন ও ভাল মন্দের তফাত গুলো আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে কোন কাজই ছোট নয়। এই বিষয় গুলো নিয়ে তাদের বুঝাতে হবে এবং বিভিন্ন ভাবে তাদের ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাবস্থা করতে হবে। তাহলে হয়ত এই ঐতিহ্যবাহী পেশা বা শিল্পকে উদ্ধার করা যেতে পারে।

লেখক : স্বত্বাধীকারি, অকৃত্রিম অ্যান্ড আওয়ার টাঙ্গং এবং জেলা সহ প্রতিনিধি টাঙ্গাইল,উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম)

টাঙ্গাইল/নহরে জান্নাত/সিনথিয়া

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়