ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চকচকে তাজা ইলিশের সঙ্গে দেখা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০০, ১২ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৪:১২, ১২ অক্টোবর ২০২০
চকচকে তাজা ইলিশের সঙ্গে দেখা

চকচকে তাজা ইলিশ! রোদের আলোয় আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হাট-বাজারের ইলিশ, বরফে বা ফ্রিজে রাখা ইলিশ- কোনো ইলিশের সঙ্গেই এর মিল নেই। জাল টানছেন জেলেরা। হঠাৎ জেলে জুলফিকার আলী লাফিয়ে পড়লেন। সবাই  হতবাক! না, তিনি সমুদ্রে ঝাঁপ দেননি। জাল থেকে একটি বড় ইলিশ ধরার চেষ্টা করছিলেন। ইলিশটি জাল ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। জুলফিকার আলী অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ধরে ফেললেন। দুই কেজি ওজনের বড় ইলিশটির স্থান হলো আইস বক্সে।

মাঝিসহ ট্রলারের সাতজন জেলের মধ্যে জুলফিকার আলী বেশ নিরীহ। সবার চেয়ে বয়সেও বড়। কম কথা বলেন। ট্রলারে আমরা আছি প্রায় ২৪ ঘণ্টা অথচ মানুষটার মুখ থেকে কোনো কথাই শোনা গেল না। জাল টানার সময় সবচেয়ে ছোট কিংবা কম পরিশ্রমের কাজটি দেওয়া হয় তাকে। হঠাৎ ফসকে যাওয়া ইলিশটি ধরতে গিয়েই যেন মানুষটা নজরে এলো। বোঝা গেল মানুষটা ট্রলারে আছেন। ইতোমধ্যে আমরা একসঙ্গে খাবারও খেয়েছি; কোনো কথা শুনিনি তার। ঢালচরের প্রায় সবাই জুলফিকার আলীকে চেনেন। তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ভুট্টো’ শব্দটি। তিনি নিজেও জানেন না কীভাবে তার নামের সঙ্গে শব্দটি এলো। এখন জুলফিকার আলী ভুট্টো না বললে তাকে কেউ চেনেন না। অথচ এই ভুট্টো সাহেব ২২ বছর জেলে হিসেবে কাজ করেও মাঝি হতে পারেননি। শরীরে নানান অসুখ বাসা বেঁধেছে। বয়সও বেড়েছে। এখন আর ‘ভাগী’ হিসেবেও তাকে কেউ নিতে চায় না।

সদ্য ধরা ইলিশ সাজিয়ে রাখা হচ্ছে আইস বক্সে

ইলিশ ট্রলার কিংবা যে কোনো মাছধরা ট্রলারে প্রত্যেককে বেশ খাটতে হয়; পরিশ্রমের কাজ। অথচ ডাঙার মানুষ তার খবর রাখেন না বললেই চলে। শহরের মানুষ ইলিশের স্বাদ নেন বিভিন্ন উপায়ে। কিন্তু একেবারে শেকড়ে জালে ধরা পড়া চকচকে তাজা ইলিশ দেখেছেন ক’জন? ক’জনই-বা জেলেদের হাড়ভাঙা খাটুনির খোঁজ রাখেন? দর্শক হিসেবে আমার যেখানে কোনো ভূমিকাই নেই, সেখানে ক্রমাগত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন এই জেলেরা। যথারীতি গোড়ার বট (জালের নিচের রশি) সামলাচ্ছেন দেলোয়ার হোসেন। ট্রলারের দক্ষ জেলেদের মধ্যে অন্যতম তিনি। ইলিশ জালের গোড়ার বট টানতে শরীরে জোর লাগে। অনেক পরিশ্রম। কারণ গোড়ার বটের সঙ্গে থাকে ইট। ইটগুলো গোলাকার চাকতির মতো। ইলিশের জাল নিচের দিকে টেনে রাখে। দেলোয়ার হোসেন যখন গোড়ার বট টেনে উঠাচ্ছিলেন, তখন বেল্লাল হোসেন ইটগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছিলেন ট্রলারের অগ্রভাগে। অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাজ হলো জালের ফ্লুট (ভাসা) আর পঞ্চ গুছিয়ে রাখা।  

মজার ব্যাপার হলো, ট্রলার থেকে জাল ফেলা এবং জাল তোলার মধ্যে বিশেষ একটা ছন্দ আছে। জাল তোলার সময় জালের সঙ্গে থাকা প্রত্যেকটা উপকরণ সুচারুভাবে গুছিয়ে যায়। আবার জাল ফেলার সময় ঠিক একইভাবে জাল ফেলা হয়। সব জেলে একভাবে একই নিয়মে কাজগুলো করে। ট্রলারে বসে যতবার জাল ফেলা এবং তোলা দেখেছি, আগার বট (জালের উপরের রশি) টানতে দেখেছি মোকতার হোসেনকে।  

ট্রলারের মাঝির পরে দক্ষ হতে হয় ‘ডাইনা’ মাঝিকে। ডাইনা শব্দটা যারা নতুন শুনছেন, তারা হয়তো ভাবছেন- এ আবার কেমন শব্দ! ট্রলার, মাছধরা এবং মাছের বাজারকেন্দ্রিক এমন অনেক শব্দ আছে, যা স্থানীয়দের নিজস্ব ভাবনা থেকে তৈরি। এগুলোর আভিধানিক অর্থ নেই। যিনি ট্রলারের মাঝিকে সহযোগিতা করেন, তিনি ডাইনা মাঝি। মানে মাঝির সহকারী। তাকেও অনেক কিছু সামাল দিতে হয়। ডাইনা মাঝির নির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব থাকে না, তবে সার্বক্ষণিক তাকে নজর রাখতে হয়- কোথাও কোনো সমস্যা হলো কি না। জাল ফেলার পর ডাইনা মাঝির বিশেষ একটি দায়িত্ব থাকে। জালের পতাকার দিকে তাকে নজর রাখতে হয়। পতাকা কোনোভাবে কাত হয়ে পড়লে মনে করতে হবে জালে কোনো সমস্যা হয়েছে। ডাইনা মাঝি তখন দ্রুত ব্যবস্থা নেন। প্রয়োজনে ট্রলার চালিয়ে সে সোজা পতাকার কাছে চলে যাবে।

গভীর রাত। জেলেদের চোখে ঘুম নেই। জাল টেনে তুলতেই উঠে এলো ইলিশ

আমাদের ইলিশ অভিযানের প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হতে চলেছে। ট্রলারের জেলেদের সঙ্গে আমরাও মিশে গেলাম। আমরা মানে, যারা ইলিশ ধরা দেখতে গিয়েছি; ঢালচরের বাসিন্দা দু’জন যুবক- আবদুর রহমান বিশ্বাস এবং কাওসার ফরাজী। আমাদের নাওয়া-খাওয়া-বিশ্রাম-ঘুমানো সবকিছুর নিয়ম ভেঙে গেল। রাতে আমরা আকাশ দেখি আর ঘুমাই। খানিকসময় বিশ্রামের জন্য ভোর রাতের দিকে ট্রলার নোঙর করে ঘাটে। ট্রলারের কেবিনের ছাদে বিছানো হয় কাঁথা। ভাগ্যক্রমে একটা বালিশও পেয়ে যাই।

কিনারে নোঙর করা থাকলেও ট্রলার দুলতে থাকে সবসময়। মনে করুন, অনেক পরিশ্রমের পরে চোখে কেবল ঘুম এসেছে, এরইমধ্যে ছোট ঢেউয়ের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। এভাবেই চলতে থাকল। এটাই জেলে জীবন। আবার ভোর হতে না হতেই ট্রলারের নোঙর উঠল। আমিসহ কয়েকজন তখনও ঘুমে। কিন্তু মাঝি তৈয়ব আলী, ডাইনা মাঝি হাসনাইনসহ কয়েকজন আগেই উঠেছেন। ঘাট থেকে ট্রলারের প্রয়োজনীয় তেল, বরফ ইত্যাদি নিয়েছেন। ছেড়ে দিয়েছেন ট্রলার। পুব আকাশে কেবল আলো ফুটেছে। ট্রলার চলছে এবার সোজা দক্ষিণে। ভোর রাত পর্যন্ত যেসব ট্রলার জাল ফেলেছে, সেগুলো ঘাটের দিকে ফিরছে। আমরা তখন গভীরে যাচ্ছি।

ভোরের হাওয়ায় দুলছে আমাদের ট্রলার। দুলিয়ে দিচ্ছে আমাদের সবাইকে। উঠে দাঁড়ালে ঢেউয়ের তীব্রতা আরও বেশি অনুভব হয়। তৈয়ব মাঝি তখনও হাল ধরার জন্য প্রস্তুত হননি। ট্রলার চালাচ্ছিলেন ডাইনা মাঝি। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তৈয়ব মাঝি এক লাফে উঠে গেলেন কেবিনের উপরে। ডাইনা মাঝির কাছ থেকে ট্রলারের হাল নিজের হাতে নিলেন শক্ত করে। মাঝি-জেলেদের জাল ফেলার তাড়া থাকলেও আমার তেমন ব্যস্ততা নেই। আমি ভোরের সমুদ্র দেখি। চারদিকে শুধু জলরাশি। কিনার দেখা যাচ্ছে না। হালকা মেঘে ঢেকে আছে গোটা আকাশ। পুব আকাশে সূর্য উঠেছে বটে; কিন্তু সে তখন মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে হয়তো এ সময় পুব আকাশে গোলাকার সূর্য দেখা যেত। আমার ক্যামেরার খোরাক হতো সেই সূর্য। কিন্তু সেই সুযোগ পেলাম না।

জাল থেকে ইলিশ ছাড়াচ্ছেন এক জেলে। এই ইলিশ ডাঙায় নিয়ে মহাজনের কাছে বিক্রির পর মিলবে টাকা  

সকালের সমুদ্র বেশ শান্ত। দেখে মনে হয়, এই সমুদ্র যেন উত্তাল হতেই জানে না। মাঝির চোখ গন্তব্যের দিকে থাকলেও আমার চোখ সমুদ্রের ঘোলাটে জলরাশির দিকে। এই জলরাশির রঙের দিকে। মধ্য-উপকূলের এই অঞ্চলের নদী-সমুদ্রের পানি বেশ ঘোলাটে। পলি বহন করার কারণে এমন হয়। পলিবাহিত এই পানি নদীতে গিয়ে ডুবো চর সৃষ্টি করে। কিন্তু এখানে সমুদ্রের ঘোলাটে পানি দেখে আমার মনে পড়ছে টেকনাফ, কক্সবাজার, মহেশখালী কিংবা শাহপরীর দ্বীপের কথা। সেখানকার পানি খুবই স্বচ্ছ; নীলাভ।

আমরা চলে এসেছি সমুদ্রের অনেক গভীরে। অথচ ট্রলার চলছে একই গতিতে। হঠাৎ মাঝির কণ্ঠে শোনা গেল- ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই রে...’। না, এটা নদী নয়, সমুদ্র। সামনে এর কোনো কিনার পাওয়া যাবে না। কিনারের সন্ধান পেতে হলে আমাদের অন্তত ৪০ মাইল পথ আবার পেছনে ফিরতে হবে। তৈয়ব আলী হঠাৎ ট্রলারের স্পীড কমালেন। শুরু হয়ে গেল জাল ফেলার আয়োজন।

** ইলিশের খোঁজে গভীর সমুদ্রে

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়