ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

৩২ বছরের নিখোঁজ ব‌্যক্তিকে স্বজনদের কাছে ফেরালেন পোস্টম‌্যান

ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৪, ৬ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৬:০২, ৭ জানুয়ারি ২০২২
৩২ বছরের নিখোঁজ ব‌্যক্তিকে স্বজনদের কাছে ফেরালেন পোস্টম‌্যান

বাবা জিয়াউল হককে (কালো চাদর পরা) নিতে ডোমারে ছেলে সজিব (পাশে বসা) । মাঝ বরাবর পোস্টম‌্যান হোসেন।

‘রানার চলেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাছে রাতে/ রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য‌্য’র এক অনবদ‌্য কবিতা ‘রানার’। এ কবিতায় চমৎকারভাবে উঠে এসেছে একজন রানার, ডাকপিওন বা পোস্টম‌্যানের দায়িত্ববোধের কথা। সৎ, নির্ভিক, দায়িত্ব ও নিষ্ঠাবান মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছেন এই পেশার মানুষগুলো।

শুধু কবিতায় নয়, এরকম প্রতিচ্ছবি বাস্তবেও দেখা যায়। ঠিকানা অনুযারী কেবল চিঠি পৌঁছে দেওয়া নয়, মানুষও পৌঁছে দেন পোস্টম্যানরা। এক মানসিক ভারসাম‌্যহীন ব‌্যক্তিকে ৩২ বছর পর তার স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিয়ে অনবদ‌্য এক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন নীলফামারীর ডোমার পোস্ট অফিসের বোড়াগাড়ি শাখার পোস্টম্যান হোসেন আলী।

বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) দুপুরে স্বজনদের ফিরে পান জিয়াউল হক (৬২)। পরিবার ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। তাকে ফিরে পেয়ে স্বজনরাও। আর যে ব‌্যক্তির প্রচেষ্টায় এই অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো, সেই হোসেন আলীকে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসা জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এখানেই হয়তো মধুরেণ সমাপয়েৎ।

জিয়াউল হকের জীবনের মূল‌্যবান ৩২টি বছর কেনো হারিয়ে গেলো? কেনো তিনি মানসিক ভারসাম‌্য হারিয়ে সরকারি চাকরিজীবী থেকে পথের ভিক্ষুক হয়ে গেলেন? কেনো চাকরি হারালেন? কেনো ভিক্ষা করে জমানো টাকা সন্তানদের জন‌্য পাঠাতেন জিয়া? কেনো বছরের পর বছর ধরে সেসব টাকা আবার ফেরৎ আসতো? এসব কিছুর শুরুটা হয়েছিল ৩২ বছর আগে এক বিয়োগান্তক ঘটনার মধ‌্য দিয়ে।

পিরোজপুর জেলার ৩নং দূর্গাপুর ইউনিয়নের মরহুম আলহাজ্ব মোক্তাদের আলী মাঝির ছেলে জিয়াউল হক।

পরিবারের সদস্যদের দেওয়া তথ‌্যমতে, প্রায় ৩২ বছর আগে নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের টাইপিস্ট পদে পোস্টিং হয় তার। প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কিলোমিটার দূরে গিয়ে চাকরি না করার অনুরোধ করেন তার স্ত্রী। কিন্তু কোনোভাবেই চাকরি ছাড়তে চাননি জিয়া। এ নিয়ে মতানৈক‌্য। একসময় ঝড় ওঠে সংসারে। দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে জিয়াউলকে ছেড়ে চলে যান স্ত্রী। পরে বিচ্ছেদ। তারপর থেকে জিয়াউল হক পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। ডোমারে নিজ অফিসের কাজে মনোযোগী হন। তার খোঁজও কেউ নেননি। এভাবেই চলছিল।

তবে পরিবার হারিয়ে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় তার। প্রায় ২০ বছর আগে এ কারণেই চাকরি হারান তিনি। চাকরি ফেরত পেতে বিভিন্ন দপ্তরে ঘোরাফেরা করেও কোনো লাভ হয়নি। একসময় একেবারেই ভেঙে পড়েন। মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিবার আগেই হারিয়েছেন, তারপর চাকরি, সবশেষে হারালেন মানসিক ভারসাম‌্য জিয়াউল।

বেঁচে থাকার তাগিদে এক সময় অন‌্যের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে। মানুষের দয়ায় বোঁচে থাকলেও পিতৃসত্বা হারাননি। যা সাহায‌্য পেতেন, তা থেকে টাকা জমিয়ে দুই মেয়ে ও ছেলেকে পাঠানো শুরু করেন তিনি। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও, ওসিসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে টাকা পাঠাতেন। টাকার অংকও খুব বেশি না। ২০০ বা ৩০০ করে। ডোমার পোস্ট অফিস থেকে অন্তত ৫০টি মানি অর্ডার করেন তিনি।

এদিকে মানি অর্ডারের কারণ না জেনে কোনো কর্মকর্তা টাকা গ্রহণ করতেন না। তাই তার পাঠানো সমস্ত টাকা আবার ফেরত চলে আসতো ডোমারেই। এজন্য তিনি প্রতিদিন ডোমার পোস্ট অফিসে যাতায়াত করতেন।

পোস্টম্যান হোসেন আলী বলেন, ‘‘জিয়াউল হক চাচা ডোমার পোস্ট অফিসে এসে রেগুলার মানি অর্ডার করতেন। তবে তার পাঠানো সমস্ত টাকা আবার পেস্ট অফিসেই ফেরত আসতো। তিনি প্রতিদিন এসে খোঁজ নিতেন- তার পরিবারের কেউ টাকা পেয়েছে কি না। এভাবে তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে পোস্ট অফিসে যাতায়াত করেছেন।

‘আমি কয়েকদিন আগে তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পিরোজপুরের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে উনার ছবিসহ পোস্ট দেই। তবে কোনো কাজ হয় না। তারপর সৌরভ নামের পিরোজপুরের এক পোস্টম্যানের সহায়তায় তার পরিবারের সন্ধান পাই। পরে উনার ছেলের সহিদুল ইসলাম সজিবের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ হয়। আজ সজিব ডোমারে এসেছেন বাবাকে নিতে।”

সহিদুল ইসলাম সজিব বলেন, ‘আমার বয়স যখন দেড় বছর, তখন বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। বাবা ডোমার চলে যান। আমার বড় দুই বোন ও আমি নানার বাড়িতেই থাকি। তখন থেকেই বাবা নিখোঁজ ছিলেন। বুধবার (৫ জানুয়ারি) সকালে যখন ডোমার পোস্ট অফিস থেকে হোসেন ভাই ফোন করে বলেন, আপনার বাবা ডোমারে আছে। তাকে নিয়ে যান। তখন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিলো স্বপ্ন দেখছি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা রওনা হই। জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম বাবাকে দেখলাম। জড়িয়ে ধরলাম। এরকম শান্তি আর কখনো পাইনি।’

মানসিক ভারসাম‌্য হারালেও যে মানুষটি সন্তানদের ভোলেননি, সন্তানদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ধরা গলায় তিনি বলেন, ‘৩২ বছর পর ছেলে-মেয়েদের কাছে পেলাম। খুব ভালো লাগছে। যে চাকরির জন্য পরিবার-পরিজন হারিয়েছি, এখন সেই চাকরিটাও নেই। সরকারের কাছে আমার চলে যাওয়া চাকরিটা ফেরত দেওয়ার দাবি জানাই।’ 

ডোমারের রোহেল উত্তল বলেন, ‘এ ব্যক্তিকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে পোস্ট অফিসে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। মাঝেমধ্যে তাকে খাবার কিনে দিয়েছি। এখন তিনি নিজের পরিবার খুঁজে পেয়েছেন। খুব ভালো লাগছে।’ 

মামুন ইসলাম বলেন, ‘পোস্টম্যান হোসেন আলী পেশাগত দায়িত্বের বাইরে মহৎ একটি কাজ করেছেন। তিনি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।’

অভিমান, রাগ বা কোনো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কাছের মানুষ দূরে চলে যেতে পারে। তার প্রভাব চরমভাবে পড়তে পারে ব‌্যক্তি জীবনে। আর তাতে সামাজিক, পারিবারিক বা ব‌্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মানুষ। জিয়াউল হক তার উদাহরণ। অবশেষে তিনি স্বজনদের ফিরে পেয়েছেন। তার বাকি জীবন সুখের হোক। এ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে যে দায়িত্বশীল মানুষটির কারণে তিনিও ভালো থাকুন।

নীলফামারী/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়