ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

৫ ঘণ্টার ইটযুদ্ধ ও পুলিশের ‘দিশেহারা’ ভূমিকা

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ১৯ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ২১:৪৯, ১৯ এপ্রিল ২০২২
৫ ঘণ্টার ইটযুদ্ধ ও পুলিশের ‘দিশেহারা’ ভূমিকা

ঢাকা ক‌লে‌জ শিক্ষার্থী‌দের স‌ঙ্গে নিউমা‌র্কে‌ট ব্যবসায়ী‌দের সংঘর্ষ

ঢাকা ক‌লে‌জ শিক্ষার্থী‌দের স‌ঙ্গে কার‌ণে-অকার‌ণে পা‌শের সকল মা‌র্কে‌টের ব্যবসায়ী‌দের ঝা‌মেলার ঘটনা নতুন নয়। কখনও ব্যবসায়ী‌দের দোষ থা‌কে, কখনওবা শিক্ষার্থী‌দের। সেসব দো‌ষের প‌রিমাপ করা সম্ভব হয়‌নি গত দুই দশ‌কেও। তারপরও বছর ধ‌রে সহবস্থানে র‌য়ে‌ছে ঢাকা ক‌লেজের স‌ঙ্গে নিউমা‌র্কেট, চ‌ন্দ্রিমা, ধানম‌ণ্ডি হকার্স, নুরজাহান, গ্লোব, গাউছিয়া, চিশ‌তিয়া, চাঁদনী চক মার্কেটের বলাকা ভব‌নে‌র ব্যবসায়ীরা।

মা‌ঝে ম‌ধ্যে তুচ্ছ ঘটনা বা রটনা‌কে ঘি‌রে রণ‌ক্ষেত্রে রূপ নেয় নীল‌ক্ষেত, নিউমা‌র্কেট হ‌য়ে সা‌য়েন্স ল্যাব‌রেট‌রি, সিটি ক‌লেজ পর্যন্ত। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় এসব ঘটনা-দুর্ঘটনার স‌ঙ্গে জ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক‌লে‌জ শিক্ষার্থীরা। সোমবারও ঘ‌টে‌ছিল সে রকম এক‌টি ঘটনা।

এদিন মধ্যরা‌তে নিউমার্কে‌টের কোনো এক‌টি খাবা‌রের দোকা‌নে (মতান্ত‌রে কাপ‌ড়ের দোকা‌নে) ঢাকা ক‌লে‌জের ২-৩ জন শিক্ষার্থীর স‌ঙ্গে তুচ্ছ কো‌নো ঘটনা নি‌য়ে বাদানুবাদ হয় ওই দোকা‌নের কর্মচারীদের। এক পর্যা‌য়ে সেটা হাতাহাতি‌কে রূপ নেয়। সংখ্যায় কম হওয়ার কার‌ণে শারীরিক আক্রমণের শিকার হোন ঢাকা ক‌লে‌জ শিক্ষার্থীরা।

মুহূর্তে সে খবর পৌঁছে যায় ক‌লে‌জের আবা‌সিক ছাত্রদের কা‌ছে। কাল‌বিলম্ব না ক‌রে ঢাকা ক‌লে‌জের ছাত্ররা ‘যার যা কিছু আছে, তাই নি‌য়ে’ ক‌লেজ ক্যাম্পাস থে‌কে রাস্তায় নে‌মে আসে। মধ্যরাত হ‌লেও আশপা‌শের সব মা‌র্কেট ঈদ উপল‌ক্ষে খোলা। রাস্তায়ও ঈদের কেনাকাটা কর‌তে আসা অনেক মানুষ। অল্প সম‌য়ের ম‌ধ্যে ঢাকা ক‌লেজ, নিউমা‌র্কেট ও মিরপুর রোড এলাকায় শুরু হ‌য়ে যায় শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী‌দের সংঘর্ষ।

অতি অল্প সম‌য়ের ম‌ধ্যে পু‌লিশ এসে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বু‌লেট, লা‌ঠিপেটা এসব ক‌রে দুই পক্ষ‌কে কো‌নম‌তে সামাল দেয়। সেই সংঘর্ষও চ‌লে রাত প্রায় তিনটা পর্যন্ত। সংঘ‌র্ষে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পথচা‌রী‌দের ম‌ধ্যে শতা‌ধিক আহত হয় ব‌লে জানা গে‌ছে।

মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) সকাল সা‌ড়ে নয়টা। হ‌লে শিক্ষার্থীরা ঘুমে। আগের রা‌তের জের হি‌সে‌বে দি‌নের প্রথম আক্রমণটা আসে ব্যবসায়ী‌দের পক্ষ থে‌কে। ঢাকা ক‌লে‌জের গেইটে এসে হামলা চালান তারা। খানিক প‌রে দশটার দি‌কে শিক্ষার্থীরা একজোট হ‌য়ে বে‌রি‌য়ে আসে রাস্তায়। শুরু হয় দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষ। ব্যবসায়‌ীরা অবস্থান নেয় গাউছিয়া নিউমা‌র্কেট ফুটওভার ব্রিজের নি‌চে, ধানমন্ডি হকার্স মা‌র্কেটের কোণায়। আর শিক্ষার্থীদের অবস্থান গ্লোব সেন্টার মা‌র্কেট ও ঢাকা ক‌লে‌জের সাম‌নে। দু’পক্ষই সশস্ত্র।

দশটায় শুরু হয় ব্যবসায়ী আর শিক্ষার্থী‌দের হামলা, পাল্টা হামলা। হাজার হাজার ই‌ট ও পাথ‌রের টুকরার পাশাপা‌শি দু’পক্ষই হামলার সময় কক‌টেল, লা‌ঠি, রড, হ‌কি‌স্টিক, পে‌ট্রোল বোমা ব্যবহার ক‌রে। ‌বেলা য‌ত বাড়‌তে থা‌কে, নিউমার্কেট ফুটওভার ব্রিজ থে‌কে ঢাকা ক‌লেজ পর্যন্ত পু‌রো এলাকা আক্ষ‌রিক অর্থে রণ‌ক্ষে‌ত্রে রূপ নেয়। ব্যবসায়ী এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ হি‌সে‌বে আইনশৃঙ্খলা বা‌হিনীর থাকার কথা। কিন্তু সকাল সাড়ে নয়টা থে‌কে বেলা ১টা ২০ মি‌নিট পর্যন্ত অত্র এলাকায় কো‌নো আইনশৃঙ্খলা বা‌হিনীর দেখা মে‌লে‌নি।

শিক্ষার্থীরা এসময় ক‌য়েক‌টি বন্ধ দোকা‌নের শাটার ভে‌ঙে, ‌দোকা‌নে র‌ক্ষিত কাপ‌ড়ে পে‌ট্রোল ঢে‌লে আগুন ধ‌রি‌য়ে দেয়। ক‌য়েক‌টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হ‌লেও এক‌টি দোকান একেবা‌রে জ্ব‌লে-পু‌ড়ে যায়।

এসময় রোগী বহনকারী এক‌টি অ্যাম্বুলেন্স ধানম‌ন্ডি হকার্স মা‌র্কে‌টের সাম‌নে দি‌য়ে ঢাকা মে‌ডিক্যালে যাওয়ার প‌থে ব্যবসায়ী‌দের পক্ষ থে‌কে ক‌য়েকজন মি‌লে সেই নতুন অ্যাম্বু‌লেন্স‌কে ভে‌ঙেচু‌রে একাকার ক‌রে দেন। ভেত‌রে তখনও রোগী ছিল। অবশেষে ড্রাইভার তীব্র বে‌গে সেই ভাঙা অ্যাম্বু‌লেন্স নি‌য়ে পা‌লি‌য়ে বাঁচেন।

পেশাগত দা‌য়িত্ব পালন কর‌তে গি‌য়ে বেশ ক‌য়েকজন সাংবা‌দিক দুই প‌ক্ষের হা‌তেই আহত হন। কা‌রো কা‌রো ক্যা‌মেরা ভে‌ঙে দেওয়ার পাশাপা‌শি দ‌ুই-তিন জ‌নের মোবাইল কে‌ড়ে নি‌য়ে‌ছে দুই পক্ষই। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মী‌দের স‌ঙ্গে বে‌শি খারাপ আচরণ ক‌রে‌ছেন ব্যবসায়ীপক্ষ। আমার নি‌জের মোটরসাইকেল নিরাপদ দূরত্বে রাখার পরও ‌হেল‌মেট‌টি নি‌য়ে নেয় এক শিক্ষার্থী। মোটরসাইকেলে থাকা সব অক‌টেন বোত‌লে ভ‌রে নি‌য়ে নেয় তারা। পরবর্তী সম‌য়ে সেই তেল মি‌শি‌য়ে এক ধরনের ‘বোমা’ বা‌নি‌য়ে তা প্রতিপক্ষের দি‌কে ছু‌ড়ে মারা হয়।

দুপুর ১টা ২০ মিনিট। পু‌লি‌শের উপ‌স্থি‌তি লক্ষ্য করা গে‌ছে। এসময় শখা‌নেক পু‌লিশ সদস্য নিউমা‌র্কেট ফুটওভার ব্রিজ এলাকায় এসে জ‌ড়ো হয়। সেখান থে‌কে শিক্ষার্থী‌দের লক্ষ্য ক‌রে টিয়ারশেল মার‌তে থা‌কে। আধা ঘণ্টার ম‌ধ্যে অন্তত ৫০ রাউন্ড টিয়ার শেল মে‌রে শিক্ষার্থী‌দের ক‌লে‌জ ক্যাম্পা‌সে যে‌তে বাধ্য ক‌রে। এসময় গ্যা‌সের তীব্র জ্বালায় দা‌য়িত্বরত সাংবা‌দিক‌দের চোখ বাঁচা‌তে এদিক-সে‌দিক পা‌নির জন্য ছুট‌তে দেখা যায়।

শিক্ষার্থীরা যখন ক্যাম্পা‌সের ভেত‌রে, তখনও পু‌লি‌শের পাশাপা‌শি হাজা‌রো ব্যবসায়ীরা সশস্ত্র অবস্থা‌নে থে‌কে শিক্ষার্থী এবং সাংবা‌দিক‌দের ওপর হামলা চালায়। তখনও শিক্ষার্থী‌দের লাগা‌নো আগুনে পুড়‌ছিল নূরজাহান মা‌র্কে‌টের দোকান দু‌টি। পু‌লিশ, জনতা, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পথচারী, সাংবা‌দিক বা প্রত্যক্ষদর্শী কেউ ফায়ার সা‌র্ভি‌সে খবর দি‌তে দেখা যায়‌নি। অব‌শে‌ষে ২টা ২৪ মিনি‌টের সময় ফায়ার সা‌র্ভি‌সের এক‌টি ইউনিট ঘটনাস্থ‌লে আসে এবং আগুন নেভা‌নোর চেষ্টা শুরু ক‌রে।

সা‌ড়ে নয়টায় শুরু হওয়া শিক্ষার্থী আর ব্যবসায়ী‌দের এই সংঘর্ষের চার ঘণ্টা পর অকুস্থলে পু‌লি‌শের আগমন, ব্যবসায়ী‌দের পক্ষ নি‌য়ে শিক্ষার্থী‌দের প্রতি অর্ধশত রাউন্ড টিয়ারশেল নি‌ক্ষেপ এবং অপর্যাপ্ত পু‌লি‌শের কার‌ণে তীব্র সমা‌লোচনা ক‌রে‌ছেন সর্বস্তরের ব্যবসায়ী, পথচারী, শিক্ষার্থীসহ বি‌ভিন্ন স্ত‌রের মানুষজন।

পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী এই সংঘ‌র্ষের পু‌রোটা সময় পু‌লিশ‌কে অনেকটাই ‘‌দি‌শেহারা’ ম‌নে হ‌য়ে‌ছে। তা‌দের সাম‌নে থে‌কে সশস্ত্র ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থী‌দের লক্ষ্য ক‌রে প্রচুর ইট পাটকেল ছুড়‌লেও পু‌লি‌শের তেমন কো‌নো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়‌নি। উপরন্তু এসময় তারা বার বার ক‌রে শিক্ষার্থী‌দের লক্ষ্য‌ করে টিয়ারশেল নি‌ক্ষেপ করা‌তেই বে‌শি ম‌নো‌যোগী ম‌নে হ‌য়ে‌ছে। এমন‌কি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পা‌সে ঢু‌কে যাওয়ার পরও ক্যাম্পা‌সের ভেতরে বেশ ক‌য়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নি‌ক্ষেপ কর‌তে দেখা গেছে তা‌দের।

অব‌শে‌ষে ক্লান্ত শ্রান্ত এই সংবাদকর্মী, গর‌মে ঘা‌মে গ্যা‌সের জ্বালায় চোখ লাল ক‌রে; ইটবৃ‌ষ্টিকে ‘বি‌লি কে‌টে’ ফি‌রে আসে নিরাপদ আবা‌সে।

পড়ুন: 
নিউমার্কেট এলাকা আবারও রণক্ষেত্র, বন্ধ যান চলাচল
নিউমার্কেটে সংঘর্ষ, রাজধানীজুড়ে অচলাবস্থা
শতকোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা দোকান মালিক সমিতির
টিয়ারশেলে সরে গেছে উভয় পক্ষ 
 

ঢাকা/নাজমুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়