ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আঁতুড়ঘরে একদিন (ভিডিও)

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ২৭ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১১:৫৬, ২৮ আগস্ট ২০২০
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আঁতুড়ঘরে একদিন (ভিডিও)

১৪ অক্টোবর, ২০১৯। দুপুর ১২টায় কলকাতার নিউটাউনের নভোটেল হোটেলে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলন। আগের দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম হওয়ায় সল্ট লেকের সুভাষ সরোবরের পার্শ্ববর্তী হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ঘুম ভাঙতে সময় লাগলো। চোখ খুলে দেখি প্রায় ১০টা! লাফিয়ে উঠে কোনোরকমে চোখে-মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কারণ, সকালের নাস্তা করতে যেতে হবে নিউ মার্কেটের আরাফাত মুসলিম রেস্টুরেন্টে। আগের দিন রাতে ৩০০ রুপি ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে সেখানে গিয়ে গরুর মাংস আর রুটি খেয়ে এসেছিলাম- স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে!

বেশি ঘুমালে যা হয়, পিটপিট চোখে সুভাষ সরোবরের দেয়াল ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হায়াত মোড়ে চলে আসি আমি ও জয় ভাই। মোড়ে অনেক মানুষ! ট্যাক্সির সঙ্গে দরদাম মিলছে না। নিউমার্কেট যাওয়ার বাসও আসছে না সহসা। সময় বাড়ছে, হঠাৎ এক ট্যাক্সিওয়ালা বললেন, ওই বাসটা নিউমার্কেট যাবে। বলতে দেরি; হাওয়ার বেগে ছুটে গিয়ে বাসে উঠতে আমাদের দেরি হলো না। উঠে জিজ্ঞেস করলাম, নিউমার্কেট যাবে তো? জি দাদা, বছুন— কন্ডাক্টর বললেন।

ভাড়া নিতে আসার সময় কন্ডাক্টরকে বললাম, আজাদ কলেজের রাস্তার মুখে নামিয়ে দেবেন। হালকা জ্যাম ও গরম— ঘুমের তেজ তখনো দমেনি। ঢুলুঢুলু ঘুমে মাথা দুলছিল বাসের সঙ্গে। হঠাৎ চোখ খুলে বললাম, আসছে নাকি দাদা আজাদ কলেজ? কেউ একজন বলল, হ্যাঁ নেমে পড়ুন। একপ্রকার লাফিয়ে নেমে পড়লাম। ওমা একি! এটা তো রাতের সেই রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড নয়? তাহলে কি আগেই নেমে পড়লাম? যা আশঙ্কা করেছি তাই। এবার হাঁটো! হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়লো একটি ফলক। সেখানে লেখা:  
‘এখান থেকে কয়েক পা গেলেই পাওয়া যাবে
৩/৪সি, তালতলা লেনের বাড়ি সেখানে কবি
নজরুল রচনা করেন তাঁর যুগান্তকারী কবিতা
‘‘বিদ্রোহী’’
তালতলা নজরুল জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি
২৪ শে এপ্রিল, ১৯৯৯’

যেহেতু তাড়া ছিল, যাওয়ার সুযোগ পাইনি। একবার চোখ বুলিয়ে ছুটলাম আরাফাত রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। মনে মনে ভেবে রাখলাম, কাল সকালে নাস্তা করতে আসার সময় একবার যাবো সেখানে।  

পরদিন যথারীতি আবার গেলাম। ওমা! সেই ফলক যে আর খুঁজেই পাই না। তাজ্জব ব্যাপার! কয়েকজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা চেনেন না নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা লেখার সেই বাড়ি। একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরলাম। দেখলাম একটা লোক পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে পত্রিকা পড়ছেন। ভাবলাম তিনি হয়তো জানবেন। কিন্তু তিনিও অপারগতা প্রকাশ করলেন। অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন- সোজা পূর্বদিকে যান। পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই ফলক!

অল্প হেঁটেই পৌঁছে গেলাম। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ার সময় ভেতরে যে উদ্যোম ও তেজ বুঝতে পারতাম তেমন অনুভব করছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি একই রকম দুটো বাড়ি। তাহলে কোনটায় বসে নজরুল বিদ্রোহী কবিতা লিখেছিলেন? একটু পরেই অবশ্য দেখতে পেলাম সেই বাড়িটির গায়ে একটি ফলকে লেখা রয়েছে:
‘চির যৌবনের প্রতীক কবি নজরুল ইসলাম
তাঁর জঙ্গম জীবনের কিছুকাল (১৯২১-২২)
অতিবাহিত করেন এই প্রাঙ্গণের ভিতর ৩/৪সি, তালতলা
লেনে। এখানেই রচিত হয় তাঁর বাঁধন হারা কবি মনের
প্রথম উদ্দাম উচ্ছ্বাস ‘‘বিদ্রোহী’’ কবিতা।
‘‘তালতলা নজরুল জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’’
২৪ শে এপ্রিল, ১৯৯৯’

যাক অবশেষে পেলাম। কিন্তু একি? ভেতরে ঢোকার যে কোনো পথ নেই। দরজায় কলিং বেল ছিল। বহুক্ষণ বাজানোর পরও কেউ খুললো না। এবার এপাশ-ওপাশ ঘুরতে লাগলাম। দেখতে লাগলাম। ভেতরে কয়েকটা রুম আছে। কিন্তু কোনোটিতেই মানুষ থাকে না। সেগুলোতে ডেকোরেশনের জিনিসপত্র রাখা। যতটুকু বুঝলাম এই রুমগুলো ডেকোরেশনের ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে থাকা একজনকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন— সেটা তো বহুকাল আগের কথা। এরপর কমপক্ষে ২০ জনের হাতবদল হয়েছে এই বিল্ডিং। কোনো স্মৃতি এখানে নাই।’

এমন কথা শুনে হতাশ মনে ফিরে আসছিলাম আর ভাবছিলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এখনো পাঠকের রক্তে বানের ডাক দিলেও কবিতাটির আঁতুরঘর জরাজীর্ণ, স্মৃতিহীন হয়ে পড়েছে। কেবল নাম ফলক ছাড়া আর কিছুই নেই এখানে। তবুও প্রায় ১০০ বছরের মাথায় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আঁতুরঘর নিজ চোখে দেখতে পেরেছি এটাই বা কম কি? আমিও যে ইতিহাসের সাক্ষী হলাম।

 

 

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়