ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সংবাদপত্র হকার খুকির দায়িত্ব নিলো রাজশাহী জেলা প্রশাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:০১, ১৩ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ০১:২১, ১৩ নভেম্বর ২০২০
সংবাদপত্র হকার খুকির দায়িত্ব নিলো রাজশাহী জেলা প্রশাসন

দিল আফরোজ খুকি। রাজশাহী মহানগরীর একমাত্র নারী সংবাদপত্র বিক্রেতা। বয়স প্রায় ৬০ বছরের কাছাকাছি। দিনভর পরিশ্রম করলেও অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুকির জীবন সংগ্রামের বিষয়টি প্রকাশ পবার পর তার পাশে দাঁড়িয়েছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন। খুকির সংগ্রামী জীবনের বিষয়টি জেনে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিলের হৃদয় নাড়া দিয়েছে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ এহসান উদ্দীন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খুকির বিষয়টি প্রথম জানতে পারেন। এরপর তিনি মঙ্গলবার সকালে খুকির বাড়ি যান। নেন তার খোঁজ-খবর। বিষয়টি সম্পর্কে জেলা প্রশাসককে অবহিত করেন।

এছাড়াও খুকি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তার কষ্টের কথা বলেছেন। জানিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের মানুষ তাকে নির্যাতন করেন। বিভিন্ন স্থানে নিগৃহীত হন তিনি। অনেকেই পত্রিকা বিক্রির টাকা কেড়ে নেয়। কেড়ে নেয় তার কাছে থাকা সংবাদপত্রও। তিনি প্রতিবাদ করেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পান না। তারপরও তিনি মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে পত্রিকা বিক্রি করেন। পেটের দায়েই তাকে পত্রিকা বিক্রি করতে হয়। পত্রিকা বিক্রি করতে না পারলে জীবন-জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়াও তিনি জানিয়েছেন মৃত্যুর পর জন্ম শহর কুষ্টিয়ায় তার দাফনের বিষয়টি।

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ১১ বছর পূর্বের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এ ভিডিওটি প্রকাশের পর দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ খুকির সম্পর্কে জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে দেশ টিভির এক সাক্ষাৎকারে খুকি তার জীবন সংগ্রামের কিছু অংশ প্রকাশ করেন।

জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীতে গত ৪০ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন খুকি। ঘুম থেকে সকাল ৬টায় উঠেই তিনি পত্রিকার এজেন্ট ও স্থানীয় পত্রিকার সার্কুলেশন ম্যানেজারদের কাছে যান। এরপর তাদের কাছ থেকে পত্রিকা নেন। পত্রিকা নিয়ে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় পায়ে হেঁটে বিক্রি শুরু করেন। শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি দেখে খুকি সম্পর্কে অন্যদের মত আগ্রহী হয়ে উঠেন পবার সহকারী কমিশনার শেখ এহসান উদ্দীন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকালে আমি খুকির বাড়িতে যাই। সেখানে দেখি বাড়িটি বসবাসের উপযোগী নয়। এছাড়াও তার খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। হোটেলে গেলেও তাকে খাবার দেওয়া হয় না। তবে একজন প্রতিবেশি টাকা কিংবা বাজার করে দিলে তিন বেলা রান্না করে খাওয়াবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি সে ব্যবস্থা করেছি। জেনেছি খুকিকে পাগল ভেবে অনেকে মারধর করেন। আমরা এ বিষয়টি খেয়াল রাখবো। কেউ যেন তাকে নির্যাতন করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ দৃষ্টি থাকবে।

বুধবার সকালে খুকি বলেন, কিশোরী বয়সে এক বৃদ্ধের সাথে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু সে সংসারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র এক মাস। এরপর ঢাকায় আবারও বিয়ে হয়। কিন্তু সে স্বামী মারা যান। এরপর থেকে আমি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ি। আমি নিঃসন্তান। ১২ ভাইবোনের কেউ-ই আমার দায়িত্ব নেয়নি। পৈত্রিক ভিটাতে সামান্য জায়গায় দুটি ঘর বানিয়ে বসবাস করছি। জীবন চালাতে বেছে নিয়েছি পত্রিকা বিক্রি। এরপর থেকেই পত্রিকা বিক্রির মাধ্যমেই চলছে আমার জীবন। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ মাথায় নিয়ে রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে পত্রিকা ফেরি করি। অনেকেই আমার কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেয়। বিভিন্নভাবে হয়রানি করে। করে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

এদিকে খুকির বাড়ি পরিদর্শনের সময় সহকারি কমিশনার শেখ এহসান উদ্দীনের উপস্থিতিতে খুকি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, আমার বাবা ছিলেন রাজশাহী জেলা আনসার অ্যাডজুটেন্ট। আর মা ছিলেন সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষিকা। অল্প বয়সে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সবাই আমাকে ঠকিয়েছে। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। আর অল্প বয়সে স্বামী মারা যাওয়ায় বিধবা হয়েছি। সংসার না থাকায় একাই সংগ্রাম শুরু করেছি। বেঁচে থাকার এ সংগ্রাম এখনও চলছে।

তিনি বলেন, খবরের কাগজ বিক্রি করে প্রতিদিন তিনশ’ টাকা আয় করি। নিজের জন্য ব্যয় করি ৪০ টাকা। আর হজে যাবার জন ১০০ টাকা ব্যাংকে জমা করি। বাকি ১৬০ টাকার মধ্যে ১০০ টাকা এতিমখানায়, ৫০ টাকা মসজিদ-মন্দিরে এবং ১০ টাকা ফকির মিসকিনের মাঝে বিতরণ করি। এত দিনে ব্যাংকে জমা হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। সেই জমানো অর্থ আর পৈতৃকভাবে পাওয়া কিছু সম্পত্তিই আমার জীবনের শেষ সম্বল। পৈত্রিকভাবে পাওয়া জমিটি কোনো স্কুলের নামে দান করতে চাই। সেই দানের টাকা থেকে গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে বৃত্তি। আর আমার মৃত্যুর পর চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চাই জন্ম শহর কুষ্টিয়ায়।

খুকির বাড়ি পরিদর্শনের পর শেখ এহসান উদ্দীন বিষয়টি রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিলকে অবহিত করেন। এরপর বুধবার রাতে জেলা প্রশাসক খুকির বাড়ি যান। এসময় তিনি খুকির সংগ্রামী জীবনের কথা মনোযোগের সাথে শোনেন। এসময় খুকির সংগ্রামী জীবনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা জেলা প্রশাসকের মন ছুঁয়ে যায়। 

খুকির বাড়ি পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সবকিছু শোনার পরেই আমি তার বাড়িতে এসেছি। তার বাড়ির অবস্থা ভালো না। টিন দিয়ে পানি পড়ে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের থেকে তার বাড়িটি বসবাসের জন্য উপযোগী করে তোলা হবে। খুকিরও তেমন কোনো চাহিদা নেই। তবে তার তিনবেলা খাওয়ার জন্য প্রতিমাসে যে খরচ হবে সেটির দায়িত্বও আমরা নেবো। সহকারী কমিশনার শেখ এহসান উদ্দীন এটি তদারকি করবেন। এছাড়া যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খুকিকে সহযোগিতা করতে পারেন। সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিরা এগিয়ে আসলে হয়তো শেষ বয়সে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবনটি উপভোগ করতে পারবেন।

তানজিমুল/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়