ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নয়ন সমুখে তুমি নাই

এম মতিউর রহমান মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৪, ১১ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৮:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০২০
নয়ন সমুখে তুমি নাই

শূন্য আত্রাই রানীনগরকে পূর্ণ করা ইসরাফিল আলম এমপি’র অকাল প্রয়াণে অন্ধকার আত্রাই রানীনগরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। তিনি রাজনৈতিক মানুষ হলেও ছিলেন সংস্কৃতিপ্রাণ। সম্পাদনা করেছেন আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র জার্নাল। নিরলস সাহিত্য সাধনা করেছেন।

মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ১৭ তারিখ সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে গান গাইতে বসে আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘মামুন আমি কি আগের মতো গান গাইতে পারছি?’ বললাম- না। কিছু সময় নীরব থেকে বললেন, ‘শরীরের যে পরিস্থিতি কী হবে জানি না, যদি কিছু হয়েই যায় পতিসরে তুমি তোমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে। একমাত্র তুমি পারবে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের পতিসরে আমার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিতে।’

তাঁর অকাল মৃত্যুতে পতিসর কি অন্ধকার হবে? বললাম এজন্য যে, রবীন্দ্রনাথের জন্ম, মৃত্যুদিবসে তিনি যে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন তা আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কে আর রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্যদের পতিসরে অতিথি করে নিয়ে আসবেন? কে আর শান্তিনিকেতনে শিল্পীদের নিজ খরচে পতিসরে এনে অনুষ্ঠান করবেন? কে আর ফোন করে বলবে, ‘আমরা এখনো রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ  ২২ শ্রাবণ সরকারিভাবে শুরু করতে পরিনি। নিশ্চয়ই আমাদের ব্যর্থতা, তাই তোমাকে এবার  অনেক ভালো করতে হবে।’

পতিসর রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রহশালা উদ্বোধন করছেন ইসরাফিল আলম এমপি

হার্টের অসুস্থতা নিয়ে তার এমন জিজ্ঞাসা হয়তো আমাকে আজীবন কাঁদাবে। কতটা সাহিত্যপ্রাণ ছিলেন এই সাংসদ তার একটি উদাহরণ বলতে পারি- ২০১৬ সালে ১০ মে বাংলা একাডেমির মাঠ পর্যায়ে গবেষণা প্রোগ্রাম ছিল পতিসরে, স্থানীয় আয়োজক হিসেবে সেই বিষয় নিয়ে একাডেমিতে শামসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আলোচলায় অতিথি হিসেবে  বহু গুণীজনের নাম এলো; বিশেষ করে স্থানীয় এমপি ইসরাফিল আলম, প্রফেসর ড. সনৎ কুমার সাহা, প্রফেসর ড. জুলফিকার মতিন, বাংলা একাডেমির  দু'জন গুণী পরিচালক। আলোচনার মূল বিষয়  নির্ধারণ করা হলো রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষা ও সমাজ ভাবনা।’

আমাকে কাছে পেলে শামসুজ্জামান স্যার  প্রায়ই পতিসর ও ররীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করতেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রাথের দীর্ঘ ৪৬ বছরের পতিসরে আসা-যাওয়া এবং সাহিত্য কর্মের বাইরে যে গ্রামোন্নয়ন, আধুনিক সমাজ গড়ন, শিক্ষা, কৃষি ও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছিলেন তা থেকে শত বছর পরে কতটুকু আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি এমন বিষয়। রবীন্দ্রনাথের কৃষিসমবায় ব্যাংকের যে লেজার বই উদ্ধার করে সরকারকে দিয়েছি তার যথাযথ সংরক্ষণ ও পতিসরে কৃষি বিশ্ববিদ্যায় স্থাপনের গুরুত্ব আলোচনায় উঠে আসতো। ৩ মে ২০১৬ বাংলা একাডেমিতে স্যারের সঙ্গে পতিসরের অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলছিলাম, আলোচনার মাঝে আমার ফোনটা বেজে উঠলো, দেখলাম রবীন্দ্র জার্নালের সম্পাদক, শ্রদ্ধাভাজন সাংসদ ইসরাফিল আলম। আমাকে বললেন, ‘জানি তুমি ব্যস্ত, ধৌর্য এবংআন্তরিকতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাও, মনে রাখবে রবি ঠাকুরের জন্ম মানেই বাঙালির জন্ম। আর একটি বিষয় তুমি আমাকে পরিষ্কার করে বলো, হাতে কলম নিয়ে বসে আছি , ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসর হাইস্কুলের ছাত্র-শিক্ষদের উপদেশ দিয়ে আর্শিবাণীতে কি যেন লিখেছিলেন? ঐ যে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক নির্যাতন না করতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের উপদেশ দিয়েছিলেন’।

আমি কোনো কিছু না ভেবেই ফোনেই বলতে শুরু করলাম, ‘রথীন্দ্রনাথের নাম চিহ্নিত কালীগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্বন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্য্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয়— এই আমার উপদেশ। শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম— একথা সর্বদা মনে রাখা উচিত। এরূপ শিক্ষাদান প্রণালী— শিক্ষকদের পক্ষে আত্মসম্মানের হানিজনক। সাধারণত আমাদের দেশে অল্পবয়স্ক বালকগণ প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষকদের নির্মম শাসনের উপলক্ষ্য হইয়া থাকে— একথা আমার জানা আছে। সেই কারণেই সতর্ক করিয়া দিলাম।’

পতিসর দেবেন্দ্র মঞ্চে ইসরাফিল আলম এমপি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর ড. সুনিত কুমার ও প্রাক্তন উপাচার্য স্বপন কুমার দত্তকে উপহার তুলে দিচ্ছেন লেখক

আমার খেয়াল ছিলো না, আমরা আলোচনা করছিলাম, সেখানে ছিলেন একজন সচীব, আধ্যাপক গবেষকসহ আরও কিছু গুণী মানুষ। স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন কে ফোন করেছিল? আমি বললাম ‘এমপি ইসরাফিল আলম।’ স্যারের দু'চোখ ছলছল করছিল। কিছু সময় নীরব থেকে বললেন, ‘আমাদের দেশ এবার অনেক এগিয়ে যাবে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন? স্যার বললেন, ‘একজন সংসদ সদস্য যখন ফোনে সাহিত্যচর্চা করেন তার মানে বুঝতে হবে আমরা অনেক এগিয়ে যাচ্ছি।’

অজস্র ধারার বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষ ইসরাফিল আলমের সঙ্গে আমার পরিচয় পতিসরে ‘রবীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। পতিসর তখন বইশূন্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের কাচারি বাড়ির চারিদিক ছিল অবৈধ দখলদারদের হাতে জিম্মি। বাড়ির মধ্যে কার্ড ধেলা, সভা সমাবেশ, বারান্দায় রীতিমত চলতো চাল-ডাল বিক্রি, নিচে মাছের আড়ৎ। ঠিক এমন যখন পতিসর তখন সাহিত্য পরিষদের জন্য প্রায় লক্ষাধিক টাকার বই, হারমোনিয়ানসহ তাঁর প্রিয় সাংবাদিক বন্ধু দিনেশ দাসকে নিয়ে পতিসরে এসেছিলেন ইসরাফিল আলম। তিনি সর্বদা হাস্যজ্জল ছিলেন। কখনো নেতা-কর্মীদেব সঙ্গে রেগে কথা বলতে দেখিনি। বরং নেতা-কর্মী যত রেগেই যাক মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতেন। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা শুনেছেন মন দিয়ে। তাদের দুঃখ, কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছেন। আত্রাই রানীনগরে নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকেছেন। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সর্বহারা মুক্ত আত্রাই-রানীনগর গড়ে তুলে জননেতা মো. ইসরাফিল আলম মানুষের মনের মাঠে আছেন, থাকবেন।

আত্রাই রানীনগরে অন্ধকার দূর করে আলো এনে দিয়েছেন তিনি। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ইসরাফিল আলম গুণী রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক এবং শিল্পী। তিনি গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার হাতের ছোঁয়ায় রবিতীর্থ পতিসরে উন্নতি হয়েছে, বহু কাজের পরিকল্পনা করেছিলেন। গণমানুষের চাওয়া তিনি পূরণ করেছেন। তাঁর অকাল প্রয়াণে আত্রাই রানীনগরে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ হবে না। তাঁর সৃষ্টির মাঝে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

লেখক: রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রহশালা

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়