ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

একজন আভা মুর্তো ও কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষা

তাছলিমা আক্তার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ১১ অক্টোবর ২০২০  
একজন আভা মুর্তো ও কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষা

ছদ্মনাম ‘তিনু’।  রক্ষণশীল পরিবারে কিছুটা স্রোতের বিপরীতে বেড়ে ওঠা ১৬ বছর বয়সের কিশোরী।  এসএসসি পরীক্ষার পর মামা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বিয়ে হয়ে যায় বয়সে ১৬ বছরের বড় এক যুবকের সঙ্গে, তার মামার পছন্দে।

স্রোতের বিপরীতে থাকলেও পরিবারের সামনে জোরালো কন্ঠে ‘না’ বলার পরিপক্কতা অর্জন করেনি তিনু।  আবার কখনো ’হ্যাঁ’ও বলেনি।  সব নিরবতাই সম্মতি নয়, এটা বোঝার সক্ষমতা পরিবারের নেই।  পারিবারিক শিক্ষা ‘বিয়ে হয়েছে, থাকতে হবে এখানেই’।  চলে মেনে নেওয়ার বা মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। 

নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে কোন কোন তিনুরা জিতে যায় মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধে, নিজেকে হারিয়ে।  কিছুটা স্রোতের বিপরীতে বেড়ে ওঠা তিনুরা মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।  এগিয়ে আসে কয়েক ধাপ সামনে।  এদের সংখ্যা খুবই কম। নীরব যুদ্ধটা শেষ হয় না।  এমন অগণিত গল্প আমার দেশের ৫২.৩ শতাংশ কন্যা শিশুর ঘরে।

এ বছরের আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু অধিকার দিবসের নির্ধারিত প্রতিপাদ্য ‘আমার কন্ঠস্বর আমাদের সমতার ভবিষ্যৎ’।  বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন এর ২৫ বছর পূর্তিতে, বিশ্বব্যাপী নারী এবং কন্যাশিশুর অগ্রগতি এজেন্ডাকে সামনে রেখে এই প্রতিপাদ্যে পালিত হচ্ছে দিবসটি। 

কন্যাশিশু পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে এবারের দিবস উদযাপন তিনটি বিষয়ে মনোনিবেশ করছে।
১. সহিংসতামুক্ত হয়ে বেঁচে থাকা, ক্ষতিকারক চর্চা, এইচআইভি এবং এইড থেকে মুক্ত থাকা
২. দক্ষতার সাথে ভবিষৎ বেছে নেওয়া এবং
৩. সমাজ পরিবর্তনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নেতৃত্ব দেওয়া।

২০২০ এ বৈশ্বিক এজেন্ডা এবং কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষার বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিশু বিবাহ নির্মূলে বিশ্বের জোরালো অঙ্গীকার রয়েছে।  তা সত্ত্বেও সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১২ মিলিয়ন কন্যাশিশু বিবাহের শিকার হয়।  এসডিজি লক্ষ্য ৫.৩ অর্জনে বাস্তবসম্মত এবং শক্তিশালী উদ্যোগ না নিলে ২০৩০ এর আগে ১২০ মিলিয়ন শিশু তার ১৮তম জন্মদিনের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে (ইউনিসেফ প্রতিবেদন অনুযায়ী)। 

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক মন্দা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ধীরগতি এর সাথে যোগ করবে আরও ১৩ মিলিয়ন শিশুকে (ইউএনএফপিএ প্রতিবেদন অনুযায়ী)। 

সারা বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ১ জন কন্যাকে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্কে অথবা অন্যান্য যৌন ক্রিয়াকলাপে বাধ্য করা হয়, যাদের বয়স ২০ এর নিচে।  এর সংখ্যা প্রায় ১২০ মিলিয়ন।  প্রতিবেদনকারী সংস্থা অনুযায়ী বাস্তবিক অর্থে এই সংখ্যা আরোও বেশি (ইউনিসেফ প্রতিবেদন অনুযায়ী)।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গার্লস সামিটে বাংলাদেশ সরকার ২০২০- এ শিশু বিয়ে নির্মূলের অঙ্গীকার করলেও, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫২.৩ শতাংশ শিশু তার ১৮তম জন্মদিনের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসছে।  যদিও গার্লস সামিটে স্বাক্ষরিত সনদের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ কিছু উদ্যোগ রয়েছে।  যার মধ্যে রয়েছে- প্রাইমারিতে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনা, জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।  ২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন ৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।  যা ২০১৮ এর তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি।

নদীভাঙন এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতায় শিশুবিবাহের একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোন এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন।  ঘটনাটা সংক্ষেপে এরকম-  বাবা-মা, ছেলে-ছেলের বউ, ১৪ বছর বয়সী এক কন্যা এবং ৫ বছর বয়সী আরো একটি সন্তান।  এই ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের একটি ঘরে বাস।  কারণ তাদের মূল বাড়ি নদীগর্ভে।  ঘরটি আর কতই হবে ১৫/১০ ফুট।  মায়ের সঙ্গে অনেক কথার পর যখন ১৪ বছর বয়সী মেয়েটির বিয়ের কারণ জানতে চাওয়া হলো তখন মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছিল ‘সেয়ানা মেয়ে নিয়ে একই ঘরে বসবাস’।  এছাড়াও পারিবারিক দৈন্যতা, সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসে।

এবার প্রশ্ন শুনুন।  আমারা যারা পরিকল্পনায় কাজ করি, তারা কি আদৌ মূল কারণ এবং প্রকৃত প্রয়োজন- দুটি বিষয়কে ক্ষতিয়ে দেখি?  কখনো কি ভেবেছি, একটি ঘরের জন্যও একটি শিশু বিয়ে হয়?  আমার বন্ধুর ভাষ্য অনুযায়ী- শিশু বিয়ে বন্ধে আমাদের উদ্যোগ প্রতিকারে বেশি প্রতিরোধে কম।  সম্পূর্ণ একমত না হলেও কিছু জায়গায় তার সাথে বিতর্কে হেরে গিয়েছিলাম আমি।

১৪ বছরের এই কিশোরীর বিয়ে আর ১৬ বছরের তিনুর বিয়ে- দুটি প্রেক্ষাপট ভিন্ন।  কারণ তিনুর ঘরের অভাব ছিল না। আবার কোনো একটি জায়গায় তারা একই অবস্থানে।  দুজনেই পারিবারিক সিদ্ধান্তে অচেনা গন্তব্যে, দু’জনের বাবা-মা ই শিশু বিয়েকে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন।

‘কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষা এবং ক্ষমতায়ন’ প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সান্না মেরিন একদিনের জন্য ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর হাতে দেশের দায়িত্ব দিয়েছেন ৭ অক্টোবর ২০২০।  আভা মুর্তো নামের দক্ষিণ ফিনল্যান্ডে বসব্সকারী ১৬ বছরের ওই কিশোরী অত্যন্ত আনন্দের সাথে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।  এ সময়ে তিনি মিডিয়া, বিচার বিভাগ, সাংসদ এবং পরিবেশ মানবাধিকার সুরক্ষায় কর্মরত শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করেন।

আভা মুর্তো এবং তিনু দুজনেরই ১৬ বছর।  কিন্তু সুযোগে অভিগম্যতা এবং আত্মবিশ্বাসে তারা দু’মেরুর বাসিন্দা।  এদের মেরুকরণ খুব কঠিন কাজ নয়।  প্রয়োজন সুযোগ তৈরি করা এবং সেখানে তার অভিগম্যতা অবারিত করা।  একজন আভা মুর্তো তৈরি কাজ করেছে পরিবার, সংগঠন, রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে।  এ দায়িত্ম একক নয়- সিদ্ধান্ত আমাদের।

তাছলিমা আক্তার: মানবাধিকার কর্মী এবং ডেপুটি ম্যানেজার- উইমেন রাইটস এন্ড জেন্ডার ইক্যুইটি, একশনএইড বাংলাদেশ।

ঢাকা/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়