ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ওরাই ধর্ষণের মদদদাতা

জিন্নাতুন নেছা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১২, ৬ অক্টোবর ২০২০  
ওরাই ধর্ষণের মদদদাতা

আর কত! বিশ্বাস করুন, কোটি কোটি বার এই প্রশ্ন কেবলই নিজের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় টিভির নিউজ: ‘নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নে অনৈতিক কাজের অপবাদ দিয়ে এক নারীকে (৩৬) বিবস্ত্র করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে একদল যুবক। নির্যাতনকারীদের বারবার বাবা ডেকেও শেষ রক্ষা হয়নি ওই নারীর।’

ভিডিওটি আমি দেখতে পারিনি। আমার এতো বুকের পাটা নাই! তবে সত্যি বলছি- ভাবাচ্ছে, খুব ভাবাচ্ছে। আর কতদিন এভাবে চলতে পারে? চলতে দেওয়া যায়? বৃদ্ধা, তরুণী, শিশুকন্যা, কিশোরী কেউই নিরাপদ নয় এই সোনার বাংলায়!

ধর্ষণ বেড়েছে এটা সত্য। সেটা আপনি মানুন আর না-ই মানুন। ছেলে শিশু থেকে তৃতীয় লিঙ্গ কিংবা প্রতিবন্ধী কারোরই ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা মিলছে না। পাবলিক বাসে ধর্ষণ চলছে, চলছে গ্যাং রেইপ। আজ আপনি নারী একা সন্ধ্যার পর বাসে উঠতে পারবেন না। আপনার নিজের ঘরেই আপনি নিরাপদ নন। স্কুলে,  কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাস্তায়, ধান ক্ষেতে, পাট ক্ষেতে, পার্কে, পাহাড়ে, চা-বাগানের কোথাও আপনি নিরাপদ নন। কি আশ্চর্য! অথচ কত স্বপ্ন নিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ।

গ্রাম থেকে শহর, পাহাড় কিংবা সমুদ্র, পাতাল কিংবা আকাশ সবখানে কান পাতলে চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পাবেন। নিজের ভাবনাকে একটু গভীরে নিয়ে যান, শুনতে পাবেন অনেকের বুক ফাটা কান্না। গত কয়েকদিন আগের একটা ঘটনা বলি- কুয়াকাটা ট্রিপে গিয়েছিলাম অফিসিয়ালি। নিচে নামার সময় থ্রি-কোয়ার্টার, টি-শার্ট আর ওড়নাবিহীন কিছু ছবি দিয়েছিলাম ফেইসবুকের টাইমলাইনে। পরিচিত মহল থেকে শুরু করে আমার ম্যাসেঞ্জারে এবং ফোনে কম করে হলেও একশ কল এসেছে। আমাকে বলা হয়েছে ‘তুই কি বেশ্যা হয়ে গেছিস?’ ‘ছবিগুলো ডিলিট কর’। ডিলিট তো আমি করিইনি বরং প্রতিবাদে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ ভিডিওটি দেখে কিংবা ধর্ষণের কাহিনী ফেইসবুকে পড়ার পর মনে যে কষ্ট হতো, যে ঝড় বইতো, চোখ ফেটে জ্বল পড়তো তা আমি টের পেয়েছিলাম সেদিন। মনে মনে ভাবছিলাম চোখ দিয়ে ধর্ষণের অনুভূতির কষ্ট যদি এমন হয়, তাহলে যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তাদের কষ্ট কেমন, ব্যথা কেমন, যন্ত্রণা কেমন? বোধকরি সবগুলো একইরকমের কষ্ট। কারণ ধর্ষণ সে তো ধর্ষণই!

নৃবিজ্ঞানের যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন পড়েছিলাম Theory of change. সেই পথ ধরেই ধর্ষণের সংস্কৃতি আজ শুধু change নয় Evolution হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তার নিউজের নিচে কমেন্ট বক্সে যে "Group of people" কে আপনি দেখতে পান এদেরকে কি মনে হয় বলুন তো? এরা কারা? আমার তো মনে হয় এই দলের লোকগুলোই  ধর্ষণ সংস্কৃতির বিবর্তনের হাতিয়ার। এরা মেয়েরা কেন জিন্স পরে, কেন ঘরের বাইরে বের হয়, কেন টিশার্ট পরে, কেন ওড়না পরে না, কেন স্বামীর কথা শোনে না, স্বামী একটু চড়-থাপ্পড় মারলে কি এমন হয়, ধর্ম মানে না- এদের এমনই  হওয়া উচিত! এসব প্রশ্নের মাধ্যমেই এরা ধর্ষণের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। এরা ধর্ষণের মদদ দাতা। এরা আরো বড় ধর্ষক।

আচ্ছা সহজভাবে একটা চিন্তা করুন তো- এই গত এক সপ্তাহে কতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে? পুলিশ প্রশাসন থেকে গোয়েন্দা সংস্থা এতো কিছু খবর রাখে, ধর্ষণের ঘটনা কেন আগে থেকে জানতে পারে না? তাহলে কি দেশে ধর্ষণের সংস্কৃতি স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে, হয়েছিল বা হচ্ছে? মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট, ক্রাইম রিপোর্ট, সব রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন দেশে আজ পর্যন্ত কোনো ধর্ষণের ঘটনার সুরাহা হয়েছে কিনা! আজ পর্যন্ত ধর্ষণ রোধে সরকারের নতুন কোনো পদক্ষেপ কি চোখে পড়েছে? আমার পড়েনি! আপনাদের কারো জানা থাকলে জানাবেন আশাকরি। আর এভাবে চলতে দেওয়া সম্ভব নয়। নারীদের বলছি, আপনারা সকলে যার যা আছে যুদ্ধের জন্য ঝাপিয়ে পড়ুন।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও উন্নয়নকর্মী

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়