৩ দিনেই সপ্তাহ পার!
এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম
বগুড়া জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, এই অফিসের অধিকাংশ কর্মকর্তা নিয়ম মেনে চলেন না। খোদ জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সপ্তাহে অফিস করেন মাত্র ৩ দিন। এছাড়া তিনি নিয়মিত ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো’ও পরিদর্শন করেন না। একই পরিস্থিতি অন্য কর্মকর্তা-চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও। তাদের অধিকাংশও ঠিকমতো অফিস করেন না। সেবাপ্রার্থীরা প্রায় এসব কর্মকর্তা-চিকিৎসকের দেখা পান না। এতে ‘হুমকির মুখে পড়েছে’ বগুড়ার জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপ-পরিচালক কাজী ফারুক আহমেদ।
প্রসঙ্গত, জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে জন্ম নিয়ন্ত্রণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে আর্থিক বরাদ্দ ও সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এরমধ্যে কপারটি করলে ৩৯০ টাকা, ইমপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে ৩৬০ টাকা ও স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণকারী পুরুষদের জন্য ২ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি পুরুষদের জন্য একটি লুঙ্গি ও নারীদের জন্য ২ হাজার টাকা ও একটি শাড়ি বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বগুড়ার অনেক জায়গায় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা।
পরিবার কল্যাণ সহকারীদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে—বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সক্ষম দম্পতিদের উদ্বুদ্ধ করা। পাশাপাশি নারীদের জন্য খাবার বড়ি বিতরণ, ইনজেকশন দেওয়া, পুরুষদের জন্য এনএসভি (স্থায়ী পদ্ধতি) ও টিউবেকটমি (স্থায়ী পদ্ধতি) বিষয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝানো। একইসঙ্গে নারীদের প্রাথমিক বাছাইকরণ, সেবা কেন্দ্রে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মা-শনাক্ত করারও পরিবার কল্যাণ সহকারীদের কাজ।
কিন্তু বগুড়া সদরসহ একাধিক উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবার কল্যাণ সহকারীদের কাউকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিদর্শন করতে দেখা যায়নি। এছাড়া, জেলার অধিকাংশ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকসহ অন্য স্টাফরাও নিয়মিত নিজ নিজ কর্মস্থলে যান না। এজন্য জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসের তদারকির অভাবকেই দায়ী করেছেন সেবাপ্রার্থীরা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, জেলার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাত্র ৩ দিন অফিস করেন। তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার গাড়িতে ঢাকায় পরিবারের কাছে চলে যান। ফেরেন রোববার। এরপর অফিস করেন সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত।
এছাড়া, মাসে ১৫ দিন ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো’ পরিদর্শনে যাওয়ার কথা তার। কিন্তু তিনি নিয়মিত এসব কেন্দ্র পরিদর্শনে যান না বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বগুড়ার সাবগ্রাম ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে তিনি গেছেন ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। এছাড়া, সদর, সোনাতলা, শিবগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, ধুনট, আদমদীঘির বিভিন্ন ইউনিয়ন ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র’-এর উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসারের কেউ বলতে পারেননি উপ-পরিচালক শেষ কবে তাদের কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন গিয়েছিলেন।
বগুড়ার সাবগ্রাম ইউনিয়নের আব্দুর রফিকের স্ত্রী গত আগস্ট মাসে সিজারে বাচ্চা প্রসবের পর ‘মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র’ থেকে স্থায়ী বন্ধ্যা পদ্ধতি গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে আব্দুর রফিক বলেন, ‘আমাদের আগে থেকেই ২ সন্তান ছিল। নতুন সন্তান আসার পর আর সন্তান নেবে না বলে স্থায়ী বন্ধ্যা পদ্ধতি গ্রহণ করে আমার স্ত্রী। তবে তাকে বরাদ্দের ২ হাজার টাকা ও শাড়ি দেওয়া হয়নি।’
এদিকে, শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র’ ঘুরে জানা গেছে, উপজেলার মোকামতলার ভাগকোলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে তিন জন স্টাফ রয়েছেন। তবে, তারা সপ্তাহে মাত্র ৩ দিন বসেন। বাকি ২ দিন মাঠে থাকেন। স্থানীয়দের অভিযোগ—এখানে শুধু ওষুধ দেওয়া হয়। আর কোনও সেবা মেলে না।
সৈয়দপুরের গাংনগর কেন্দ্রে সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই উপ-সহকারী অফিসার অনুপস্থিত থাকেন। এছাড়া, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ঘুরে জানা গেছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সক্ষম দম্পতিদের সচেতনতা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পরামর্শের জন্য পরিবার কল্যাণ সহকারীদের কবে দেখেছেন, এমন কথা কেউ বলতে পারেন না। প্রায় একই অবস্থা সদর, সারিয়াকান্দি, আদমদীঘি, ধুনটসহ বাকি উপজেলাগুলোতেও।
সপ্তাহে ৩ দিন অফিস করেন এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কাজী ফারুক আহমেদ। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় যাই। রোববার ভোরে ফিরি। এরপর যথারীতি অফিস করি।’
তবে, মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত পরিদর্শন না করার কথা স্বীকার করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনার কারণে সবাই তো আতঙ্কে আছেন। এই কারণে মার্চের পর থেকে তৎপরতা কমে গিয়েছিল। এখন করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি।’
কাজী ফারুক আরও বলেন, ‘উপজেলায় আমাদের যে চার জন অফিসার আছেন, মনিটরিংগুলো মূলত তারাই করেন। আমার কাজ এই অফিসারদের মনিটরিং করা। এছাড়া, আমাকে বিভিন্ন মিটিংয়ে যোগ দিতে হয়, ঢাকায় যেতে হয়। এটা তো এমন না যে, আমি ইচ্ছে করেই মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনে যাই না।’
‘জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করে সেবাপ্রার্থী টাকা-শাড়ি পাননি’—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে কাজী ফারুক বলেন, ‘অভিযোগ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবো। ’
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, ‘এসব বিষয় আমার জানা ছিল না। এই বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালকের সঙ্গে কথা বলবো।’ কোনো অনিয়ম যেন না হয়, সে দিকে নজর রাখতে সংশ্লিষ্টদের বলবেন বলেও তিনি জানান।
বগুড়া/এনই
আরো পড়ুন