ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

দানবীর শহীদ রণদা প্রসাদ সাহার জন্মদিন আজ

প্রতিভা মুৎসুদ্দী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১২, ১৫ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:৫৩, ১৫ নভেম্বর ২০২০
দানবীর শহীদ রণদা প্রসাদ সাহার জন্মদিন আজ

দানবীর শহীদ রণদা প্রসাদ সাহার জন্মদিন আজ। ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দেবেন্দ্র সাহা পোদ্দারের সহধর্মিনী কুমুদিনী দেবীর কোল আলো করে বাংলাদেশের তথা সারা উপমহাদেশের গৌরব রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম।

কিন্তু কুমুদিনী দেবীর দুর্ভাগ্য যে এ শিশুর জন্মের ৭ বছর পর তিনি পরলোক গমন করেন। একটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে মারাত্মক টিটেনাস রোগে ধুঁকতে ধুঁকতে তিনি বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করেন। রণদা ৭ বছর বয়সে মাতৃহারা হয়ে বিমাতার অনাদর আর আপনজনদের অবহেলা-অবজ্ঞায় ঘরছাড়া ছন্নছাড়া হয়ে দুরন্ত হয়ে ওঠেন। পথে ঘাটে ঘুরে ফিরে ফুটপাতে শুয়ে, রাস্তার ধারে কলের জল খেয়ে, কুলি কামিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ভাগ্যান্বেষণে বের হয়ে পড়েন রণদা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তাকে বহির্বিশ্বে হাতছানি দিয়ে ডাকে। রণদা যোগ দেন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে সাধারণ সেবকের বেশে। বিপন্ন রোগীর জন্য তার অসাধারণ কর্মনিষ্ঠা ও সেবাপরায়ণতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধাহত রোগীদের তাঁবুতে দৈবাৎ অগ্নিকাণ্ড ঘটে, নিমেষে আগুন সমস্ত তাঁবু গ্রাস করে। নিজের জীবন বিপন্ন করে রণদা ঝাঁপিয়ে পড়েন জ্বলন্ত তাঁবুতে, একে একে উদ্ধার করেন সব অগ্নিদগ্ধ রোগীকে। এরপর অজ্ঞান অবস্থায় তাকে দেখতে পান তার ক্যাপ্টেন এবং তাকে সুস্থ করে তোলেন। এ অসম সাহসীক ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে এ সংবাদ পৌঁছালে রাজা পঞ্চম জর্জ সাদর আহ্বান জানান বীর রণদাকে, তাকে সম্মানিত করেন ‘সোর্ড অব অনার’ উপহার দিয়ে। এ সম্মান তার জীবনের প্রথম জয়মাল্য।

যুদ্ধের অবসান হলে যুবক রণদা নতুনভাবে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। প্রথমে বিভিন্ন পরিবারে কয়লা সরবরাহ, পরবর্তীতে জাহাজে জাহাজে। এতে তার ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হন।  তিনি বেশ কিছু অর্থের মালিক হন। সাথে সাথে শুরু হয় তার মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ড। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শোভাসুন্দরী দাতব্য ডিসপেনসারি তার পিতামহীর স্মরণে ১৯৩৮ সনে। এই বছরেই তার প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে ‘ভারতেশ্বরী বিদ্যাপিঠ’ নামে একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করেন তার আত্মীয় মির্জাপুরের যোগেন্দ্র পোদ্দারের বাড়ির প্রাঙ্গণে, যা ১৯৪৫ সনে ভারতেশ্বরী হোমস্ নামে স্থানান্তরিত করা হয় বর্তমান স্থানে। ওই সময় কুমুদিনী হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়- যা ১৯৪৪ সনে কুমুদিনী হাসপাতাল নামে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মেটার্নিটি ওয়ার্ড খুলে। উদ্দেশ্য যেন কোনও মা সন্তানের জন্ম দিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা না যান। বাংলার লাট বাহাদুর Lord R G Casey এই কুমুদিনী হাসপাতাল উদ্বোধন করার জন্য সুদূর পল্লীগ্রাম মির্জাপুরে আসেন।

১৯৪০ সনে তিনি অ্যান্ডারসন কোম্পানির যাবতীয় সম্পত্তি - Jute Baling Press, Godowns ইত্যাদি এবং B.R.S. ক্রয় করেন, এতে তার প্রচুর অর্থ উপার্জন হয়। কিন্তু তার যা উপার্জন হয় তার চেয়ে বহুগুণ তিনি ব্যয় করেন সমাজ উন্নয়নের কাজে। তার এক সুহৃদ তাকে বলেছিলেন - ‘ভায়া ধীরে চলো, এভাবে চললে তো সব ফুরিয়ে যাবে’। তিনি হেসে বলেছিলেন- ‘মা দুর্গা আমাকে দশ হাতে দেন, আমি দুই হাতে তা ফুরাবো কি করে?’ এরপর তিনি একে একে স্থাপন করেন মায়ের নামে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ, মানিকগঞ্জে পিতার নামে দেবেন্দ্র কলেজ, ঢাকায় Combined Military Hospital এর Maternity Wing।  এছাড়া তার বিপুল অনুদান ছিল S K High School, Karatia Saadat College, Magura College, Jamurki Boys' High School এবং বাংলার বহু প্রতিষ্ঠানে।  কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস্ ও কুমুদিনী কলেজের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন তিনি নিজে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মাধ্যমে।  এজন্য ভারতেশ্বরী হোমস্, কুমুদিনী হাসপাতাল ও কুমুদিনী কলেজের সকলেই তাকে জেঠামনি বলে সম্বোধন করতেন।

ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির পূর্বক্ষণে ১৯৪৭ সনের মার্চ মাসে তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে Kumudini Welfare Trust (Pakistan Ltd.) গঠন করলেন- যে সময়ে পূর্ব বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় এদেশ ত্যাগ করে ভারতবর্ষে চলে যায় চিরতরে।  রণদা প্রসাদকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় বলেছিলেন- আপনি ভারতে আসেন আমি আপনাকে সব সুযোগ করে দেবো।  তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘জন্মভূমি ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। মরতে হয়, আমি জন্মভূমিতেই মরবো।’

আমি ভারতেশ্বরী হোমসে যোগদান করি ১৯৬৩ সনে দুই বছরের জন্য। কেননা মনে করলাম রণদা প্রসাদ সাহা একজন Capitalist, আর আমি সোভিয়েত রাশিয়ার ভক্ত - সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সুতরাং তার সাথে আমার আদর্শের মিল হতে পারে না। সুতরাং ২ বছরের বেশি সময় এখানে থাকা যাবে না।

কিন্তু এখানে এসে দেখি, সকল ছাত্রীর একই রকম পোশাক। হোস্টেলে সাদা জামা, স্কুলে নীল টিউনিক সাদা ব্লাউজ, ড্রিলে নীল স্কার্ট সাদা ব্লাউজ, শোবার ব্যবস্থা, ডরমেটরি, একই রকম বিছানাপত্র। খাওয়া দাওয়া ডাইনিং হলে একই সাথে একই রকম, এক সাথে কাজ করা, রান্না করা - কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান, কে ধনী, কে গরিব- বোঝার উপায় নেই। আবার সব ব্যয়ভার ট্রাস্টের অর্থাৎ রণদা প্রসাদ সাহার। পাশের কুমুদিনী হাসপাতালে রোগী,  নার্স, ডাক্তার - চিকিৎসা সেবা সবই নিঃখরচায়। দেশি ও বিদেশি ডাক্তাররা এখানে কাজ করেন। সকল ব্যয়ভার রণদা প্রসাদ সাহার - তার ট্রাস্টের।

তা সত্ত্বেও ১৯৬৫ সনে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে পাকিস্তান সরকার Enemy Property ঘোষণা করে। রণদা প্রসাদ সাহা ট্রাস্টের Custodian, ব্যবসাপাতি একেবারেই মন্দা। তা সত্ত্বেও তিনি সব প্রতিষ্ঠান একইভাবে চালিয়ে গেছেন- কারও কাছ থেকে একটি কপর্দকও গ্রহণ করেননি। বরং হাসপাতালের বহির্বিভাগ, টি বি রোগীদের ওয়ার্ড, ভারতেশ্বরী হোমসের দক্ষিণ দিকের সম্প্রসারণ সবই এই দুঃসময়ে করেছেন। মাঝে মাঝে আমি তার কাছে এখানকার চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। তিনি কেবল বলেছেন - আমি যদ্দিন বেঁচে আছি আমাকে ছেড়ে যেও না মা। আমি মারা গেলে তুমি যেখানে খুশি যেও। তার এই দুঃসময়ে আমি তার একান্ত সাহচর্যে কাজ করেছি। তাই তখন থেকেই মা বলেই ডাকতেন। জেঠিমা কিরণবালা সাহা আমাকে শাশুড়ি বলে ডেকে একান্ত কাছে টানতেন।

এরপর ১৯৭০-এর National Assembly-র নির্বাচন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ, পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র, ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে পাক বাহিনীর আক্রমণ, বুদ্ধিজীবি হত্যা, নিরীহ মানুষ হত্যা, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা।  সেই থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় দিবসের পূর্বদিন পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনী বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণির নিরীহ প্রায় ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে। এর মধ্যে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে সপুত্র গ্রেপ্তার করে ২৯ এপ্রিল এবং ৫ মে ছেড়ে দেয়। আবার ৭ মে দানবীরের গ্রাম মির্জাপুরে গণহত্যা চালিয়ে যাবার পূর্বে সারা গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। রাতে ১১টার দিকে তার কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জের খানপুরের বাসভবন থেকে রণদা প্রসাদ, তার একমাত্র পুত্র ভবানী প্রসাদ, তার সহচর গৌর গোপাল সাহাসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে গুম করে ফেলে। তাদের কোনও সন্ধান মেলেনি। এভাবে তাদের রক্ত বাংলার লাখো শহীদের রক্তস্রোতের সাথে মিলিত হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এর বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য উদিত হয়- আমরা বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র লাভ করি। আজ সেই দানবীর শহীদ রণদা প্রসাদ সাহার ১২৪ তম শুভ জন্মদিন! শুভ জন্মদিন! শুভ জন্মদিন!

জেঠামনি, আপনার উত্তরসূরিরা আপনার সকল কীর্তিমালা গৌরবের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার জয়া ১৯৭১ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত আপনার মানব সেবার পতাকা গৌরবের সাথে বহন করেছেন। ২০০০ সন থেকে আপনার নয়নের মণি রাজীব আপ্রাণ সাধনা করে যাচ্ছে মানবতার সেবায়। আপনার নাম বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে গাঁথা হয়ে আছে। আজকের এই মহান দিবসে আপনার শুভ জন্মদিনে কুমুদিনী পরিবারের সকলে ভক্তিপূর্ণ প্রণতি আর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি এবং চলার পথে আপনার আশীর্বাদ আর নির্দেশনা কামনা করছি।

-আপনার স্নেহধন্য মা প্রতিভা।

 

(লেখিকা: একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক ও পরিচালক কুমুদিনী কল্যান সংস্থা)

ঢাকা/হাসনাত/শাহ মতিন টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়