ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ১০ম পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ১১ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৩:১৩, ১১ নভেম্বর ২০২০
হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ১০ম পর্ব

ফিলিপাইনের পর্বতারোহী জেমিমা এবং তার ভাই ওজি তাদের শেরপা নিয়ে চলে এসেছে বিকেলের মধ্যে। তাদের ক্যামেরাম্যান জেড রসেল কেয়াং-এ রয়ে গেছে। সে উচ্চতাজনিত অসুস্থতার কারণে অ্যাক্লিমাটাইজ করতেই আরো একদিন অপেক্ষা করবে সেখানে। অ্যাক্লিমাটাইজ হলো উচ্চতায় আবহাওয়ার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়া।

আমরা যে লজে উঠেছি জেমিমারাও একই লজে উঠেছে। রাতের খাবার শেষে আমরা একসঙ্গে কিছু সময় আড্ডা দিলাম। কাল আমাদের রেস্ট ডে। এখানেই থাকবো অ্যাক্লিমাটাইজ করার জন্য। এই উচ্চতা থেকেই অ্যাক্লিমাটাইজ শুরু করতে হয়। নাহলে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে কাল সকালেই জেমিমারা হিমলুং বেসক্যাম্পে চলে যাবে। তাদের শেরপার প্ল্যান বেসক্যাম্পেই একদিন বেশি থেকে অ্যাক্লিমাটাইজ করা।

সকালে উঠে সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা হাইট গেইনে যাবো আজ। ফলে তেমন তাড়া নেই আমাদের। ঘুম থেকে একটু দেরি করেই উঠলাম। সকালের নাস্তা শেষ করে ব্যাগে কিছু শুকনা খাবার আর পানি নিয়ে মুহিত ভাই, ড্যান্ডি শেরপা আর আমি হাইট গেইনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। আর জেমিমারা হিমলুং বেসক্যাম্পের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। এই ফু গ্রামটির পুরনো অংশটুকু এই গ্রামেরই কিছুটা উপরে। সেই অংশটুকু পরিত্যক্ত পড়ে আছে। আজ আমরা সেই পর্যন্ত উঠবো। গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। গলিতে গলিতে শিশুরা খেলা করছে। পৃথিবীর সব শিশুর শৈশব এক! মেয়েরা বাড়ির কাজ করছে, উঠানে বসে রোদ পোহাচ্ছে। পরিত্যক্ত ঘরগুলোতে অনেকে পশুপালন করে দেখে তেমনটাই মনে হলো। সবার উপরে একটি গোম্ফা আছে। এটা এই গ্রামের পুরনো গোম্ফা। আরো একটি বড় গোম্ফা আছে সেটা নিচে নদীর পাড়ে। উপরে উঠে আসার পথেই ফেলে এসেছি এই গ্রামের একমাত্র স্কুল। এই গোম্ফা পর্যন্ত আজকের হাইট গেইন আমাদের। এখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি আর সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার খাচ্ছি। এখান থেকে পুরো ফু গ্রামটি উপর থেকে দেখা যায়। আমরা চারপাশটা মুগ্ধ হয়ে দেখছি। অপরূপ সুন্দর ফু গ্রাম, চার পাশের ধূসর পাথুরে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, দূরে শ্বেতশুভ্র পর্বতশৃঙ্গ হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেলো। এই গ্রামের ওপর দিয়ে সব সময় প্রচণ্ড বাতাস বয়ে যায়। তাই শীতও বেশি এখানে। আমরা রোদে বসে বিভিন্ন পর্বতের নাম জেনে নিচ্ছি ড্যান্ডি শেরপার কাছ থেকে।

হঠাৎ আমাদের সামনে পাহাড়ের ঢালে একঝাঁক স্নোকক বেরিয়ে এলো খাবার খেতে খেতে। এই হিমালয়ান স্নোকক দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের কোয়েলের মতো। তবে এরা অনেক বড়। এবারই প্রথম আমি স্নোকক দেখছি। কি সুন্দর পাখি! এরা আকারে বড় ও ভারী  হওয়ার কারণে বেশি দূর উড়তে পারে না। পর্বতের সেখান থেকে গাছ লাইন শেষ হয়ে যায় সেসব খোলা স্থানে এদের দেখা যায়। স্নোকক মূলত ছোট গাছের পাতা, অঙ্কুর, শিকড়, ফল এবং পোকামাকড় খেয়ে থাকে।  যেহেতু এই অঞ্চলে গাছ নাই তাই এরা পাথরের ফাঁকে, ছোট ছোট গাছের ঝোঁপে বাসা করে প্রজনন মৌসুমে। তাই এদের গ্রাউন্ড-নেস্টিং পাখিও বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণ ইউরেশিয়ার ককেশাস পর্বতমালা থেকে হিমালয় এবং পশ্চিম চীনে এদের আবাস স্থল। পুরুষ ও স্ত্রী স্নোকক দেখতে সাধারণত একই রকম তবে স্ত্রীর তুলনায় পুরুষ স্নোকক বড় হয়। এই পাখিগুলো প্রজাতি অনুসারে বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন সাদা, কালো এবং বাদামী, লেজের নিচে ধূসর সাদা।

ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে  আবার লজে নেমে এলাম। দুপুরের খাবারের জন্য ডাইনিং রুমে এসে বসেছি। এখানে পরিচয় হলো দুজন সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্মি সদস্যদের সঙ্গে। তারা আজ হিমলুং বেসক্যাম্প থেকে নেমে এসেছে উচ্চতাজনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণে। এখানে তারা দুদিন থেকে আবার বেসক্যাম্পে ফিরে যাবে। উচ্চতায় অসুস্থ হয়ে পড়লে নিচে নেমে আসতে হয়। দুই-তিন দিন থাকলে শরীর আবার সুস্থ হয়ে যায় তখন পুনরায় উপরে যাওয়া যায়। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, তারা প্রায় ত্রিশ জনের আর্মি টিম নিয়ে এসেছে হিমলুং অভিযানে। তাদের সাথে আড্ডা, গল্প আর তাস খেলে আজকের দিনটি কেটে গেলো। তারা আরো একদিন এখানে থাকবে। আমরা কাল সকালে বেসক্যাম্পে চলে যাবো।

১২ অক্টোবর সকালে আমরা ফু গ্রাম থেকে হিমলুং বেসক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গ্রামের গলি পথ ধরে কিছুটা উপরে উঠে আবার নেমে এলাম খরস্রোতা ফু ভালদিখোলা নদীর তীরে। ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে তাশি লাখাং গোম্ফার পাশ দিয়ে এগিয়ে চলছি। গোম্ফা পেরিয়ে এসে ওখালখোলা নদীতে নেমে এলাম। এই নদীতে পানি নেই বললেই চলে। যতটুকু পানি আছে তা সহজেই পার হয়ে যাওয়া যাচ্ছে পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। বেশ কিছু পরিত্যাক্ত ঘরবাড়ির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এখানে এখন কোনো পরিবার বাস করে না। এখানে পশুপালন করা হয়ে থাকে। এখানেই আমি প্রথম ভেড়ার লোম সংগ্রহ করতে দেখলাম। বেশ কয়েকজন মানুষ কাঁচি দিয়ে ভেড়ার গা থেকে লোম কাটছে। আমরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে দেখলাম। আমরা এখন এগিয়ে চলছি পাংগ্রি গ্লেসিয়ারের উপর দিয়ে। এই পুরো পথে যে নারখোলা, ফু খোলা, ফু ভালদিখোলা এবং ওখালখোলা নদীর পাড় ধরে এসেছি, এইসব নদীর উৎসস্থল হলো এই পাংগ্রি গ্লেসিয়ার।

মাঝপথ আসতে না আসতেই সেই স্বপ্নের হিমলুং পর্বত প্রথম দেখতে পেলাম। এ যেন স্বয়ং সে নিজেই আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। কি সুন্দর দেখতে এই চূঁড়া! যার টানে নিজের দেশ ছেড়ে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। মনের ভেতরে এক অজানা উত্তেজনা এসে নাড়িয়ে দিলো। দুপুর বারোটার দিকে আমরা বেসক্যাম্পে চলে এলাম। পাংগ্রি গ্লেসিয়ারের উঁচু সমতল জায়গাতে হিমলুং বেসক্যাম্প। চারপাশে আকাশ ছোঁয়া পর্বতে ঘেরা এই বেসক্যাম্প। এই ক্যাম্পের উচ্চতা ১৪ হাজার ৮৫০ ফুট। হিমলুং পর্বতচূড়া আস্তে আস্তে পর্বতারোহীদের কাছে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। তাই আগের তুলনায় এখন অভিযানের পরিমাণ বেড়েছে। আমাদের ছাড়াও আরো দশ, বারোটা টিম এখানে অবস্থান করছে। পর্বতারোহীর সংখ্যাও প্রায় পঞ্চাশ জন। আর শেরপা ও কিচেন স্টাফসহ প্রায় একশর উপরে হবে। দেখে মনে হচ্ছে এ যেন এক তাবুর গ্রাম। আমরা আমাদের এজেন্সির আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা তাবুতে চলে এলাম। কিচেন স্টাফরা আমাদের জুস দিয়ে অভ্যর্থনা জানালো। জুস খেয়ে আমার ডাইনিং তাবুতে এসে বসলাম। তাবুটা বেশ বড়, এখানে ডাইনিং টেবিলে ছয়টি চেয়ার রাখা আছে। এই উচ্চতায় এসে এসব পাবো ভাবিনি। যদিও বড় অভিযানগুলোতে এরকমই ব্যবস্থা থাকে। এটাই আমার প্রথম বড় অভিযান তাই আমার জন্য এসব নতুন কিছু। আমাদের কিচেন তাবু থেকে খাবার এনে দেওয়া হলো। আমরাও অমৃতের মতোই সেসব খেতে শুরু করলাম। আজকের মেন্যুতে ভাতের সঙ্গে চিকেন, করল্লা ভাজি, সবজি, ডাল। খাবার শেষে দই, আপেল ডেজার্টের ব্যবস্থাও আছে।

খাবার শেষে আমাদের থাকার জন্য যে তাবু করা হয়েছে সেখানে নিয়ে আসা হলো। ডাইনিং তাবু থেকে একটু দূরে আমাদের তাবু। আমদের জন্য এজেন্সি পাঁচটি তাবু করেছে। প্রতিটি তাবুই আলাদা। মুহিত ভাই এক তাবুতে আর আমি এক তাবুতে। বাকি তিনটি তাবুতে আরো তিন জন পর্বতারোহীর জন্য। তাবু ভেতরে ঢুকে তো আমি অবাক! তাবুর ভেতরে অনেক জায়গা এবং দাঁড়ানোও যাচ্ছে। এরকম তাবুতে আগে কখনো থাকিনি। বিছানা হিসেবে নরম ম্যাট্রেসও দেওয়া আছে। এই তাবুই আগামী চৌদ্দ-পনেরো দিনের স্থায়ী থাকার ঘর। যদিও মাঝখানের কিছু দিন মূল অভিযানে উপরে থাকবো।  (চলবে)

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়