ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রবাসীদের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:২৫, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
প্রবাসীদের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে

টিকিটের জন্য প্রবাসীদের ভিড়

‘প্রবাসী’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই ঘর্মক্লান্ত অথচ কর্মঠ একদল মানুষের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভালো থাকার আশায় সবাইকে ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমান। অজানা-অচেনা সেসব দেশে প্রতি পদক্ষেপে শঙ্কা থাকে। অচেনা ভাষা, কঠিন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অনেক বঞ্চনা স্বীকার করে, প্রিয়জনের মায়া ভুলে, প্রিয় দেশ ছেড়ে একটু স্বচ্ছলতার আশায় কষ্টের সাগরে ভেলা ভাসান তারা।

এই মানুষগুলোর রক্ত পানি করা টাকায় অনেক পরিবারে স্বচ্ছলতা আসে। অনেকের মুখে হাসি ফোটে। প্রিয়জনদের ভালো রাখতে পারার সেই সুখ বুকে নিয়ে হাজারো কষ্ট ভুলে থাকেন তারা। স্বপ্ন দেখেন দেশে ফিরে জমানো টাকায় নতুন করে জীবন গড়বেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে আরেকটু ভালোভাবে থাকবেন।

এই কষ্টের টাকায় তারা যে শুধু পরিবারকে ভালো রাখছেন তাই নয়, দেশকেও এগিয়ে নিতে সাহায্য করছেন। সরকারি হিসাব মতে ১৭২টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার রয়েছে। প্রতি বছর সেসব দেশে সরকারিভাবে ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ যাচ্ছে। এদের বেশিরভাগই অদক্ষ শ্রমিক হিসেবেই যাচ্ছেন। তারপরও তারা কাজ করতে পারছেন এবং রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।

১৭২টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার থাকলেও সাতটি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি সবচেয়ে বেশি। দেশগুলো হলো- সৌদি আরব, ওমান, কাতার, বাহারাইন, জর্ডান, সিঙ্গাপুর, রোমানিয়া। এছাড়া কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি আছেন। অনেকে এসব দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন এবং কাজ করছেন। তারা সরকারি হিসেবের বাইরে। এছাড়া ইউরোপের দেশগুলোতেও প্রচুর বাংলাদেশি রয়েছেন। দেশের রেমিটেন্স প্রবাহে তাদের অবদানও কম নয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাসে (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি) প্রবাসীরা সব মিলিয়ে এক হাজার ৩০ কোটি (১০.৩৬ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। এর আগে গত পাঁচ বছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে সাত হাজার ৪৪১ কোটি ৫৯ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ছয় লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা (১ ডলার সমান ৮৮ টাকা ধরে)। যা দেশের চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়েও বেশি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব আমাদের অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই প্রবাসীদের শ্রমিক হিসেবে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরেছেন। তাদের অনেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন; তারা ছুটি শেষ হলেই ফিরে যাবেন। ইতোমধ্যে যাদের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে নানা জটিলতায় পড়ে তারা কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। তাই কাজ হারানোর শঙ্কা ভর করেছে তাদের মধ্যে। একই কারণে অস্থির হয়ে পড়েছেন তারা। শুধু তারা নন, বাংলাদেশও শ্রমবাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে।

ইতোমধ্যে সৌদি আরবে থাকা প্রবাসীরা সেখানে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও বিমানের টিকিট, করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট না-পাওয়াসহ বেশ কিছু জটিলতায় পড়েছেন তারা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আরও ২৪ দিন মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে। তবে নতুন সমস্যা হিসেবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সৌদিগামী বিমানের টিকিট। সোনার হরিণ এই টিকিট পেতে কারওয়ান বাজারে সড়ক আটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তবে ধীরে ধীরে সে জট খুলছে। জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলেও বিশ্বাস করেন তারা। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, ‘সৌদি আরবের সব ধরনের বিমান যেনো ঢাকায় আসে এবং সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের যাওয়ার সুযোগ দেয়, সেই অনুরোধ জানানো হয়েছে সৌদি আরবকে।’

তবে সৌদি আরব যে অনুরোধ রাখবে এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ, ইতোমধ্যে দেশটি নতুন একটি ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশকে কোনঠাসা করে রেখেছে। ১৯৮০ সালে সৌদি আরব ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিল। এখন সেসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে। অনেকে সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং তারা আরবিতে কথা বলে। দেশটি চাচ্ছে বাংলাদেশ যেনো সেসব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়।

বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘সৌদি সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চায়। তারা রোহিঙ্গাদের জন্য পাসপোর্ট ইস্যু করতে বলেছে। আমরা বলেছি, তাদের কাছে যদি বাংলাদেশের পাসপোর্ট বা কোনো কিছু থাকে, তাহলে আমরা ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেবো। কিন্তু অন্য জায়গা থেকে গেলে আমরা দায়িত্ব নেবো না।’

এ ধরনের বিষয়গুলো যখন সমস্যা তৈরি করে, তখন সে-দেশে থাকা আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধারা পড়েন বিপাকে। বিনা দোষে তারা ভিনদেশি সরকারি রোষের শিকার হন। যা কখনও কাম্য নয়। এই রেমিটেন্স যোদ্ধারা আমাদের দেশের সম্পদ। বিদেশ বিভুঁইয়ে এদের সুরক্ষা দিতে সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তা জোরদার করা প্রয়োজন।

এতসব প্রতিকূলতা ঠেলে দেশের চালিকাশক্তির একটা বড় মাধ্যম হয়ে ওঠা এই মানুষগুলো অনেক সময় আপনজনদের দ্বারাও প্রবঞ্চনার শিকার হন। কয়েক বছর আগে পরিবারের দারিদ্র্য দূর করার প্রচেষ্টায় রফিকুল নামে এক যুবক মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। যশোরের শার্শা থানার এই যুবক প্রায় পাঁচ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দেশে ফেরেন। এক কন্যা সন্তানের বাবা রফিকুল দেশে এসে জানতে পারেন, তার স্ত্রী অন্য একজনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। এমনকি সেই প্রেমিকের সঙ্গে সংসারও পেতেছেন স্ত্রী। রফিকুলের পাঠানো সমস্ত টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করার পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও ক্ষুণ্ন করেছেন তিনি। এ অপমান সহ্য করতে না-পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন রফিকুল। এই মৃত্যুর জন্য কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে দায়ী করে গেছেন তিনি।  যদিও এটা কোনো সমাধান নয়, তার পরেও আবেগের বশে এটাই হয়তো তার কাছে প্রকৃত সমাধান মনে হয়েছে।

এ ধরনের ঘটনা একটিই যে ঘটেছে তা নয়। উদাহরণ আরো অনেক হয়তো দেওয়া যাবে। কিন্তু এই প্রবঞ্চনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যারা নিজেকে সমস্ত ভোগ-বিলাস বা সুখের ঊর্ধ্বে রেখে পরিবার-পরিজনের জন্য কষ্ট করছেন, তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা চলে না। রাষ্ট্রকেও এসব ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, একটি মানুষের মৃত্যু মানে শুধু তার চলে যাওয়াই নয়। একইসঙ্গে একটি পরিবারকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া। একজন সৎ-নির্ভিক যোদ্ধাকে এভাবে বিনাশের পথে ঠেলে দেওয়া চরম অন্যায়, পাপ। যোদ্ধাদের কখনও অপমান করতে নেই। বরং আসুন তাদের প্রতি আমরা আরও দয়া দেখাই ও শ্রদ্ধাশীল হই।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, রাইজিংবিডি, উইকিপিডিয়া
লেখক : সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়