ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ধর্ষণের শাস্তির একাল-সেকাল

শহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ২০ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৩:২৪, ২০ অক্টোবর ২০২০
ধর্ষণের শাস্তির একাল-সেকাল

সম্প্রতি দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে- কেন বাড়ছে ঘৃণ্য এই অপরাধ? শাস্তির মাত্রা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে ধর্ষকের সামাজিক অবস্থান নিয়েও। সরকার সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান জারি করেছে।

পৌরাণিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ধর্ষকের শাস্তি ও সামাজিক অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে গ্রিক পুরাণে ধর্ষণের অনেক ঘটনা আছে। তবে এগুলো সাধারণ মানুষের দ্বারা ঘটেনি। সবগুলো ঘটনাই কোনো না কোনো দেবতার কারণে ঘটেছে। গ্রিক দেবতারাজ জিউস কর্তৃক রাজকুমারী ইউরোপা, লিডা দ্য নিম্ফ এবং পৃথিবীর মানুষ গেনিমেডকে অপহরণ পুরাণের বিখ্যাত ঘটনা। যেহেতু ঘটনাগুলো দেবতারা ঘটিয়েছেন তাই পুরাণে শাস্তির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।

রোমান শব্দ ‘রেপিটাস’ থেকে ইংরেজি ‘রেপ’ শব্দের উৎপত্তি। তবে সেখানে এই শব্দ দিয়ে রেপ বা ধর্ষণ বোঝানো হতো না, অপহরণ করা বোঝাত। সে সময় ধর্ষণ বা জোরপূর্বক যৌন সঙ্গমকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো। এ ধরনের  ঘটনায় ব্যক্তি শুধু নয়, পারিবারকেও অপরাধী বিবেচনা করা হতো। বিচারে শাস্তির চেয়ে সমঝোতা গুরুত্ব পেত। সমঝোতায় ধর্ষক এবং ভুক্তভোগী পরিবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের আয়োজন করে বিষয়টির সমাধান করতেন।

খ্রিস্টান ধর্মের সংস্পর্শে আসার পর ধর্ষণ সম্পর্কে রোমান শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে শুরু করে। তারা ধর্ষণকে ব্যক্তি বা পারিবারিক অপরাধের পরিবর্তে সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করে। শাস্তির ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন আসে। রোমান সম্রাটদের মধ্যে প্রথম খ্রিস্টান ধর্মে দিক্ষিত হওয়া সম্রাট কনস্টাইন ধর্ষকের অপরাধ বিবেচনায় পরিবার থেকে বহিষ্কার, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার মতো শাস্তির প্রচলন করেন। তবে তার সময়েও ধর্ষণের ক্ষেত্রে বিয়ের মতো পারিবারিক সমঝোতা প্রচলিত ছিল।

রোমান সম্রাট প্রথম জাস্টিনাইন ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করেন। তিনিই প্রথম ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রচলন করেন। তবে এই মৃত্যুদণ্ড শুধু গির্জার সেবিকাদের ধর্ষকদের ক্ষেত্রে দেওয়া হতো। সাধারণ নারীর ক্ষেত্রে সম্রাট কনস্টাইনের প্রবর্তিত শাস্তিই বহাল ছিল।

প্রাক ইসলামিক যুগে ধর্ষণ ছিল সামাজিক ব্যাধির মতো। ইসলামের আবির্ভাবের পর সামাজিক শাসনে ইসলামের মূল ভিত্তি কোরান-হাদিসের নীতি অনুসারণ শুরু হয়। সে সময়ের শাসকগণ শরীয়াহ আইন অনুযায়ী বিচার শুরু করেন। শরীয়াহ আইনে ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে একশ বেত্রাঘাত করার বিধান প্রচলিত হয়। তবে ভুক্তভোগীর মৃত্যু হলে ধর্ষকের শিরোচ্ছেদ করার বিধানও প্রবর্তিত হয়। সেই সময় থেকে এখনও ইসলামি ভাবধারায় পরিচালিত দেশগুলোতে ধর্ষণের বিচারে শরীয়াহ আইন প্রচলিত আছে।

প্রাচীন কাল থেকেই ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারীদের অভিযোগ করার প্রবণতা কম। কারণ তথ্য প্রমাণের অভাবে শেষ পর্যন্ত নারীকেই কলঙ্কের ভার বহন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে নারীর ওপর বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্কের দায়ও চাপানো হয়। এমন অনেক দিক বিবেচনায় ভুক্তভোগী নারীরা ধর্ষণের অভিযোগ আনতে চান না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নারীর এই মনোভাবের পরিবর্তন হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে নিপীড়িত নারীরা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অবিচারের বিচার চাইতে শুরু করেন। প্রথম দিকে অল্প সংখ্যক নারী এসব নিয়ে কথা বললেও উনিশ শতকের আশির দশকে সামাজিকভাবে এটি আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর উইমেন (নাও) নামের একটি সংগঠন ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক দাবির মুখে ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে জাতিসংঘের রুয়ান্ডা ও যুগোশ্লাভিয়া ট্রাইবুনালে ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট আইন প্রবর্তিত হয়।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়