ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

করোনাকালে গণমাধ্যম ভাবনা

মামুন আ. কাইউম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১২, ১ জুন ২০২০   আপডেট: ১৬:২৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
করোনাকালে গণমাধ্যম ভাবনা

‘দুর্যোগ’ বাংলাদেশের নামের পাশে থাকা একটি শব্দ। সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, নার্গিস, ফণী বা আম্পানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ বিশ্বে এখন একটি পরিচিত নাম। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর দেখা দেওয়ায় অভিজ্ঞতার কারণে গণমাধ্যমও প্রস্তুত থাকে। এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনকি জঙ্গী হামলা, দাঙ্গা-হাঙ্গামার মতো সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা নিজেদের ‍নিরাপদ রেখে কাজের কৌশল রপ্ত করেছেন। কিন্তু করোনার মতো স্বাস্থ্য বিপর্যয়ে অভিজ্ঞতা না থাকায় এখানে কিছু বিপত্তি ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেহেতু গণমাধ্যমের যে কোনো ভুল সামাজিকমাধ্যমে ধরিয়ে দিতে পারলে বুক ফুলিয়ে নিজের জ্ঞান জাহির করা যায় সেহেতু অনেকেই গণমাধ্যমকেও বিভিন্ন বিষয়ে বুঝে, না-বুঝে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান। এ থেকে প্রমাণিত হয়, গণমাধ্যম মানুষের জীবনে এখনো পর্যাপ্ত প্রভাব বিস্তার করে বা করতে পারে।

তবে করোনাকালে গণমাধ্যমগুলোর প্রস্তুতি বা পর্যাপ্ত সংবাদ প্রচারের সব দায় গণমাধ্যমের উপর চাপানো ঠিক হবে না। আমরা জানি, যে কোনো দুর্যোগ যখন বড় আকার ধারণ করে তখন সব রিপোর্টারকেই সেই দুর্যোগ কাভার করতে হয়। করোনার মতো অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেখানে সবসময়ই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, সেখানেও এর ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। তবে এটাও ঠিক, এ ক্ষেত্রে মাঠের সব খবর উঠে আসবে না স্বাভাবিক হিসেবেই। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাপও কাজ করে। করোনার শুরুর দিকে তথ্য মন্ত্রণালয় দেশের টিভি চ্যানেলগুলো কীভাবে গুজব ছড়ায় তা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি করেছিল। ব্যাপক সমালোচনার পর তা প্রত্যাহার করা হয়। বাস্তব হলো, মূলধারার গণমাধ্যম (প্রথম সারির সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন) কখনো গুজব ছড়িয়েছে তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। এটা ঠিক যে, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলেই বরং গুজবের জন্ম হয় এবং তা মোকাবিলায় চড়া মূল্যও দিতে হয়। প্রমাণ হিসেবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার বা রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার কথা বলা যেতে পারে।

এবার গণমাধ্যমের অন্তর্গত বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক। দেশের গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের একটা বড় অংশ ইন্টারনেটমুখী হওয়ায়, আয় কমেছে গণমাধ্যমের। কিছু গণমাধ্যম করোনার আগে থেকেই ধুঁকে ধুঁকে চলছিল। করোনাকালে গণমাধ্যমের কার্যক্রম সংকুচিত করতে গিয়ে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। বেতন বন্ধ আছে অনেক প্রতিষ্ঠানের। সার্কুলেশনও কমে গেছে। বিজ্ঞাপনেও লেগেছে ধাক্কা। ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন-ভাতাসহ সকল খরচের জন্য এখন মালিক পক্ষের উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। এটা বাস্তবতা। দেশের আবাসন, তৈরি পোশাক, ওষুধ, পরিবহন শিল্পে করোনাকালে অস্থির সময় যাচ্ছে। এই শিল্প-মালিকরাই আবার গণমাধ্যমগুলোর মালিক। ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’- এই আপ্তবাক্যের মতোই গণমাধ্যম জগতেও নেমে এসেছে দুঃসময়।

আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্তের পরিচয় প্রকাশ করা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। দেখা যাচ্ছে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেলে দাফনে বাধা, হাসপাতাল তৈরিতে বাধা, বাসা ভাড়ায় বাধা ইত্যাদিও দেখতে হচ্ছে। মৃত্যুর পর নিজের পরিবারের লোকজনও জানাজায় উপস্থিত থাকছেন না। এটি অজ্ঞানতা এবং অসামাজিকতার ফল। করোনায় মৃত্যু কিনা এ নিয়েও তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। এক্ষেত্রে একটি বিপদের কথা হচ্ছে- সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের বাইরে সাংবাদিকদের করণীয় কিছুই থাকছে না। ফলে এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে আরো সচেতন হতে হবে। আবার গণমাধ্যমের সংবাদগুলোর বেশিরভাগই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনায় আক্রান্ত বা মৃতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সামাজিক দূরত্ব না-মানা, বিদেশ থেকে দেশে ফেরা বা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামে ফেরাকে একপাক্ষিক হিসেবে দেখানোর প্রবণতাও দেখা গেছে। ‍উপসর্গ ছাড়া যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরও ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাতে গণমাধ্যমে এক পাক্ষিকভাবে নেতিবাচকভাবে আলোচনায় আনা হয়েছে। বিষয়টিও ভাবা দরকার।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মিডিয়ার সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। জনগণকে তথ্য সেবা দিতে গিয়ে কয়েকজন মৃত্যুবরণও করেছেন। দুর্ভাগ্য হলো, তাঁদের এ অবদানকে এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ, মালিকপক্ষ বা পাঠক- কেউ যথাযথ সম্মান জানাননি। এখন পর্যন্ত শুধু পুলিশ প্রধান ব্যতীত কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সেসব সাংবাদিকের পরিবারের ফলপ্রসূ খোঁজখবর নেননি। আবার করোনায় দুর্নীতির সংবাদ সংগ্রহে মারধর, হামলা, মামলার ঘটনাও ঘটেছে। একইসঙ্গে বেতন বকেয়া ও লে-অফ আতঙ্ক তো রয়েছেই। এমতাবস্থায় অনেকে প্রণোদনার জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং সমালোচনাও করছেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে অন্যান্য সরকারি, ব্যাংক, গার্মেন্টস, কৃষি  প্রণোদনার আওতায় এলেও গণমাধ্যম কেন সেই তালিকায় পড়লো না সেটিও চিন্তার বিষয়।

করোনাকাল থেকে গণমাধ্যমকেও শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষ করে মাঠে দায়িত্ব পালন ও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জোরদার, কর্মীদের স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত, মানবিক কারণে হলেও ছাঁটাই বন্ধ ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হবে। গণমাধ্যমকে এসময় অন্যান্য হাউজের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সহযোগী হয়ে উঠতে হবে। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদেরও মূল্যায়নের সময় এসেছে। পাশাপাশি সরকারকেও গণমাধ্যমকে আস্থায় নিতে হবে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদকর্মীদের এ সময় কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের দেশেও তা একটি কাঠামোর মধ্য থেকে করা যেতে পারে। তবে তা হতে হবে দলমত নির্বিশেষে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সাংবাদিককের জন্য। পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত সাংবাদিকদের নির্ধারিত হাসপাতালে চিকিৎসা এবং শহীদ সাংবাদিকের পরিবারের জন্য রাষ্ট্রের ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। তবে সবশেষ বিষয়টি হলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়