ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

২৫ মার্চ ছিল বাঙালির অগ্নিপরীক্ষা

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৪, ২৫ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৪:৩১, ২৫ মার্চ ২০২১
২৫ মার্চ ছিল বাঙালির অগ্নিপরীক্ষা

৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক আর্মি নিরীহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির উপর ট্যাঙ্ক, কামান নিয়ে অভিযানে নামে। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। ইতিহাসের জঘন্যতম, এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল (অব:) খাদেম হোসেন রাজা। সেদিন রাতের অভিযানকে আমরা ‘কালরাত্রি’ বললেও, আমার মনে হয়- শুধু একটি শব্দ দিয়ে এর ভয়াবহতা অনুধাবন করা যায় না।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সমগ্র জাতি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। দেশে কোনো অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ছিল না। মানবহিতৈষী বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু ভাবনা ছিল গরিব-দুঃখী মানুষকে নিয়ে। যে কারণে তাদের কষ্ট হয় তেমন কোনো কর্মসূচি তিনি দিতেন না বা দিলেও বিষয়টি তিনি ভাবনায় রাখতেন। এটি তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ লক্ষ্য করলেও বোঝা যায়। যে কারণে তিনি প্রতিবাদ অব্যাহত রেখে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এদিকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক তথা প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া দলবল নিয়ে ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। এই আলোচনা সেই পর্যায়ে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রয়োজনীয়। কেননা সামরিক আইনের অধীনে Legal Frame Work order এ বলা হয়েছে, নির্বাচনের পর জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে এবং ১২০ দিনের ভেতর সংবিধান প্রণয়ন করবে। তা যদি না হয়, তাহলে পরিষদ ভেঙে দেওয়া হবে। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনের পর জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে, তখন আলাপ-আলোচনা হবে। কিন্তু পাকিস্তানের পশ্চিম অঞ্চলের নেতা বাহানা ধরলেন অধিবেশনের বাইরে প্রাক-অধিবেশন আলোচনার।

বঙ্গবন্ধু সেদিন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আলোচনায় রাজী হলেন। কিন্তু আলোচনার মাঝপথে; যথন আলোচনা মনঃপুত হচ্ছে না, তখন দেশের প্রেসিডেন্ট কি ব্যবস্থা নিতে চান বা পদক্ষেপ নিতে চান, তা না জানিয়ে চোরের মতো রাতের আঁধারে ঢাকা থেকে পালিয়ে গেলেন। তার এই চলে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই শুরু হলো অভিযান। তখন রাত। নিরীহ ঢাকাবাসীর ওপর গুলি চালিযে হাজার হাজার নারী, শিশুসহ সবাইকে হত্যা করা হলো। পুরনো ঢাকায় মধ্যরাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চালানো হলো ধ্বংসলীলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ছিল তাদের ক্ষোভ। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং শিক্ষকদের আবাসে আক্রমণ চালিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটালো। ট্যাঙ্কের গোলার আঘাতে শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। কেননা শহিদ মিনার বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রতীক, সংস্কৃতির প্রতীক। সংবাদপত্রে কর্তব্যরত সাংবাদিককে গুলি করে মারা হলো, রিকশাচালক ক্লান্ত শরীরে রিকশায় মুঘাচ্ছিল, তাকেও সেই অবস্থায় হত্যা করা হলো। মনে হলো মানুষ আকৃতির একদল দানব সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে।

পাকিস্তানিরা কেন এমন করল? আসলে পাকিস্তানের শাসকরা প্রথম থেকেই বাঙালিদের নিকৃষ্ট, ভীরু ও আত্মসম্মানবোধহীন মনে করত। এ কারণে জিন্নাহ সাহেব বলতে পেরেছিলেন- একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের ধারণা ছিল- ভীরু বাঙালিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দমন করা সম্ভব হবে। এক রাতেই তারা পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে। এ কারণে তারা ২৫ মার্চ গভীর রাতকেই বেছে নিয়েছিল। মেজর সিদ্দিক সালেকের বইতে এ বিষয়ে লেখা রয়েছে- রাতভর অভিযান চালিয়ে সকালে আর্মি নেতারা বলছে, অন্তত কয়েক যুগের জন্য বাঙালিকে ঠান্ডা করা হলো। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বেকুবের দল এক যুগ কেন, এক বৎসরেও তা করতে পারেনি।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলব যে, ২৫ মার্চ রাত ছিল বাঙালিদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। সেই রাতের আক্রমণ আমাদের মনে ইস্পাতদৃঢ় মানসিক শক্তি যুগিয়েছে। মানুষ আরো দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী তারা যুদ্ধে যাবে। এবং এই যুদ্ধই হবে মুক্তিযুদ্ধ। এবং এই যে সংকল্প, অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। পাকবাহিনী যত গ্রাম পুড়িয়েছে, ততই প্রতিরোধ আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা বাহিনীর নয়, এটি জনযুদ্ধ। জীবন উৎসর্গ করে ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী সবাই এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এটি শতভাগ জনযুদ্ধ। এখানে কোনো ভিআইপি জেনারেল নেই; থাকতে পারে না।

পরিশেষে আবারো বলব যে, ২৫ মার্চ আমাদের জন্য ছিল অগ্নিপরীক্ষা। আমরা পিছু হটিনি। সেই পরীক্ষায় সমগ্র জাতি উত্তীর্ণ হয়েছে। সে কারণেই ২৬৬ দিনের যুদ্ধ শেষে প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক বলিষ্ঠ ভূমিকায় আমরা ৯০ হাজার পাকসেনাকে পদানত করেছি। অথচ তারা সে সময় নিজেদের ‘বিশ্বসেরা সৈন্যদল’ দাবি করতো। 

সহকারী সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মুজিবনগর সরকার
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়