ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভ্রমণকন্যার সাতকাহন

তাহরিমা মাহজাবিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:৪৮, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
ভ্রমণকন্যার সাতকাহন

অর্ধশত বছর আগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারী শক্তির স্তুতি গেয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। কিন্তু আমাদের সমাজ এখনও বলে যাচ্ছে, মেয়ে হয়ে জন্মেছ যেহেতু এটা করো, ওটা করো না, মেয়েদের এটা উচিত না, সেটা ভালো না, এই-সেই। কিন্তু কিছু কিছু মেয়ে সমাজের এ নিয়ম মেনে নেননি। স্রোতের বিপরীতে গা ভাসিয়ে তারা বেছে নিয়েছেন প্রতিকূলতার পথ। প্রমাণ করে দিয়েছেন শুধু মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার জন্যই নারীর জন্ম হয়নি। 

এমনই এক সমাজ ও ব্যক্তি সচেতন নারী হলেন সাকিয়া হক। অবশ্য স্কুটিতে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করে ইতোমধ্যেই সারাদেশে ভ্রমণকন্যা নামে পরিচিত হয়েছেন তিনি। মেয়েদের ভ্রমণ বিষয়ক সংগঠন ‘ট্রাভেলেটস অফ বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা'র প্রতিষ্ঠাতাদের একজনও সাকিয়া হক। 

সাকিয়ার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা খুলনায়। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেছেন তিনি। শুরু থেকেই পড়াশোনার প্রতি খুব মনোযোগী ও যত্নশীল ছিলেন তিনি। তাই দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠে ভর্তির সুযোগও পেয়ে যান। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল তিনি স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের জন্য নতুন কিছু করবেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেন, তারপর টিওশন এবং কোচিং সেন্টারেও ক্লাস নিতে থাকেন নিয়মিত। পুরো দেশ ভ্রমণের কথা হয়তো তখন এতটাও ভাবেননি। 

ঢাকা মেডিকেলে পড়াকালীন ভাইভা পরীক্ষা দিচ্ছিলেন সাকিয়া হক। এমন সময় এলাকাভিত্তিক একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ম্যামের কথা শুনতে হয় তাকে। তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, একদিন এই দেশের সব জেলা তিনি ঘুরে ঘুরে দেখবেন। সবার সংস্কৃতির কথা জানবেন। কিন্তু চাইলেই তো আর জানা যায় না, সেজন্য চেষ্টা করতে হয়। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই একটা উপায় পেয়ে যান তিনি। বান্ধবী ডা. মানসী সাহার সঙ্গে স্কুটিতে করেই সমগ্রদেশ ভ্রমণ করবেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল শুরু করেন ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক ভ্রমণ অভিযান। 

এই যাত্রা যে শুধুই দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন আর সংস্কৃতি সম্পর্কিত জ্ঞান লাভের জন্য ছিল ঠিক তা নয়। সেই সাথে ছিল একটি মহৎ উদ্দেশ্যও। দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে মেয়েদের স্কুলে গেছেন তারা, আর আয়োজন করেছেন সমাজ সচেতনতামূলক বিভিন্ন সেমিনারের। কথা বলেছেন মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল, বয়ঃসন্ধিকালের যত্ন, বাল্যবিবাহের প্রভাব, ইভটিজিংসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। 

উদ্দেশ্যগুলো অসাধারণ হলেও শুরুর দিকে খুব একটা মসৃণ ছিল না তাদের এই পথচলা। নানা নেতিবাচকতা, কটুক্তি, রাস্তায় আপদ-বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রশাসন, পুলিশ আর সাধারণ মানুষের সহায়তায় দীর্ঘ ২ বছরে সম্পন্ন করেন ৬৪ জেলা ভ্রমণ। 

কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, সাকিয়া হক যেহেতু ভ্রমণ নিয়ে এত দিন ব্যস্ত ছিলেন, তাহলে হয়তো পড়াশোনা/চাকরির কথা অতটা ভাবেননি। আসলে যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। ৩৯তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডারও হয়েছেন তিনি। বর্তমানে কক্সবাজারে কর্মরত আছেন। 

গল্পের এখানেই শেষ নয়। এই যে সাকিয়া হক এত কিছু করলেন, এর জন্য কোনো স্বীকৃতিই পাবেন না, তা কি হয়? দেশীয় স্বীকৃতির পাশাপাশি স্বপ্নবাজ এই তরুণীর প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের সম্মাননা। সমাজব্যবস্থার অগ্রগতিতে অসাধারণ ভূমিকা পালনের জন্য সম্প্রতি প্রিন্সেস ডায়না অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন তিনি। 

নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছা করছে, এতসব সাফল্যের পেছনের রহস্যটা কী? সাকিয়া হক মনে করেন, মায়ের স্নেহভরা শাসন আর মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণাই সাফল্যের মূল কারণ। 

আমাদের দেশের তরুণ স্বপ্নবাজদের কাছে সাকিয়া হক এখন এক বিশাল অনুপ্রেরণার নাম। অনলাইন থেকে অফলাইন অনেকেই ফলো করছেন তাকে, অনেকেই নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন। সাকিয়া হক প্রমাণ করে দিয়েছেন, মনের ইচ্ছা আর সবকিছু মোকাবিলা করার সাহস থাকলে মেয়েরাও করে ফেলতে পারেন অসাধারণ সব কর্মকাণ্ড, অবদান রাখতে পারেন সব জায়গায়। 

মেয়ে হয়ে জন্মেছেন বলেই যে বড় কিছু করা যাবে না, এমনটা ভাববেন না। সবসময় মনে রাখবেন, ‘না’-এর চেয়ে নারীর শক্তি অনেক বেশি।

লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ।

ঢাকা/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়