ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হিরনের স্বপ্ন বুননের গল্প

অরিন্দম মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:১৪, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
হিরনের স্বপ্ন বুননের গল্প

নওগাঁ এক নিভৃত পল্লী গ্রাম দেউলবাড়ী। এখানকার সিংঘভাগ মানুষের থাকার ঘর মাটি দিয়ে তৈরি। এমন এক মাটির ঘরের সামনে কিছু কাঁচা পাকা বাঁশ রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে।

তার পেছনে রয়েছে ভাঙা এক মাটির ঘর। সেই ঘরে থাকা টেবিলে থরে থরে সাজানো রয়েছে হরেক রকমের ল্যাম্প, শো-পিস, পানির বোতল, মগ, জগ, ফ্লাগ, অ‌্যাশট্রে, ডেস্ক কলমদানিসহ আরো অনেক ধরনের শোপিস ও তৈজসপত্র। এই জিনিসগুলো বাঁশ দিয়ে তৈরি। পরম মমতায় এসব তৈরি করেছেন দেউলবাড়ী গ্রামের তরুণ উদ‌্যোক্তা হিরন আহমেদ।

হিরন আহমেদের বাড়ি জেলার ধামইরহাটের রাঙামাটির আলমপুর গ্রামে। এখানেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। বিভিন্ন কারণে ডিগ্রি পাস করা হয়ে ওঠেনি তার। এর মধ‌্যে ২০১৮ সালে তার বাবা মারা যান। এরপর মা-বোনসহ সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এতে দমে যাননি হিরন। বরং নিজের মেধা আর স্বকীয়তাকে কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। উদ‌্যমী হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাঁশ দিয়ে তৈরি করছেন পরিবেশবান্ধব এসব জিনিস। যা এর মধ‌্যেই এলাকায় ব‌্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।

এ বিষয়ে হিরন জানান, বাঁশ দিয়ে এসব জিনিস তৈরিতে বেশ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরন করতে হয়। প্রথমে বাঁশ কেটে তা ট্রিটমেন্টের জন্য তিন ধাপে রাসায়নিক উপকরণ দিয়ে তিনদিন ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর সেগুলো ৬০ শতাংশ রোদ্রে শুকানো হয়। এতে বাঁশ টেকসই হয়। তারপর সেগুলোর উপর গ্রাফিক্সের কাজ করা হয়। এরপর তা বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত হয়।

নিজেকে মুক্তচিন্তার মানুষ দাবি করে হিরন আহমেদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মনে হতো, আমার এমন কিছু একটা করা উচিত যা মানুষের মাঝে সাড়া ফেলবে। শৈশবের এই ভাবনা থেকেই আমার এই কাজ। এটি আমার নেশাও বলতে পারেন। ২৫ হাজার টাকা নিয়ে কাজ শুরু করি। বর্তমানে এর পেছনে প্রায় এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। সব মিলিয়ে ভাল সাড়া পাচ্ছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘কাজটা এতো সহজ ছিল না। ২০১৪ সালে প্রথম অনলাইন সপ থেকে মেশিন কিনি। এরপর গুগল থেকে ডিজাইন নিয়ে গ্রাফিক্সের কাজ করি। বিভিন্ন ডিজাইনের গ্রাফিক্সের ডিস্ক কিনে ইচ্ছেমত ডিজাইন তৈরি করে অনলাইনে বিভিন্ন উদ্যোক্তা গ্রুপের সঙ্গে সংযুক্ত হই। মূলত অনলাইনের ক্রেতা থেকে ভাল সাড়া পাচ্ছি। এছাড়াও আমার ‘বাঁশ বিলাস’ নামে একটা ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে ঢাকা-বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার পাই। কুরিয়ারের মাধ্যমে আমি এসব স্থানে অর্ডার করা মালামাল বিক্রয় করি।’

ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে তৈরি এসব শো-পিসের মূল্য খুব একটা বেশি নয় উল্লেখ করে হিরন জানান, প্রকারভেদে ল্যাম্পের মূল্য- ৮৫০-১৭০০ টাকা, শোপিস ১৫০-৩০০ টাকা, পানির বোতল ৩৫০-৮৫০, মগ ২৫০-৪০০, জগ ৫০০-১০০০ টাকা, ডেস্ক কলমদানিসহ ফ্লাগ ৮৫০-১৫০০ ও অ‌্যাশট্রে ১২০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।

দেশে শিক্ষিত বেকার যুবকদের বিষয়ে তরুণ এই উদ‌্যোক্তা জানান, দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের মাঝে ছোট কাজের প্রতি বেশ অনীহা দেখি। এতে তারা শুধু বেকারই থাকছেন না দেশের বোঝাও হচ্ছেন। এজন‌্য ছোট-বড় বিবেচনা না করে কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায়। এক্ষেত্রে বাঁশের জিনিসপত্র তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন।

এদিকে, হিরনের এই প্রতিভা সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে দেখে কল্লোল গ্রুপ অব কোম্পানির নির্বাহী দাউদ আল রাফি শুভ জানান, এইসব পরিবেশবান্ধব পণ‌্যের বেশ কর্পোরেট ভ‌্যালু রয়েছে। পণ‌্যটিকে যদি ভালভাবে বাজাতজাত করা যায়, তাহলে দেশে তো বটেই বিদেশের মার্কেটও দখল করা যেতে পারে।

বাঁশের তৈরি দৃষ্টিনন্দন পণ‌্য সম্পর্কে ধামইরহাট এমএম ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. শহিদুল ইসলাম জানান, বাঁশের তৈরি এই পণ‌্যগুলো শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, এগুলো পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ‌্যের জন‌্য উপকারী। ভাল ব্রান্ডিং করতে পারলে এই পণ‌্য শুধু ধামইরহাট আর নওগাঁ জেলা না সমগ্র দেশে ভাল পরিচিতি পাবে।

এছাড়া, উদ‌্যমী হিরনের এই প্রতিভা দেখে এলাকার বেকার যুবকরা অনুপ্রেরণা পাবে বলে আশা রাখি।  এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বেকাররা সাবলম্বী হতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

দুরন্ত ও স্বপ্নবাজ হিরন আহমেদ তার এই শিল্পের প্রসার ঘটাতে চান। পাশাপাশি এলাকার তরুণদের নিয়ে এ শিল্পকে আরো বিস্তৃত করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। তার প্রত‌্যাশা এলাকা ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই পণ‌্যগুলো বিদেশের বাজার দখল করবে। সরকারি প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা পেলে একাজে আরও একনিষ্ট হবেন বলেও জানান হিরন।

ধামইরহাট (নওগাঁ)/বুলাকী

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়