ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

যেখানে নারীর দুধে বেড়ে ওঠে হরিণ শাবক

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:০৭, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
যেখানে নারীর দুধে বেড়ে ওঠে হরিণ শাবক

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পটির কথা পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে। মহেশের প্রতি গফুরের অকৃত্রিম ভালোবাসা এই গল্পের উপজীব্য। গল্পটি পড়ার পর যে কোনো পাঠক পোষা প্রাণীর প্রতি গভীর মমত্ব অনুভব করবেন। 

‘মহেশ’ গল্প ছিল বটে কিন্তু বাস্তবে এমন প্রাণীপ্রেমের নিদর্শন দেখা যায় ভারতের রাজস্থানে বিষ্ণৈ আদিবাসীদের মধ্যে। প্রাণীকুলের জন্য তাদের রয়েছে গভীর মমত্ব। সেখানকার মিথ অনুসারে, রাজস্থানের যোধপুরে বসবাসকারী বিষ্ণৈরা দেবতা জাম্বেশরের ২৯টি নির্দেশ মেনে চলেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো হরিণ শাবককে নিজ সন্তানের মতো বুকের দুধে প্রতিপালন করা। এজন্য বিষ্ণৈ নারীরা হরিণ শাবককে বুকের দুধ পান করিয়ে লালন পালন করেন।

এই যোধপুরেই হরিণ হত্যার দায়ে বলিউড স্টার সালমান খানকে জেলে যেতে হয়েছিল। অভিযোগ তিনি ১৯৯৮ সালের ১ ও ২ অক্টোবর রাজস্থানের যোধপুরের কাছে কানকানি গ্রামে দুটি কৃষ্ণসার প্রজাতির হরিণ শিকার করেছেন। ভারতের একটি আদালত ২০১৮ সালে এ কারণে তাকে পাঁচ বছরের জেল এবং দশ হাজার রুপি জরিমানা করে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতি। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবন ধারার মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। এমনই একটি বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায় বিষ্ণৈ। এই সম্প্রদায়ের নারীরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হিসেবে সন্তানদের পাশাপাশি অনাথ কিংবা হরিণশিশুকে বুকের দুধ পান করান।

টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিষ্ণৈ গৃহবধূ মাঙ্গি দেবী বলেন, ‘হরিণশিশু আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওরা আমাদের সন্তানের মতো। আমাদের কোলে তারা সন্তানের মতোই বেড়ে ওঠে। আহত, অসহায় হরিণ শাবক দেখলে আমাদের মন কেঁদে ওঠে। দলছুট শাবক নিজের কাছেই রেখে দেই আমরা। এরপর সন্তানের মতো লালন পালন করি।’

আরেক গৃহবধূ রোশিনি বিষ্ণৈ বলেন, ‘আমাদের কাছে হরিণশিশুরা কখনও অনাথ নয়। ওরা আমাদের চারপাশে আমাদের সন্তানের মতোই থাকে, সন্তানের মতোই বেড়ে ওঠে।’ 

বিষ্ণৈদের ধর্মীয় মিথ অনুসারে ‘প্রকৃতিকে তারা দেবজ্ঞানে পূজা করে। আর সেই প্রকৃতির সন্তান হলো হরিণশিশু। প্রকৃতি রক্ষা এবং প্রকৃতির সন্তানদের বিশেষ করে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের প্রতিপালন করা নিজেদের ধর্মীয় কাজের অংশ হিসেবেই তারা মনে করে। তাদের পূজনীয় দেবতা বা গুরু জাম্বেশ্বর। গুরুর মতে, সব সৃষ্টির মধ্যেই স্বর্গীয় শক্তি বিদ্যমান।

জানা যায়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বাস করছে বিষ্ণৈ সম্প্রদায়। তারও আগে তারা বন-জঙ্গলে বাস করতো। বনভূমির সংকট দেখা দিলে রাজস্থানের যোধপুরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে প্রায় ২০০০ পরিবারের একটি সম্প্রদায় সেখানে বাস করছে। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয় বিষ্ণৈ শিশুরা। শুধু তাই নয়, কেউ যাতে প্রকৃতির সন্তানদের হত্যা করতে না পারে এজন্য প্রাণীহত্যা বন্ধে বিষ্ণৈদের আছে বিশেষ একটি বাহিনী। নাম ‘বিষ্ণৈ টাইগার ফোর্স।’ রোশিনি বিষ্ণৈ এই সম্প্রদায়ের এক যুবক। রোশিনি বলেন, ‘আমি ওই ছোট হরিণগুলোর সঙ্গেই বড় হয়েছি। ওরা আমার ভাইবোনের মতো। ওদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করা আমাদের পারিবারিক দায়িত্ব। ওরা আমাদের ভাষাও বোঝে।’ 

ইতিহাস বলছে, বিষ্ণৈ সম্প্রদায় খেজুর গাছ বাঁচাতে ১৭৩০ সালে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন ৩৬৩ জন বিষ্ণৈ যুবক।  

ঢাকা/ফিরোজ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়