ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ৯ম পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৯, ২৬ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৩:২১, ২৬ অক্টোবর ২০২০
হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ৯ম পর্ব

আজ ১০ অক্টোবর। সেই যে সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছিলাম, ভোর ছয়টায় ঘুম ভাঙলো। যাকে বলে এক ঘুমে রাত পার। পাহাড়ে সচরাচর এমন ভালো ঘুম খুব কমই হয়। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশ একদম পরিষ্কার, মেঘ নেই। রাতে যে কুয়াশা পড়েছে তা জমে বরফ হয়ে ঘাস, গাছপালা সাদা হয়ে আছে। লজের সীমানা প্রাচীর থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠে এসে দাঁড়ালাম। পশ্চিম দিকে যে পিসাং ও অন্নর্পূণা রেঞ্জের কয়েকটি পর্বতের চূঁড়া দেখা যাচ্ছে সেগুলোতে সূর্যের আলো জ¦লজ¦ল করছে। তবে এখনো আমাদের এখানে সূর্যের আলো এসে পৌঁছায়নি। এর কারণ হলো আকাশ ছোঁয়া পাহাড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের নাস্তা হলো হিমালয়ের ভেজাল মুক্ত খাঁটি মধু দিয়ে রুটি, সেদ্ধ ডিম, আদা-চা দিয়ে। খাবার শেষ করে সকাল সাড়ে আটটার দিকে আমরা ফু গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

কেয়াং গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসে যখন পাহাড়ের ঢালে চলে এলাম তখন চোখে পড়লো একঝাঁক হিমালয়ান ব্লু শিপ বা ভরাল। এই ব্লু শিপ হলো এক প্রকার ছাগল-হরিণ প্রজাতির প্রাণী। দেখতে আর পাঁচটা সাধারণ ছাগলের মতো হলেও একে সাধারণ ছাগল ভাবলেই ভুল করবেন। এরা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। এদের আবাসস্থল মূলত উচ্চ হিমালয় অঞ্চলে। নেপাল, ভুটান, তিব্বত এবং পাকিস্তানে এদের দেখতে পাওয়া যায়। অঞ্চল বিশেষে এদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।

পাহাড়ের ঢালে হিমালয়ান  ব্লু শিপের পাল

হিমালয়ান ব্লু শিপ আকার-আয়তনে আমাদের দেশের গ্রামবাংলার পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো দেশি ছাগলের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়। ওজন সাধারণত ৩০ থেকে ৭০ কেজি। পুরুষদের আকৃতি স্ত্রীদের থেকে কিছুটা বড় হয়। এদের গায়ের রং সাধারণত ধূসর বা নীলচে। পিঠের দিকটা ধূসর এবং পেটের রং সাদা। চারকোল রঙের দাগের মাধ্যমে এদের পেট এবং পিঠ বিভক্ত থাকে। পুরুষ ও স্ত্রী ব্লু শিপ উভয়ের ক্ষেত্রেই শিং দেখা যায়। পুরুষদের শিং উপরের দিকে বেড়ে পাশে বাঁক নেয়, আর স্ত্রীদের শিং তুলনামূলক ছোট এবং সোজা থাকে। এরা সাধারণত ঘাসযুক্ত ঢালে এবং পাথুরে পাহাড়ের ঢালু জমিতে বাস করে। এরা খুবই পরিশ্রমী প্রাণী। গায়ের রং শিকারীর কাছ থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। কখনো শিকারীর আক্রমণে পড়ে গেলে অত্যন্ত খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে এরা খুব দ্রুত উঠে যেতে পারে। ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন)-এর তালিকায় ব্লু শিপকে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসেবে বলা হয়েছে।

নারখোলার পাড়ে বিপজ্জনক খাড়া পথ

কিছুটা চড়াই উঠে এলাম গ্রাম থেকে। কেয়াং পর্যন্ত সবুজ গাছপালা আছে। এরপর থেকেই লালচে ধূসর পাথুরে এলাকা। এখান থেকেই তিব্বতি আবহাওয়ার এলাকা শুরু। এই নার-ফু অঞ্চল তিব্বতের সীমান্তবর্তী এলাকা। এখনো আমরা নারখোলার পাড় ধরেই হেঁটে চলছি। নারখোলা থেকে সোজা আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন পাথুরে পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে ডিনামাইট ফাটিয়ে চলাচলের পথ করা হয়েছে। সেই পথ ধরেই কখনো ওঠা, কখনো নামা এভাবেই এগিয়ে চলছি। সামনে চোখে পড়লো নার গ্রামে যাওয়ার পথ নির্দেশনা ফলক। হাতের বামে পথটা নেমে গেছে নারখোলার পাড়ে। সাস্পেনশন ব্রিজ পার হয়ে নারখোলা নদীর ওপারেই বেশ বড় ও সুন্দর পরিপাটি বৌদ্ধ গোম্ফা বা মোনাস্ট্রি। বৌদ্ধ গোম্ফা হলো বৌদ্ধ সন্যাসীদের আশ্রম যেখানে তারা ধর্মজ্ঞান চর্চা ও উপাসনা করে। এই গোম্ফার পাশ দিয়েই চলে গেছে নার গ্রামের পথ। আগে এই অঞ্চল পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো। তবে এখন সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে নেপাল সরকার। অ্যাডভেন্সারপ্রিয় মানুষদের মধ্যে এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল। ট্রেকাররা এই নার ফু অঞ্চল ট্রেক শেষে ৫ হাজার ২৪০ মিটার বা ১৭ হাজার ১৯২ ফুট উচ্চতার কাংলা পাস অতিক্রম করে পিসাং হয়ে বেসিশহর চলে যায়। এই অসাধারণ রোমাঞ্চকর ট্রেক শেষ করতে প্রায় ১২ দিন সময় লাগে।

ফু খোলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা টাওয়ারের ডানপাশের ফাঁক দিয়েই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা

এখন আমাদের নামতে হবে। ভয়ানক এই জায়গাটা নেমে আসতে আমাদের প্রায় বিশ মিনিট সময় লেগে গেলো। একটু অসাবধান হলেই শেষ! চার পাঁচশ ফুট নিচে ফু খোলায় পড়ে যেতে হবে। আর পড়ে গেলেই হলো, জীবনের ইতি এখানেই। এখন আমরা ফু খোলা নদীর পাড় ধরে এগিয়ে চলছি। ছোট একটি কাঠের ব্রিজ পার হয়ে নেমে এলাম একদম ফু খোলা নদীতে। পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েকশ মিটার পথ আসতে হলো। নদীর দুই পাশে উঁচু পাথুরে পাহাড়ের মাঝখানে একটি সরু পাথরের টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে।

ফু গ্রামে ঢোকার গেইট

আমরা ডান দিকের গিরিখাদ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে খাড়া চড়াইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। চড়াইটা বেশ খাড়া তবে খাঁজ কাটা নেই। আছে মার্বেলের মতো ছোট ছোট পাথরের টুকরো। ফলে পা ধরে রাখা যায় না, পিছলে যায়। খুবই সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলাম। উঠেই দেখি ফু গ্রামে ঢোকার গেইট। তবে এখনো প্রায় আঁধ ঘণ্টার পথ বাকি। ফু খোলা নদীর উপরে এই অঞ্চলের সব থেকে বড় সাস্পেনশন ব্রিজ পার হয়ে ফু গ্রামে চলে এলাম। গ্রামে ঢোকার আগে একটি বড় গেইট আছে সেখানে লেখা ‘ওয়েলকাম’। আমরাও গেইটের অভ্যর্থনা নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে এই গ্রামে এসে পৌঁছালাম। গ্রামে গাছপালা নেই। ধূসর একটি গ্রাম। দেখে মনে হচ্ছে কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার অংশবিশেষ। তিনটি নদীর মিলিত স্থানেই এই গ্রামের অবস্থান। গ্রামের বামপাশ দিয়ে নেমে এসেছে ধুরকুখোলা নদী, ডান পাশ দিয়ে সোজা নেমে এসেছে ফু ভালদিখোলা নদী আর সোজা ডান দিক থেকে নেমে এসেছে ওখালখোলা নদী। মানাং জেলার নার-ফু অঞ্চলের হিমলুং সাইডের শেষ গ্রাম হলো এই ফু গ্রাম।

গোরুঙ সম্প্রদায়ের মানাঙ্গী বৃদ্ধা

তিব্বতি সীমান্ত এলাকার এই ফু গ্রামের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৮০ মিটার বা ১৩ হাজার ৩৮৬ ফুট। আমরা উঠেছি কারসাং লজে। লজটির দুই তলার একটি রুম আমাদের দেওয়া হয়েছে। প্রথমেই মুহিত ভাই আমাদের দুপুরের খাবারের অর্ডার দিলেন। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা রুমে এসে পোশাক পরিবর্তন করে আবার ডাইনিং রুমে চলে এলাম। বিকেলে গ্রামের ভেতরটা ঘুরে দেখলাম। পাথর দিয়ে ছোট ঘর বানানো হয়েছে। গ্রামের ভেতরে সরু গলি পথ। বেশ পরিষ্কার। কৃষিনির্ভর এই গ্রামের মানুষের প্রধান ফসল আলু। গ্রামের নারীরাই কৃষিকাজ করে। পাহাড়ের ঢালে তারা আলু ও অন্যান্য সবজি চাষ করে। গ্রীন হাউজ প্রক্রিয়ায় বাঁধাকপি, ফুল কপি, রাইশাক চাষ করে থাকে। প্রায় প্রতিটা ক্ষেতেই নারীদের কাজ করতে দেখতে পেলাম। এখানে বসবাস করে গোরুঙ সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে এরা মানাঙ্গী নামে পরিচিত। সেই মানাঙ্গী সম্প্রদায়ের একটি নারীর বয়স শতবর্ষ ছুঁইছুঁই করছে। এই বয়সে এসেও পাহাড়ের চড়াই উতরাই এর মধ্যেও সে বসে নেই। সারাদিন কিছু না কিছু করেই চলেছে। দিনে যতবার তাকে দেখেছি ততবারই পিঠে একটি ঝুড়ি দেখেছি। এই ঝুড়ির মধ্যে জ্বালানির জন্য লাকড়ি, খচ্চরের শুকনা গোবর সংগ্রহ করছে। (চলবে)

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়