ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘মঞ্চনাটক আমার সত্তার অর্ধেকজুড়ে আছে’

হারুন পাশা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ৯ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১৭:১৫, ২৮ আগস্ট ২০২০
‘মঞ্চনাটক আমার সত্তার অর্ধেকজুড়ে আছে’

রামেন্দু মজুমদার। অভিনেতা, নির্দেশক, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। গড়েছেন নাট্যদল। সম্পাদনা করছেন নাট্য-বিষয়ক পত্রিকা। দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সভাপতি হিসেবে। বর্তমানে তিনি আইটিআই-এর অনারারি প্রেসিডেন্ট। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত এই নাট্যব্যক্তিত্বের আজ ৮০তম জন্মদিন। বিশেষ এই দিন স্মরণে রামেন্দু মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক হারুন পাশা।

হারুন পাশা: শুভ জন্মদিন।

রামেন্দু মজুমদার: ধন্যবাদ। 

হারুন পাশা: ৮০তম জন্মদিনে আপনার ছেলেবেলাটা যদি স্মরণ করিয়ে দেই। দেখা যাবে, ছাত্রাবস্থায় স্কুলের মাঠে ‘সিরাজউদ্‌দৌলা’ নাটকে ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটস-এর ভূমিকায় অভিনয়; সম্ভবত সেটিই প্রথম। অভিনয়ের সঙ্গে কীভাবে জড়িত হলেন?

রামেন্দু মজুমদার: আমাদের পরিবার ছিল নাট্যপ্রেমী। বাবা, বড় ভাইয়েরা অভিনয় করতেন। সুযোগটা প্রথম এলো, যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমাদের স্কুলের মাঠে ‘সিরাজউদ্‌দৌলা’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমি সেখানে ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটস। দুটি মাত্র সংলাপ। তাও ইংরেজিতে। কিন্তু তার জন্য কতো প্রস্তুতি!

সেই শুরু। এরপরে আমি অবশ্য কলেজে নাটক করেছি; কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯৬১ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম; জগন্নাথ হলে ছিলাম। হাউজ টিউটর ছিলেন ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর। একদিন এসে বললেন, মুনীর চৌধুরী একটি নতুন নাটক করছে, আমি তোমার কথা বলেছি।

স্যারের নির্দেশে আমি প্রবল উৎসাহে পরের দিন গেলাম মুনীর চৌধুরীর বাসায়। তখন ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ পড়ে শোনানো হলো। মুনীর চৌধুরী নিজেই নির্দেশনা দিয়েছেন। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা অভিনয় করেছিলাম। সেখানে আমি ইব্রাহিম কার্দির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম।

হারুন পাশা: মুনীর চৌধুরীর ‘দণ্ড’ নাটকেও তো অভিনয় করেছেন।

রামেন্দু মজুমদার: তখন ছাত্র-শিক্ষক নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল। আজকে যেটা টিএসসি, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র। এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল বিল্ডিং হওয়ার আগে। সেটা হয়েছিল কার্জন হলের একটা কক্ষে। তখন টিএসসি থেকে কয়েকটা দল করা হলো। যেমন, ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠী, ছাত্র-শিক্ষক লেখকগোষ্ঠী। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীর ছাত্র তত্ত্বাবধায়কের। শিক্ষক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠী থেকে আমরা প্রথম নাটক করেছি শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’, এর নাট্যরূপ আমি দিয়েছিলাম। এরপর আমরা মুনীর চৌধুরীর দুটি একাঙ্ক নাটক ‘দণ্ড’ এবং ‘দণ্ডধর’ দুটি নাটকে একসঙ্গে অভিনয় করি। আজকে যেটা ‘নাটমণ্ডল’ তখন সেটা ছিল পাবলিক লাইব্রেরির ছোট্ট একটা অডিটরিয়াম। তখন এটি খুব বেশি ব্যবহৃত হতো না। গুদামের মতো ছিল। সেটা পরিষ্কার করে নিয়েছিলাম। ‘দণ্ডধর’-এ আমার সঙ্গে আরো ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, রশীদ হায়দার, রোজি। আর ‘দণ্ড’ নাটকে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ফেরদৌস আরা বেগম এবং মুনীর চৌধুরী নিজেও অভিনয় করেছিলেন।

হারুন পাশা: প্রথম টেলিভিশন নাটক ‘একতলা দোতলা’য় অভিনয় করলেন, সেই সময়ের টিভিনাটকের প্রস্তুতি কেমন ছিল, এবং আপনার অভিনয় প্রস্তুতি, মঞ্চ থেকে টেলিভিশনে এলেন?

রামেন্দু মজুমদার: ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম টেলিভিশন এলো। ’৬৪ সালে প্রথম যেটা করেছিলাম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা ফোরাম হতো। প্রথম ফোরামের আমি পরিচালক ছিলাম। তখন অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ ছিলেন কলিম শরাফী। তিনি মুনীর চৌধুরীকে বলেছিলেন, তুমি টেলিভিশনের জন্য একটা নাটক লিখে দাও এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঠিক করো। কারণ, তখনকার দিনে সংস্কার ছিলো সিনেমার লোকেরা যদি প্রথমেই টেলিভিশন নাটকে আসে তাহলে হয়তো পরে টেলিভিশনের জন্য বাইরের লোক পাওয়া মুশকিল হবে। ফলে সেখানে আমার সুযোগ হলো নাটক করার জন্যে। আমাদের সঙ্গে লিলি চৌধুরী, ফেরদৌস আরা বেগম, ডলি ইব্রাহিম অভিনয় করেছিলেন।

আমরা একমাস রিহার্সেল দিয়েছিলাম। কারণ তখন আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের মুখস্থ বলতে হবে এবং সেটা লাইভ হবে, কোনো রেকডিং-এর সুযোগ ছিল না। আরেকটা মজার কথা মনে আছে, সে সময় এনিসি লেখা জিপ ছিল- ‘এনিসি টেলিভিশন’। সে সময় তো ঢাকার রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া কম ছিল। এ জিপ দেখলে লোকে খুব বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাতো যে, এটি টেলিভিশনের জিপ, টেলিভিশন আসছে। মহড়ার পরে কয়েকদিন আমাদের মেয়েদের সঙ্গে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হতো। আমি সবার শেষে নামতাম, যাতে সবাই দেখে যে আমি টেলিভিশনের জিপে আছি এবং জগন্নাথ হলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে জিপটা ছাড়তাম। নিজেকে মনে হতো কিছু একটা হয়ে গেছি! প্রডিউসার মনিরুল আলম কি দক্ষতার সঙ্গেই না নাটকটি করলেন! এখনও ভাবতে বিস্ময় লাগে, এতো কম সুযোগ-সুবিধার মধ্যে লাইভ নাটক তখন করেছি। সেটাই টেলিভিশন নাটকের শুরু।

হারুন পাশা: অভিনয় ছেড়ে সাংগঠনিক কাজে মন দিলেন, কারণগুলো কী ছিল?

রামেন্দু মজুমদার: সাংগঠনিক কাজে জড়ালাম এ জন্য যে, নাটকের দল যখন গঠন করলাম, গ্রুপ থিয়েটারে সবাইকে সব কাজ করতে হয়, কেবল অভিনয় করলে হয় না। বাইরের অনেক কাজ করতে হয়। নতুন ছেলে- মেয়ে যারা আসে দেখি তারা সবাই অভিনয় করতে চায়। নেপথ্য কাজে আগ্রহ কম। তাদের উৎসাহিত করার জন্য আমি নেপথ্য কাজে জড়িয়ে পড়লাম, সেটাই মূলত কারণ।

হারুন পাশা: আপনি অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন, কোনো চরিত্রের কথা কি বিশেষভাবে মনে পড়ছে, যে চরিত্রটি আপনাকে বেশি জনপ্রিয়তা দিয়েছে?

রামেন্দু মজুমদার: ‘দুইবোন’ নাটকে শশাঙ্ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম; সেটির কথা মনে পড়ে। ‘মেরাজ ফকিরের মা’ নাটকে টাউটের চরিত্রে অভিনয় করেছি। সেই চরিত্রের কথাও মনে পড়ে। কারণ ‘দুইবোন’ নাটকের একটি চরিত্রের মধ্যে ব্যক্তিগত মিল লক্ষ্য করতাম। আর ‘মেরাজ ফকিরের মা’ চরিত্রের যে টাউটের ভূমিকায় অভিনয় করছি তা আমার সম্পূর্ণ বিপরীত ক্যারেক্টার। এজন্য চরিত্রটি ভালো লাগে।

হারুন পাশা: আপনি মঞ্চেই সময় কাটিয়েছেন অভিনয় করে, নেপথ্যে থেকে, টেলিভিশনে গেলেন না কেন?

রামেন্দু মজুমদার: বাংলাদেশ হওয়ার পরে বেশিরভাগ সময়ে আমি টেলিভিশনে খবর পড়েছি। তারা চাইতো যে যারা খবর পড়বে তারা যেন নাটক না করে, সেটা একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। আমার আগ্রহও খুব বেশি ছিল না টেলিভিশন নাটকের প্রতি। মঞ্চনাটক আমার সত্তার অর্ধেকজুড়ে আছে। যতদিন শরীরে কুলায় করব আশা করি।

হারুন পাশা: মঞ্চনাটক বিকাশে আপনার অবদান রয়েছে। কেন প্রয়োজন অনুভব করলেন মঞ্চনাটক বিকশিত করা প্রয়োজন?

রামেন্দু মজুমদার : নাটকের মধ্যে মঞ্চ নাটকের যে প্রভাব বা মঞ্চনাটক করে অভিনেতারা যে আনন্দ পায় সেটি হলো তারা সরাসরি দশর্কের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। নাটকটি মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়, এই নাটকের মধ্য দিয়ে সহজেই কোনো বিষয় বা বক্তব্য মানুষের দ্বারে পৌঁছায়; এজন্য আমরা মনে করি এ নাটকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প মাধ্যম।

হারুন পাশা: চলচ্চিত্রে তেমন বড় চরিত্রে আপনাকে পাওয়া যায়নি।

রামেন্দু মজুমদার: চলচ্চিত্রের প্রতিও আমার আগ্রহ নেই। এক নম্বর কথা হচ্ছে যে, ওখানে প্রচুর সময় দিতে হয়। তবে সেরকম যদি ভূমিকা হয়, আমার করার কিছু থাকে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই অভিনয় করবো।

হারুন পাশা: দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর মঞ্চ নাটকে কাজের অভিজ্ঞতা আপনার। আমরাও এই অভিজ্ঞতার অংশীদার হতে চাই।

রামেন্দু মজুমদার : এটি তো এভাবে বলা মুশকিল; আমাদের সময় ওয়ার্কশপ বা শেখানোর কেউ ছিল না। আমরা জ্যেষ্ঠদের দেখে শিখতাম, মহড়ার মধ্য দিয়ে শিখতাম। এখন তো অনেক স্কুল আছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার সুযোগ আছে, ওয়ার্কশপ করানো হয়। সুতরাং এখন অনেক বেশি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, অনেকেই যেমন মনে করেন, নাচতে গেলে নাচ শিখতে হয়, গাইতে গেলে গান শিখতে হয়, নাটক করতে গেলেও কিছু করতে হয়, বিষয়টি তেমন নয়। নাটকের জন্যও প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।

মঞ্চ নাটক সম্পর্কে প্রত্যাশাটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। কোনো দলে যোগ দিলে, কেন দিচ্ছি, আমার প্রাপ্তি কী, পরিষ্কার হতে হবে। তবে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যেটি মনে হয়েছে, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের বিকল্প নেই। চর্চা করলে সাফল্য আসবে।

হারুন পাশা: আমাদের সংস্কৃতিতে বিশেষত নাটক, চলচ্চিত্রে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন কতটুকু ক্ষতিকর এবং তা রোধে করণীয় কী বলে মনে করেন?

রামেন্দু মজুমদার: এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো নিজের সংস্কৃতিকে বেগবান করা। আমি যদি আজকে ভালো অনুষ্ঠান করতে পারি তাহলে অবশ্যই দর্শক বিদেশের অনুষ্ঠান না দেখে আমাদের অনুষ্ঠান দেখবে। সুতরাং আমাদেরও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অবস্থান নিতে হবে। সেজন্য আমাদের সংস্কৃতির যে শক্তিগুলো আছে, সেগুলোকে আরো বলবান করে ছড়িয়ে দিতে হবে।

হারুন পাশা: গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গেও আপনি জড়িত। এই আন্দোলনের প্রয়োজন কেন হলো?

রামেন্দু মজুমদার: অনেক দল আছে যেগুলো অসংগঠিত, আমরা মনে করলাম সবাই মিলে একটি প্লাটফর্মে আসা দরকার, যেখানে দলগুলোর অভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারবো, সমস্যার সমাধান দিতে পারবো, তাতে বাংলাদেশের নাটকের মান উন্নত হবে। সেই লক্ষ্য থেকেই গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন করি।

হারুন পাশা: লক্ষ্যগুলো কী পূরণ হয়েছে?

রামেন্দু মজুমদার: শিল্পের উন্নয়নের দিকটি হয়তো ততটা হয়নি, যেটুকু হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়তো ফেডারেশনের মাধ্যমে করা গেছে।

হারুন পাশা: আপনার হাতেই গড়ে ওঠে ‘থিয়েটার’ নাট্যদল। এই নাট্যদল গঠনের পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল?

রামেন্দু মজুমদার: স্বাধীনতার পরপর আমরা চেয়েছিলাম দুটি কাজ করতে। একটি হলো নিয়মিত নাট্যচর্চা করতে এবং টিভিরূপ দিতে, আরেকটি হলো একত্রিত হওয়া। সে লক্ষ্যেই আমরা এই নাট্যদল গড়ে তুলি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তারপর আব্দুল্লাহ আল মামুন যুক্ত হলেন। নিয়মিতভাবে যাতে সৎ নাট্যচর্চা করা যায় এবং নাটক যাতে নিয়মিত শিল্প মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় সে লক্ষ্যেই থিয়েটার নাট্যদল গঠিত হয়। তবে সময়ের প্রয়োজনে অনেক কঠিন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। যেমন আমরা সত্তরের দশকে বা আশির দশকে একজন নাট্যকর্মীর কাছে যে ধরনের সময় ও নিষ্ঠা আশা করতে পারতাম এখন বাস্তবিক কারণে তা সম্ভব হয় না। জীবন আরো কঠিন হয়েছে। টাকা-পয়সা ছাড়া এভাবে দিনের পর দিন নাট্যচর্চা চলবে বলে মনে হয় না। আমরা এটিকে ভালোবাসার থিয়েটার বলি, কিন্তু এর সঙ্গে একটি অর্থায়নের জায়গা তৈরি হতে হবে। এভাবে ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস টাকা পয়সা ছাড়া কাজ করে যাবে এটি একটি সমস্যাই তৈরি করছে।

হারুন পাশা: বর্তমানে থিয়েটারের ভেতর কোনো পার্থক্য বা পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?

রামেন্দু মজুমদার: অনেক পার্থক্য। সবচেয়ে বড় কথা হলো দর্শকের চাহিদা বদলে গেছে। চাহিদা অনেক বেড়েছে। ফলে যে নাটকগুলো দিয়ে আমরা দর্শকদের তৃপ্ত করতে পারতাম, এখন আর তা হচ্ছে না। সুতরাং সেই জায়গাগুলো আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে, দর্শকের চাহিদার পরিবর্তনের প্রতি খেয়াল রেখে সে অনুযায়ী নাটক তৈরি করতে হবে। আমাদের মঞ্চ নাটকের কাছ থেকে দর্শক সবসবময় সত্য কথা প্রত্যাশা করে, মঞ্চ থেকে সবসময় সত্য উচ্চারিত হোক- এটি দর্শক চায়।

হারুন পাশা: ‘থিয়েটার স্কুল’ প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্পটা কেমন?

রামেন্দু মজুমদার: যে সময় আমরা থিয়েটার স্কুল প্রতিষ্ঠা করবো সেসময় আমরা চিন্তা করলাম যে, নাটকের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ। আমরা ভাবলাম, এর বাইরে নাটকের বেসিক জিনিসগুলো নিয়ে আমরা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি। পারলে একটা ভালো কাজ হবে। সে লক্ষ্য থেকেই আমরা এনএসডি এবং  রবীন্দ্রভারতীর সিলেবাস আনালাম এবং সেখান থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুন এক বছরের একটা সিলেবাস তৈরি করলেন। আমরা জোর দিলাম এক বছর মেয়াদী অভিনয় জীবন বিষয়ক সার্টিফিকেট কোর্স। যেখানে সত্তর ভাগ থাকবে প্রাকটিক্যাল এবং ত্রিশ ভাগ থিওরিটিক্যাল। নাটকের বিভিন্ন দিক নিয়ে যাতে আমরা প্রাথমিক ধারণা নিতে পারি।

এরপর আমরা ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করি ‘থিয়েটার স্কুল’। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পঁচিশ বছর আমরা এক বছর মেয়াদী কোর্সটা চালিয়েছি। আমরা দেখলাম প্রথম দিকে ছেলেমেয়েদের খুব উৎসাহ থাকে। প্রথম বছর আমরা প্রায় দুইশ’ আড়াইশ’ আবেদনপত্র পেয়েছিলাম। সেখান থেকে দুটি সেকশনে আমরা ত্রিশ, ত্রিশ ষাটজন ভর্তি করিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে আস্তে আস্তে আগ্রহ কমতে থাকে। আমরা একটা সেকশন করলাম। তার পরবর্তীকালে আমরা দেখলাম এক বছরের কোর্স করতে ছেলেমেয়েদের খুব একটা আগ্রহ নেই। এর মধ্যে আমরা সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস করলাম। আজকাল ঢাকায় যে সংকট তাতে যাতায়াতের একটা সমস্যা থাকেই।

এ দুটি বিষয় বিবেচনা করে আমরা গ্যাপ দিয়ে এ বছর ছয় মাসের একটা কোর্স চালু করেছি। ঐ কোর্সটাকে ছোট করে আমরা ছ’মাসের কোর্স করেছি এবং সপ্তাহে তিন দিনের জায়গায় দুদিন করেছি, কিন্তু ক্লাসের সময়টা বাড়িয়ে দিয়েছি। দিনে চার ঘণ্টা ক্লাস করে দিয়েছি। বাস্তব সমস্যা দেখেই আমরা স্কুলটাকে এগিয়ে নিতে চাই। এর মধ্যে বড় সংকট হলো আমাদের কোনো স্থায়ী জায়গা নেই।

হারুন পাশা: থিয়েটার নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করলেন। সেবছর ‘থিয়েটার’ পত্রিকাও প্রকাশ করলেন নিজের সম্পাদনায়। পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা কেন অনুভব করলেন?

রামেন্দু মজুমদার : ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা যখন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করি তখন আমাদের সামনে দুটি লক্ষ্য ছিল। একটা হলো নিয়মিত নাটকের চর্চা করা, আরেকটি হলো একটা নাটকের পত্রিকা বের করা। আমার বরাবরই পত্রিকা প্রকাশনার দিনে একটা ঝোঁক ছিল। আমি যখন চৌমুহনী কলেজে অধ্যাপনা করতাম তখন আমার একটা ইচ্ছা ছিল একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের। কিন্তু তখন ডিকলারেশন পাওয়া খুবই কঠিন ছিল, সেজন্য পারিনি। পরবর্তীকালে যখন এই সুযোগ এলো তখন আমি মনে করলাম শুধু নাটক নিয়ে কোনো পত্রিকা নেই, গল্পের পত্রিকা আছে, কবিতার পত্রিকা আছে, এমনি সাহিত্য পত্রিকা তো আছেই। সেজন্য আমি কেবল নাটক নিয়ে থিয়েটার পত্রিকার কথা ভাবলাম। এবং ১৯৭২ সালের নভেম্বরে প্রথম থিয়েটার পত্রিকা প্রকাশিত হলো। আমার বিশ্বাস ছিল এ ধরনের পত্রিকা যদি প্রকাশিত হয় অবশ্যই পাঠকদের চাহিদা পূরণ করবে এবং পাঠকের আদর লাভ করবে; হয়েছিলও তাই। আজকে মনে করি আমার জীবনের যদি সাফল্য থেকে থাকে তাহলে সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো ‘থিয়েটার’ পত্রিকাটা চালিয়ে যাওয়া। থিয়েটার পত্রিকা আজকে ছেচল্লিশ বছরে পড়েছে। কেউ যদি বাংলাদেশের নাটকের উপর বড় ধরনের গবেষণা করতে চায় তাহলে থিয়েটার পত্রিকাটা আকরগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হবে। যতদিন আমি পারবো থিয়েটার পত্রিকাটা চালিয়ে যাব।

হারুন পাশা: প্রভাতকুমার দাস আপনার পত্রিকা নিয়ে একটা বই লিখেছেন। এটা তো বড় একটা প্রাপ্তি।

রামেন্দু মজুমদার: হ্যাঁ। আমাদের দেশে কোনো পত্রিকা নিয়ে কীভাবে গবেষণা করতে হয় এই বইটা তার একটা মডেল। তিনি একদিকে যেমন বিশ্লেষণ করেছেন পত্রিকার সব সংখ্যা। অন্যদিকে নানা ভাবে সূচি তৈরি করেছেন। লেখক ধরে সূচি করেছেন বা বিষয় ধরে সূচি করেছেন, বিজ্ঞাপনের সূচি আছে, ছবি সূচি আছে, সব কিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতে যারা পত্রিকা নিয়ে কাজ করবে তাদের জন্য এটা একটি উদাহরণ হবে যে, এভাবে পত্রিকা নিয়ে গবেষণা করতে হয়।

হারুন পাশা: বর্তমান সময়ের মঞ্চনাটক প্রসঙ্গে জানতে চাই।

রামেন্দু মজুমদার: পঁয়তাল্লিশ বছরে মঞ্চনাটকে বাংলাদেশের নব নাট্যচর্চার ধারা যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা একটা বড় প্রাপ্তি, বড় অগ্রগতি আমি বলবো। কারণ আমাদের সুযোগ-সুবিধা কম ছিল। তা সত্ত্বেও প্রচুর নাটকের দল হয়েছে। নতুন নতুন নাটক এসেছে। তরুণরা নাটকে আগ্রহী হয়েছে। অনেক নিরীক্ষাধর্মী নাটক হয়েছে। নানা বিষয়ে নাটক হয়েছে। তবে এখন একটা সমস্যা হচ্ছে যে, শক্তি বা ক্ষমতার চেয়েও দল বেশি হয়ে গেছে এখন। এতো দল হয়েছে যারা হয়তো মানসম্মত নাটক উপহার দিতে পারবে না, তা সত্ত্বেও দল করে নাটকে অভিনয় করছে। এটাও একটা সংকটের জায়গা। ফলে অনেক দর্শক একটু বিমুখ হচ্ছে। তারা যদি নিন্মমানের নাটক দেখে তাদের ধারণা হয় যে বাংলাদেশের সব নাটকই বুঝি এ রকম।

হারুন পাশা: ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক বছরের বক্তৃতা-বিবৃতির সংকলন গ্রন্থ আপনার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। সত্তর সালের নির্বাচন থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সময়টুকু কি জানা সম্ভব এ সংকলনের মধ্য দিয়ে?

রামেন্দু মজুমদার : আমি প্রত্যেকটা ভাষণ বা বিবৃতির আগে নোট দিয়েছি। যাতে করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কেউ বুঝতে পারে। এ বক্তৃতা-বিবৃতি থেকেই বোঝা যাবে বঙ্গবন্ধু কীভাবে একটা জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। খুব সতর্কভাবে গণতান্ত্রিক পন্থায় যাতে তাঁকে কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে না পারে। আমি তাঁকে মানব দরদী মানুষ হিসেবে, বড়মাপের নেতা হিসেবে দেখেছি। আমরা যে অসাম্প্রদায়িক চর্চার কথা বলি এবং আমরা মুখেই বলি, বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা প্রমাণ করেছেন জীবনাচারণে।

হারুন পাশা: আপনার ‘একুশের নাটক’ প্রবন্ধে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে এসেছে- ‘কবর’ ছাড়া ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে আর সার্থক মঞ্চ নাটক হলো না কেন? এ প্রশ্নটি আমাদেরও।

রামেন্দু মজুমদার: এর উত্তর আমার জানা নেই। হয়তো একটা উত্তর হতে পারে, যখন একটা বিষয় নিয়ে খুব ভালো একটা নাটক লেখা হয়ে যায়, যেটা হয়েছে ‘কবর’ নাটকে, তখন অন্যরা হয়তো লিখতে গিয়ে ভাবে, কবরের চেয়ে একটু ভালো মানের হতে হবে, সেই কারণে হতে পারে।

হারুন পাশা: দীর্ঘদিন ধরেই নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে না। তরুণ নাট্যকার খুব বেশি দেখা যায় না, যেমন কথাসাহিত্য, কবিতায় রয়েছে? এর পেছনে কী কারণ আছে বলে মনে করেন?

রামেন্দু মজুমদার: নাটকে তরুণরা এগিয়ে আসছে না। না আসার কারণ আমিও বুঝি না। কারণ নাটকের তো চাহিদা আছে। আমরা চাইবো যারা লেখক আছেন, তারা যেন মঞ্চের সঙ্গে একটু যোগাযোগ রাখেন। আমার একটি বিষয় মনে হয়, দলগুলোর মধ্যে যদি কারো লেখার হাত থাকে তাহলে তাকে নাটক লেখার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা দরকার। নাটক লিখতে গেলে অবশ্যই মঞ্চ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়