ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণে বিদ্যাসাগর

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৫, ২ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৩:৪৭, ২ অক্টোবর ২০২০
বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণে বিদ্যাসাগর

‘বাংলা গদ্য সংসারের নিত্য চলাচলের ওপর এসে পড়েছে। এতকাল যা মন্থরভাবে চলছিল, কয়েকজন বলবান মাল্লার গুণের টানে বা সরকারি সাহায্যের পালের বাতাসে এবারে তা হাজার বৈঠার ক্ষিপ্র তাড়নে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বৈঠাওয়ালাদের প্রধান ঈশ্বরগুপ্ত, আর হালে অবশ্যই আছেন মনীষী রামমোহন।... বহুজন কর্তৃক বহুতর প্রয়োজনে ব্যবহৃত ভাষায় এসেছে নমনীয়তা; তাতে ঢুকেছে নতুন শব্দসম্ভার তাদের ইঙ্গিত ও স্মৃতির পরিমণ্ডল দিয়ে। বেশ বুঝতে পারা যায় যে অনেকগুলো কলমের প্রচেষ্টায়, তাদের মধ্যে আনাড়ির কলমের সংখ্যাও কম নয়, ভাষার কর্দম উত্তমরূপে মথিত হয়েছে, এবারে মূর্তি গড়ে তুললেই হয়; এলেই হয় শিল্পী। এলেন বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী বিদ্যাসাগর।’

প্রমথনাথ বিশির মতো অনেকেই কথাটি শুধু মেনে নয়, মনেও নিয়েছেন। ফলে আর দ্বি-মতের অবকাশ রইলো না। উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। মানসিক উদারতায়, সমাজ সংস্কারের তাৎপর্যে এবং পাণ্ডিত্যের গভীরতায় তার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা এদেশের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার সফল কর্মবহুল জীবন যেমন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ছিল বিশিষ্টতার অধিকারী। বিশেষ করে বাংলা গদ্যে ছন্দবোধ, প্রবাদ প্রবচনের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং তিনিই প্রথম বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে গদ্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। যা তাকে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু ‘উনিশ শতকের বাংলা গদ্যে সামাজিক ব্যাকরণে বিদ্যাসাগর’- এভাবে বললে তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও ঈশ্বরচন্দ্রের ভূমিকা বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। তাই বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বলতে হলে সেই সময়ের আগে এবং তৎকালীন সমাজ ও গদ্যের ধারাবাহিকতার চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন।

১৭৭৮ সাল। হলহেড নামে একজন ইংরেজ ‘A Grammer of the Bengal Language’ দিয়ে বাংলা গদ্যের গোড়াপত্তন করলেন ভারতীয় উপমহাদেশে। বাংলা গদ্য সাহিত্যের পথপ্রদর্শক আরেকজন ইংরেজ মিশনারি উইলিয়াম কেরি। তিনিই হয়ে গেলেন বাংলা ভাষায় গদ্য চর্চার পথিকৃৎ। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার কাল থেকে, বাংলা গদ্য রচনার গুরুতর প্রচেষ্টা শুরু, তবে বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা আর তার আগের দেশি প্রচেষ্টার মধ্যে সুনীতিকুমার একটি সময় সাধনের প্রয়াস পান। তবে পুরনো বাংলা গদ্য বলতে যে শুধু দলিল-দস্তাবেজ ও চিঠিপত্র বোঝায় না, সেকথা আরেকবার মনে করিয়ে দেন সুকুমার সেন। বৈষ্ণব সাধকদের নিবন্ধের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন: ‘গদ্য সাহিত্যের উদ্ভবের সম্ভাবনা প্রাচীন সাহিত্যে অসম্ভাবিত ছিল। কেননা ইহার আবেদন তত্ত্ববোধে এবং যুক্তিজ্ঞানে।’

এই ধারণা এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কৃতিত্বে অতিরিক্ত বিশ্বাস পুরনো বাংলা গদ্য সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট মনোযোগী হতে দেয়নি। গদ্য বা গদ্যরীতি এবং গদ্য সাহিত্যের পার্থক্যের ধারণাও অনেকের মনে কাজ করেছিল। তাছাড়া ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত উপকরণগুলো এক করার চেষ্টাও হয়নি, তেমন করে উপাদান-সন্ধানের কাজও হয়নি। সুতরাং প্রাক্-উনিশ শতকী বাংলা গদ্য সম্পর্কে আমাদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠতে পারেনি।

চিঠিপত্র লেখা এবং দলিল-দস্তাবেজ লেখার প্রয়োজনে বাংলা গদ্যের সূত্রপাত। আদি সাহিত্যিক গদ্যে কথ্যভাষার প্রতিফলন সুস্পষ্ট। এমন অবস্থার পরপরই সাহেব-শাসিত কলকাতায় যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠলো তাদের নিয়ে শুরু হলো নতুন চিন্তা-চেতনা, সৃষ্টির আলোড়নে নবজাগরণ। স্থাপিত হলো ইংরেজ প্রশাসনিক কেন্দ্র। বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো কেন্দ্রীয় শাসনের কব্জাভুক্ত হলো। বদলে গেল শিক্ষা পদ্ধতি। শিল্পরুচি আর সংস্কৃতি, সাহিত্যে, নৈতিকতায় পদ্যের সুর কেটে বেরিয়ে এলো গদ্য। ইংরেজ আসার আগে এদেশে ৮০০ বছর রাজত্ব করেছিল কবিতা, গীতল, পদ্য। দলিল-দস্তাবেজে যে গদ্য একসময় ব্যবহার হয়েছে তাকেও গদ্য বলা চলে না। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন- ‘গদ্যবোধশক্তি’। অবশ্য ইংরেজ আসার পূর্বে গদ্যের জন্য যে কোলাহল অর্থাৎ যোগাযোগ, আদান-প্রদান, সামাজিকতা প্রয়োজন তা ছিল না। কবিতা একা একা থাকতে পারলেও গদ্য সমাগম চায়। দরিদ্রকে আরও দরিদ্র, ধনীকে আরও ধনী করা অনিবার্যভাবে সমাজে এক বৈষম্যের জোয়ারে নিজ স্বার্থ বজায় রেখে উনবিংশ শতাব্দীর গদ্য লেখকরা সাময়িক পত্রের মাধ্যমে একটি ঘরানা তৈরি করলেন মানুষের কাছে যাবেন চিন্তা করে। কিন্তু কোন মানুষের কাছে তারা যাবেন? সকল মানুষ না কিছু মানুষ। সকল মানুষের সঙ্গে তাদের যোগ রাখা সম্ভব নয়। তাই কিছুটা আত্মপ্রেমে, দেশপ্রেমের লেবেল লাগিয়ে নেতাদের মতো এগিয়ে এলেন তারা।  রামমোহন, বঙ্কিম, অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগর, কালী প্রসন্ন সিংহ এমন অনেকেই যতিবিহীন গদ্য শুরু করলেন।

প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা ভাষায় রচিত আদি গদ্য সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই গ্রন্থে কথ্যরূপী গদ্য একটি পৃথক লেখ্য রূপে দেখা দেয়। আলালী গদ্যে যে চিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, যে শব্দ বা বাক্যের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় তাতে স্পষ্টত তৎকালীন সমাজ ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপট চিত্রিত হয়। অলস, কলকাতার মাতাল, বাটপার মনুষ্যদেহী পশুর ছবি, রুচিতে চেতনায় গ্রাম্য গড্ডলিকায় ইংরেজ-শিক্ষিত বাঙালির অবস্থানই এসেছে এই গদ্য সাহিত্যে। গদ্য চর্চার ভেতর দিয়ে স্বীকৃতি পাচ্ছে ভদ্রলোক। এই ভদ্রলোকদের পরিচয় কী? উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে বিযুক্ত, জনজীবন বিচ্ছিন্ন, রুচির ব্যাপারে নিরাপোস আবার আত্মসচেতনও বটে। এই শ্রেণীর আত্মীয়তা ছিল ইংরেজদের সঙ্গে। তাই জানা যায়, রাজা রামমোহনের বাড়িতে ইংরেজরা বাইজীর নাচ দেখতে এসেছিল। তার বুর্জোয়া কর্মস্পৃহা ও সংস্কারের উৎসাহ প্রায় হাত ধরাধরি করে চলেছে। ম্যাক্স মুলার সাহেব তার সম্পর্কে বলেছেন: ‘a great man, because of unselfishness, honesty and boldness.’

মূলত গদ্যের  ভাষা, শব্দ, ছবিতে উঠতি পুঁজিবাদ আর বাণিজ্যিকীকরণের চিত্র দেখা যায়, যা পদ্যে সম্ভব ছিল না। পদ্যের আফিমে যে দুলকি চাল আছে তাতে এই সমাজের চেহারার বিকাশ অবশ্যম্ভাবী ছিল না। পয়ার বা পদ্য ভেঙে গদ্য এলো ঠিকই কিন্তু তাতে রইলো শ্রেণী শাসনের শিকল যা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত স্বার্থের ইটের তৈরি দালান। রবীন্দ্রনাথ যদিও সাহস করে বলেছিলেন: ‘বিদেশী শাসনামলে যদি এমন কোনো জিনিসের সৃষ্টি হইয়া থাকে যাহা লইয়া বাঙালি যথার্থ গৌরব করিতে পারে, তা বাংলা সাহিত্য। তাহার প্রধান কারণ, সাহিত্য সরকারের নেমক খায় নাই।’ সাহিত্য নেমক খাক আর না খাক, সাহিত্যিক খেয়েছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘না খেয়ে গত্যন্তর ছিল কি? অন্য কোনো নুনের সরবরাহ তো ছিল না বাজারে। হ্যাঁ খেয়েছেন, এবং সাধারণভাবে বলতে গেলে খাওয়ার পর নিমকহারামি যে করেছেন এমন অপবাদ তাদের সম্পর্কে দেওয়া কঠিন। সাহিত্যের স্বাদে তাই নুন লেগেছে, ইংরেজের গুণের নুন।’

বাংলা ভাষা বোঝা, আর বুঝতে পারাটা ব্যবসা ও ধর্মের প্রয়োজনে, তাই ১৭৭৮-এ হলহেডের বই ছাপানোর তাগিদে উপমহাদেশে প্রথম ছাপাখানা এলো, যেখানে ইংল্যান্ডে ছাপাখানার প্রচলন হয় ১৪৭৭-এ। প্রায় তিনশ বছর পর ভাষার ব্যাকরণের পেছনে রাজনীতি ও অর্থনীতির ব্যাকরণ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্যের শুরু হলো। ইংরেজের ব্যবসা-নীতির ছাপ সুলভ না হলেও গদ্যে ছাপ রেখেছিলো কমা, সেমিকোলন, যতি, বিস্ময়বোধক চিহ্ন, বাগবিধি, শব্দ, বাক্যগঠন, এমনকি যোগাযোগ ব্যবস্থার শব্দসমূহ ঢুকে পড়েছিল গদ্যে। যেমন আজকের গদ্যে ব্যবহার হচ্ছে এসএমএস, চ্যাট, ফেইসবুক, ভাইবারসহ আরও অনেক শব্দসম্ভার। তেমনি তৎকালীন গদ্যে চড়ক, বান্ডিল, ফেটিং গাড়ি, টমটম, কমোড ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে গদ্য জনতার কাছে আসেনি, আসেনি জনতাও গদ্যের কাছে। কারণ জনতা মানে কৃষক শ্রেণী, নীলচাষী শ্রেণী। তারাই সংখ্যায় অধিক। তারা আসেনি। এটা তাদের সমস্যা। তাই রামমোহন, দ্বারকানাথ, রাধাকান্তদেব মহাশয়রা মধ্যবিত্ত স্বার্থ রক্ষায় পৃথকীরণ করেন তাদের ভাষা ব্যবহারের মাত্রা জ্ঞানকে।  রামমোহনের গদ্যে তাই বুদ্ধির ঝলক থাকলেও হৃদয় ছিলো না, হৃদয় আসতে গদ্যে চল্লিশ বছর লেগেছিল; তা এসেছিল বিদ্যাসাগরের হাতে। শ্র্রেণী বৈষম্যের পাহারায় গদ্য যখন দিশেহারা, অস্থির, তখন তাকে স্থির রূপ দিতে এলেন  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

সামাজিক ব্যাকরণে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস ‘বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: ‘১৮২৯ হইতে ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ণ এক যুগকাল সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ সাহিত্য, বেদান্ত, অলঙ্কার, স্মৃতি ও ন্যায় অধ্যায়ন করিয়া এবং গোরা ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হইয়া তিনি যে কেমন করিয়া এই সংস্কারমুক্ততা অর্জন করিলেন, তৎকালে প্রচলিত জ্ঞান ও শিক্ষার মধ্যে এই উদারতার বীজ কোথায় কেমনভাবে তাহার মনে উপ্ত হইল, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েও তাহার রহস্য আমাদিগকে অভিভূত করে।’ তার অধিকাংশ গদ্যে সামাজিক ব্যাকরণীকরণ যা এক প্রকার সমাজ সংস্কারকের মনোবৃত্তি সহজেই লক্ষ্যণীয়। তদুপরি বিষয় ও আদর্শের দিক বিচারে বিদ্যাসাগরের রচনাবলি বৈচিত্র্যপূর্ণ। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার ও সাহিত্য সৃষ্টির যৌথ প্রচেষ্টা তার রচনাবলির পেছনে কাজ করেছে।

তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শিশু শিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় করলেই জাতীয় জীবনে মননশীলতা বিকাশের সুযোগ আসবে। দেশের শিক্ষিত লোকেদের সামনে সৎ সাহিত্যের আদর্শ তুলে ধরতে পারলে জাতীয় জীবন সুন্দররূপে গড়ে তোলা সহজতর হবে বিবেচনায় নিয়ে তিনি অন্য ভাষার সাহিত্য থেকে কয়েকটি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি বাংলা সাধুভাষার গদ্যরীতিকে পুর্ণাঙ্গ রূপ দান করেন। জড়তা ও দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে বাংলা গদ্য প্রথমবারের মতো তার মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’তে প্রকাশ পেয়েছে। পরবর্তী রচনাবলিতে তার ভাষা ক্রমে ক্রমে সরলতা ও স্নিগ্ধতা লাভ করেছে। সাহিত্যের বাহন হিসেবে গদ্যের রসালো উপযোগিতা বিদ্যাসাগরের রচনায় প্রথম লক্ষ্য করা যায়। পদ্যের মতো গদ্যেরও যে একটা নিজস্ব তাল বা ছন্দ আছে বিদ্যাসাগর তা আবিষ্কার করেন। অমার্জিত বঙ্গভাষাকে বিদ্যাসাগরই সুসঙ্গত মার্জিত রূপ দান করেন। রবীন্দ্রনাথের মতে ‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম শিল্পী এবং তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।’

বিদ্যাসাগরের পূর্বে এবং সমসাময়িককালে বাংলা গদ্যচর্চার পরিসীমা ব্যাপক হয়ে উঠলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈশিষ্ট্য ব্যাতীত এসব প্রচেষ্টায় অন্য কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তৎকালীন সমস্ত গদ্য রচনাকারীর মধ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান গদ্যের কাঠামো গঠনে এবং বাক্যের ভারসাম্য স্থিরীকরণে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো। সমকালীন গদ্য লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলা গদ্যের জটিলতা দূর করে তাকে ব্যাপকতর ক্ষেত্রে ব্যবহারোপযোগী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর বিদ্যাসাগর সেই গদ্যরীতির মধ্যে লালিত্য সঞ্চার ও নমনীয়তা এনে ভাষারীতি হিসেবে গদ্যের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে গৌরবময় অগ্রগতি সাধন করেন। তিনি বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত ধ্বনিপ্রবাহ অনুধাবন করে বাক্যে স্বাভাবিক শব্দানুবৃত্তির রূপ দিয়ে গদ্যরীতিতে পরিমিতিবোধ সৃষ্টি করেন। বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী গদ্যের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে তৎকালীন লেখকদের মধ্যে যে সুষম বাক্যগঠনরীতির নিদর্শন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে না তা নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর যেমন সচেষ্ট ছিলেন তেমন আর কাউকে দেখা যায় না। সে জন্য বাংলা গদ্যশৈলীর উদ্ভবের পঁয়তাল্লিশ বছর পরে লেখনী ধারণ করা সত্ত্বেও তাঁকে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সৃষ্ট গদ্যরীতির প্রভাবেই পরবর্তীতে বাংলা গদ্যের পরিণত রূপের সৃষ্টি হয়।

বাংলা গদ্যের মধ্যে ছন্দবোধ ও ছন্দ আবিষ্কার করে বিদ্যাসাগর ভাষাকে নবরূপে গড়েছিলেন। তাছাড়া, বাংলা প্রবাদ প্রবচনের সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবহার বিদ্যাসাগরের রচনা তথা প্রাথমিক পর্যায়ের গদ্যকে সমৃদ্ধশালী করেছে। প্রবাদের ব্যবহারে বিদ্যাসাগরের ব্যঙ্গ রচনাকে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব হয়েছিল। বাংলা গদ্যে স্বাভাবিক যতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি সুষম বাক্যগঠন-রীতির প্রবর্তন করেন। দাঁড়ি কমা প্রভৃতি বিরামচিহ্ন তিনিই প্রথম ব্যবহার করে বাংলা গদ্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। বিদ্যাসাগরের প্রতিভার সার্থক সমঝদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যথার্থ মন্তব্য এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়: ‘ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধার মাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন তেন প্রকারের কতগুলো বক্তব্য বিষয় পুরিয়া যে কর্তব্য সমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য, তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে। বাংলা ভাষাকে পূর্ব প্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর হইতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলির মধ্যে অংশ যোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন, তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের অনেক আগেই বাংলা গদ্যের উদ্ভব হলেও বিদ্যাসাগরই  উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে শিল্পরস সমন্বিত ভাষাভঙ্গিমা প্রথম প্রয়োগকর্তার গৌরব তারই প্রাপ্য। বাংলা পরিণত গদ্যরীতির উন্নয়নে বিদ্যাসাগরের প্রভাব তাই অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

দোহাই
* রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন সমাজ
* রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
* উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
* হুতোম পেঁচার নকশা: কালী প্রসন্ন সিংহ

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়