ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গণমানুষের হৃদয়ে শেখ মুজিব

শেখ আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১৬ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৮:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০২০
গণমানুষের হৃদয়ে শেখ মুজিব

১৯৪৭ সালে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে একটি দেশের সৃষ্টি হলো! ধর্ম ছাড়া পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। দুই প্রান্তের মানুষের ভাষা, কৃষ্টি, খাদ্যাভাস, মননশীলতা, শিল্প-সংস্কৃতি এমনকি প্রকৃতিও ছিল ভিন্ন। তারপরও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো অচিরেই।

দেশভাগের পর থেকেই বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কল্পনাতীত বৈষম্যমূলক আচরণ, অবর্ণনীয় শোষণ প্রকট হতে শুরু করলো। মোহ ভঙ্গ হলো অনেকের। পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। গণমানুষকে সংগঠিত করলেন। স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধাঁচের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব। স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি অদম্য। ফলে বাঙালির স্বাধীনতার দাবি আদায়ের আন্দোলন বেগবান হলো। এরপর বহু আন্দোলনের পথ ধরে এলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর সেই ভাষণ বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করলো। স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আর কোনো দ্বিধা রইল না। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক সেই ভাষণকে মূলমন্ত্র করেই হলো নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম। এলো স্বাধীনতা।  

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হলো। সদ্য স্বাধীন জাতি তার পিতাকে হারালো। দেশ হলো অভিভাবকশূন্য। কেনো এমন হলো? এর অনেক কারণের অন্যতম হলো তিনি একটা জালের মধ্যে আটকা পড়েছিলেন। দেশের ভেতরে এবং বাইরে চক্রান্তের জাল। স্বাধীন বাংলাকে নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আজ কোনো কল্পনা নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল? সম্প্রতি অবমুক্ত করা মার্কিন সরকারের কাগজপত্রে তা স্পষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি যুক্তরাষ্ট্রের অহমিকায় ছিল বড় আঘাত। আর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার জন্য ছিল অন্তহীন দুঃস্বপ্ন। এই দুই দেশের তখন গলায় গলায় ভাব। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় চীন। ১৯৭১-এর জুলাইয়ের শুরুর দিকে, চীনের বেইজিংয়ে, হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন সফরের সময় বিপরীত শক্তির সিদ্ধান্ত হয়- প্রথম সুযোগেই মুক্তিযুদ্ধের বদলা নেওয়া হবে বঙ্গবন্ধুর উপর।

এদের সঙ্গে যুক্ত হলো দেশিয় পরাজিত অপশক্তি। আজও যে প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ইতিহাস দীর্ঘশ্বাস ফেলছে; প্রশ্নটি হলো- মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশের রাজাকার-আলবদর যে সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নেবে, বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধু বা তাঁর দলের কোনো উদ্বেগ ছিল না কেনো? এই প্রশ্নের উত্তরে এটুকু বলা যায়- ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর নিকট জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনার এতো শক্তির উৎস কোথায়? আপনার দুর্বলতাই বা কী?’ বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘আমার শক্তির উৎস, আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, আমি বাংলার মানুষকে একটু বেশিই ভালোবাসি।’

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশ চলে যায় বিএনপি এবং তাদেরই মাধ্যমে জামায়াতের হাতে। দেশ পরিণত হয় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’তে। জাতীয় জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। থেমে যায় অর্থনীতির সচল চাকা। কিন্তু শত্রুর সব চেষ্টা বিফল করে গণমানুষের ভোটে ১৯৯৬ সালে ঠিকই বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যাকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২১ বছর পরে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে শক্ত হাতে দেশের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তিনিও বাবার স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বে আধুনিক দেশ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হতে চলেছে। পরিকল্পিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছুতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় জায়গা করে নিতে যাচ্ছি আমরা। নিজস্ব অর্থায়নে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে ধাবমান বাংলাদেশ আজ সত্যিই এক প্রাণবন্ত অর্থনীতির দেশ।

বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। সামাজিক সূচকের অনেকগুলোতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ। এভাবেই দেশ আজ নানান ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে। বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এক সময় বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষ, তাচ্ছিল্য করতে দ্বিধা করতো না। সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।  

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তাঁর সেই অসমাপ্ত কাজ পূরণ হতে চলেছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। না থেকেও তিনি রয়েছেন গণমানুষের হৃদয়ে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ চিরকাল থাকবে। ততদিন থাকবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছে ফেলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

লেখক: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়