ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাংলার গতিময় কনে

ইশরাত তানিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ২৮ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৫১, ২৯ আগস্ট ২০২০
বাংলার গতিময় কনে

ফারহানা আফরোজ

‘মোটেই যাবো না তোর সঙ্গে ওই বাইক সফরে/ হাইওয়ে যতই ডাকুক...’

প্রত্যাখ্যানের একটা কবিতা পড়েছিলাম। ছেলেসঙ্গীর পেছনে বসা মেয়েটির অভিমান অনুভব করেছিলাম। কবিতায় বাইকযাত্রার ডিটেইল ছিল- পেছনে বসা মেয়েটি নির্ভরতায় আর পুরুষের কাঁধ ধরবে না। হঠাৎ ব্রেকে আঁকড়ে ধরবে না কোমর। সম্পর্ক থেকে সরে এসে নিজেকে সামলাচ্ছে মেয়েটি। খুব ইচ্ছে করলেও ছেলেটির কাছে সে ফিরে যাচ্ছে না। বিরহের এ এক নতুন অনুভব। কবিতাটি নতুন প্রজন্মের লাইফ স্টাইল ধারণ করে লেখা। ফলে সেখানে উঠে এসেছে নতুন ভাবনা- যে ভাবনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে মানুষ আগে যায়নি। প্রাসঙ্গিকভাবে কবিতাটি মনে পড়ল কয়েকটি নিউজ পোর্টালের হেডিং দেখে। বাইক চালিয়ে বিয়ের আসরে কনে! কে এই মেয়ে? সিনেমা স্টাইলে গায়ে হলুদ! সত্যি এক ভয়ানক বিপর্যয় নেমে এসেছে সমাজের বুকে!   

ঘটনাটি অভিনব নিঃসন্দেহে। গুগল সার্চ করলেই ঘটনার অনুপুঙ্খ জানা যায়। ইউটিউবে দেখলাম বিয়ে নয়, গায়ে হলুদের দিনে শহরজুড়ে বন্ধুদের নিয়ে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করেছে এক নারী। লিঙ্ক ওপেন করে পড়ে জানলাম- তিনি যশোরের মেয়ে ফারহানা আফরোজ। তিন বছর আগে বিয়ে হলেও অনুষ্ঠান হয়নি। সদ্য ছেলের মা হয়েছেন। বিরোধ মিটে গেছে। এবার ছেলে কোলে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্বশুরবাড়ি যাবেন। ফারহানার খুব শখ গায়ে হলুদের। মায়ের কাছে আবদার করলেন। মেয়ের ইচ্ছের কথা জেনে মা গায়ে হলুদের আয়োজন করলেন। বিয়ের উৎসব অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করে রাখতে কত কিছুই না করে মানুষ। গাটছাড়া বাঁধতে চলে যায় সমুদ্রসৈকতে, প্রাসাদে, দ্বীপে। তেমনি ব্যতিক্রমী কিছু করার চিন্তা থেকেই ফারহানা বাইক চালিয়ে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গেলেন। এতেই সমাজ সংসার কেঁপে উঠল!

হচ্ছেটা কী?

গায়ে হলুদের এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হলেন ফারহানা। ভিডিও ক্লিপিং দেখে বিরূপ মন্তব্য করল নেটিজেনরা। মানুষের ছি ছি, ধিক্কার আর হাহাকার ধ্বনিত হলো ইউটিউবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তুমুল সমালোচনা চলছে- উচ্ছৃঙ্খলতা, নারীত্বের অবমাননা, কুদৃষ্টান্ত স্থাপন, অন্যন্য নারীদের ওপর কুপ্রভাব, ধর্মীয় অনুশাসন লঙ্ঘন, সংস্কৃতির ওপর আঘাত ইত্যাদি শব্দবাণে ফারহানা আর দুই পরিবারকে ঘায়েল করার চেষ্টা এখনও অব্যাহত।      

এই ‘বেহায়া’ মেয়ের চরিত্র নিয়েও কথা উঠল। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে, পোস্টে, ইউটিউবে বিশেষ একটি ধর্মের নারীজাতির দিকে আঙুল তুলে বলা হলো- ‘দেখুন গায়ে হলুদের নামে এসব কী হচ্ছে...’, ‘শুধুমাত্র মুসলিম নারীদের উদ্দেশ্যে বলছি...’। এসব পোস্টের নিচে থিক থিক করছে ভয়ানক কুরুচিপূর্ণ, আক্রমণাত্মক সব মন্তব্য। পড়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়! ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য সেসব মন্তব্য। অনেক শিক্ষিত নারী এবং পুরুষ ফারহানার বাইক চালিয়ে গায়ে হলুদে যাবার আয়োজনটিকে ‘বেহায়াপনা’ বলেছে। নারী স্বাধীনতার নামে বাড়াবাড়ি বলে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। বাঙালি সংস্কৃতি, ইসলামী রীতি/অনুশাসন সব গেল গেল বলে শোরগোল তুলেছে। এসব রবাহুতদের মধ্যে নারীকণ্ঠ শুনে ব্যথিত হই। একজন নারী বলেছেন: ‘সমাজ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে’। দেখলাম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠা নারী নিজের অজান্তেই আদ্যোপান্ত পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায় নিজেকে মুড়ে ফেলেছে। বাইকার বধূর বিরোধীতা শেষে মিষ্টি করে সেই নারী যখন বলেন- ‘আমার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন তখন ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায়।’

সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা বলছেন, তারা আসলে পরনিন্দা-পরচর্চার ঐতিহ্য লালন করে চলেছেন। এতে অন্যের কাজে নাক গলানোর নিজস্বভাবটি যে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে লজ্জিত বা বিব্রত হওয়া এদের ধাতে নেই। আমি নিশ্চিত এরা ধর্ম, সমাজ এবং সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না। তেড়েফুঁড়ে আসাই এদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। সমাজে এদেরই সংখ্যাধিক্য। নতুন কিছু করলে সমাজের ভ্রু কোঁচকানো, চোখ রাঙানো, তাচ্ছিল্যের ঠোঁট বাঁকানোই স্বাভাবিক। ছটফট করতে থাকা সমাজ কিছুতেই একজন বিয়ের কনেকে বাইক চালকের স্থানে মেলাতে পারে না। সমাজের অস্বস্তি লাগা শুরু হয়। কিন্তু কেন? এতে  জনজীবনের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে না। তবু কেন ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই দৃশ্য সমাজের শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়?

সত্যরে লও সহজে

হাতী চড়ে, উটে চড়ে নাকি ঘোড়ায় চড়ে কেউ নিজের হলুদের অনুষ্ঠানে যাবে সেই স্বাধীনতা মানুষের আছে। সাধারণত গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ছেলেরাই বাইক চালিয়ে যায়। ফারহানা আফরোজ বাইক চালাতে পারেন। বাইক চালিয়েছেন। এটা তাঁর নিজস্ব ইচ্ছা আর পারদর্শিতার ব্যাপার। তাঁর আনন্দ উদযাপনের প্রক্রিয়া অন্যরকম হতেই পারে। স্বামী-স্ত্রীর এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। দুই পরিবারও অসম্মত নয়। কিন্তু পরনিন্দায় অভ্যস্ত সমাজ দাঁত নখ বের করে ফারহানাকে আক্রমণ করছে। বাইকে চেপে বর এলে সমাজের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক থাকত। সংস্কৃতি অটুট হতো। বাইক চালিয়ে কনে এসেছে এতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে। আপাত এ ব্যাখ্যার বাইরেও এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার আছে। এই সমাজ নারীর অধীনে রাষ্ট্রপরিচালনা দেখে অভ্যস্ত। এদেশে নারী পাইলট আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে প্লেন নিয়ে উড়ে যায়। পেশাজীবী নারী বাইকরাইডার আছে। নারী প্যাডেল চালাচ্ছে আর রিকশার চাকা ঘুরছে এ দৃশ্যও বিরল কিছু নয়। তাহলে নারী বাইক চালিয়ে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গেলে সেটা গর্হিত কাজ কেন? কেন এত অসম্মানের চোখে দেখা? বাঙালি সংস্কৃতি কেন প্রশ্নবিদ্ধ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ভাবার সময় এসেছে। 

সংস্কৃতি সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে আছে ভাষা,  জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, আচার এবং সমাজ থেকে অর্জিত অন্য যে কোনো সম্ভাব্য সামর্থ, অভ্যাস এবং অভিজ্ঞতা। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক হেলেন স্পেনসার ওটে’র মতে সংস্কৃতি হলো কিছু বুনিয়াদি অনুমান, মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী, বিশ্বাস, নীতিমালা, প্রক্রিয়া এবং আচরণিক প্রথার অস্পষ্ট সমষ্টি। যা এক দল  মানুষ ভাগ করে নেয় এবং যা সদস্যদের আচরণের ‘অর্থ’কে প্রভাবিত করে। কিন্তু নির্ধারণ করে না। সংস্কৃতির সার্বজনীন উপাদান নিয়ে একটি সমাজের স্পর্শ করা যায় না এমন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (intangible cultural heritage) গড়ে ওঠে। উপাদানগুলো হলো শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, অনুষ্ঠান, ধর্ম, প্রযুক্তি, স্থাপত্য, নিয়মনীতি, পুরাণ, দর্শন, সাহিত্য এবং বিজ্ঞান। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সংস্কৃতিও নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে ধারণা করা যায় ক্রমবর্ধমান সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা প্রায় পাঁচ লাখ বছর থেকে এক লাখ সত্তর হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছে। বিবর্তন, প্রবৃদ্ধি, নতুন ভাবনা, সংস্কার, নতুন প্রথা, রীতি উদ্ভাবন, পুনর্জাগরণ, বিপ্লব, পরিব্যক্তি, উন্নতি, বিকিরণ, আত্মীকরণ, মানসিক ঔদার্য, সমন্বয় প্রচেষ্টা, আধুনিকীকরণের মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়েছে। শুরুতেই বলেছিলাম, সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া জীবনশৈলীর কথা। নতুন অনুভূতির কথা। সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে অথচ যাপিত জীবন চেনা ছকের মধ্যে ঘুরপাক খাবে এমন ভাবনা অমূলক। সময়ে জীবনযাপন এবং দৃষ্টিভঙ্গী বদলে যায়। বদলে যাবার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেও মানুষ পরিবর্তনকে সহজভাবে নিতে পারে না। গতের বাইরে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে প্রাথমিকভাবে সেটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। এই অপ্রচলই এক সময়ে প্রচলিত হয়।

গতিতে জীবন মম 

সমাজের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলেই বাইকার বধূকে ছিছিক্কারের কারণ স্পষ্টতর হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে লাজরাঙা কনেই মানানসই। জাঁকজমক সাজসজ্জায় শাড়ি-গয়নায় নাকানিচুবানি খাওয়া, কাঁদোকাঁদো, বিব্রত, নম্র, কিছুটা যেন অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে থাকবে কনে। সেটাই নিয়ম। এতে কনের গৌরব বাড়ে। সমাজ স্বস্তিতে থাকে। পুরুষ নিরাপত্তাবোধ করে। বাইক গতির প্রতীক। আজীবন দেখে যাওয়া জুবুথুবু কনেটি যখন ভিন্ন দৃশ্যের অবতারণা করে তখন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আঘাত পায় বৈকি! মেহেদি রাঙানো হাতে চাবি ঘুরিয়ে বাইক স্টার্ট দেওয়া, শক্ত হাতে হ্যান্ডেলবারের গ্রিপ চেপে ধরা, লেহেঙ্গা পরে খোলা হাওয়ায় উদ্দাম গতিতে বাইক নিয়ে সাবলীলভাবে এগিয়ে যাওয়া। মেয়েটার মাঝে পুরুষ পুরুষ ভাব দেখা যাচ্ছে! কারণ শক্তিমত্তার সঙ্গে পুরুষ শব্দটিই তো যায়! স্ত্রীলিঙ্গ নৈব নৈব চ। এমন দৃশ্য দেখে রক্ষণশীল মানুষের মনে অজান্তেই একটা বড় ধাক্কার এফেক্ট তৈরি হয়েছে। অজান্তে বললাম কারণ বাইকের গতিশীলতা দেখা গেলেও গতিময়তায় মিশে থাকা নারীর অবাধ স্বাধীনতা, ইচ্ছেয় বাঁচা, প্রথার বাইরে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা এসব দর্শনযোগ্য ব্যাপার নয়; অনুভবের। নতুন এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সমাজ নতুনভাবে অনুভব করছে নারী স্বাধীনতার এক ভিন্নচিত্র। নারীর বদলে যাওয়া জীবনশৈলী।   

পুরো ঘটনায় তবু স্বস্তির সুবাতাস এইটুকু যে, অনেকে বিষয়টি ইতিবাচকভাবেও দেখছেন। কেউ কেউ যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করেছেন মাস্কহীন, হেলমেটহীন বাইক চালানোর। কোভিড মহামারির দিনে সামাজিকভাবে জনসমাগম ঠিক নয় বলে যেমন সোচ্চার হয়েছেন, তেমনি ফারহানার সাহস আর শক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। পুরুষ যা করতে পারে, বুদ্ধিতে শক্তিতে নারীও সেটা করতে পারে। মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। মানুষ আরো মানবিক এবং উদার হয়ে উঠুক। নারীশক্তির জয় হোক।

* এভাবেই শেকল ভাঙুক তবে

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়