ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আনন্দের ক্লান্তি নিয়ে চিরঘুমের দেশে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

সন্দীপন ধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৫, ১৯ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:২১, ১৯ নভেম্বর ২০২০
আনন্দের ক্লান্তি নিয়ে চিরঘুমের দেশে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

চলে গেলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। ফের নিঃস্ব হলো বাংলা সাহিত্য। গত মঙ্গলবার জার্মানিতে নিজ বাসভবনেই মৃত্যু হয় কবির। স্থানীয় সময় রাত ন’টায় না-ফেরার দেশে পারি দেন অলোকরঞ্জন। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বেশ কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত নানান সমস্যায় ভুগছিলেন কবি। 

১৯৩৩ সালের ৬ অক্টোবর কলকাতায় জন্ম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শেষ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ভারতীয় কবিতার শব্দমালা নিয়ে পিএইচডি করেছিলেন অলোকরঞ্জন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ থেকে শুরু করেন কর্মজীবন। অধ্যাপক হিসেবে এখানে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় পড়িয়েছেন। সেসময় জার্মান সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ থেকে অনুবাদের কাজ হাত দেন। বাংলার সাহিত্য সম্ভারও তিনি অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন রাইন নদীর দেশে। এরপর হামবোল্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ নিয়ে পড়াতে যান জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া সে দেশের অত্যন্ত নামী প্রতিষ্ঠান ডয়েশ-ইনডিশ-গ্যাসেলশ্যাফট, যা মূলত ভারত-জার্মানির সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে, সেখানে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন কবি।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এমন একজন কবি, যিনি তাঁর সহকর্মী এবং ভক্তদের দ্বারা প্রশংসিত তো বটেই, তাঁর কবিতা মূলভাব এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য পরিচিত। বাংলা-জার্মান সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর মতো বিরাট কর্মকাণ্ডের জন্য সে দেশের সরকার তাঁকে ‘গ্যেটে’ পুরস্কারে সম্মানিত করে। জার্মানিতেই পাকাপাকিভাবে বাস করছিলেন তিনি। তবে কলকাতার সঙ্গে সংযোগ ছিল নিবিড়। এখানকার সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে উৎসাহী ছিলেন। তরুণ প্রতিভাদের চিনে নিত তাঁর জহুরির চোখ।

ঐতিহ্যের প্রবাহমানতায় বিশ্বাসী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পূর্ণ পৃথক এক বাচনভঙ্গি তৈরি করেছিলেন, যা তাঁর একান্ত নিজস্ব। নিত্য নতুন শব্দের সন্ধান, অপূর্ব শব্দ বিন্যাস কবিতামনস্ক পাঠকদের তাঁর কবিতার প্রতি আকৃষ্ট করে। কেমন লেখেন অলোকরঞ্জন? পড়া যাক তাঁর কবিতার কিছু অংশ: 

‘এক-জানালা-রাত্রি আমার কাটল কেমন করে;
মোগলসরাই প্যাসেঞ্জারে বৃষ্টি নামল তোড়ে।
বৃষ্টি নামল, ভীরু ধানক্ষেত ভালোবাসার মতো,
আলের পথে আলের পথ আলিঙ্গনরত।

এক-জানালা-রাত্রি আমার কাটল কেমন করে,
বৃষ্টি থামল, সাঁকোর তলায় এই পৃথিবী ক্রোড়ে
মা জননী বসে আছেন, চোখের সামনে খালি
শহরে কাজ নিতে পালায় বলাই বনমালি।’
[এক-জানালা-রাত্রি আমার]

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। সাহিত্য জগতে বিশেষ অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৯২ সালে ‘মরমী করাত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান অলোকরঞ্জন। এই কাব্যগ্রন্থই পরবর্তী সময়ে তাঁকে প্রবাসী ভারতীয়ের সম্মান এনে দেয়। এছাড়া পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার। পঞ্চাশের দশকে রবির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বাংলা কাব্যে স্বকীয়তা এনেছিলেন যে হাতে গোনা কয়েকজন, তাঁর মধ্যে অন্যতম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁর কাব্যচেতনা তরুণদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। নবীন প্রজন্মকে বরাবর বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ দিয়েছেন কবি। শব্দ নির্মাণে এবং ব্যবহারে তাঁর মতো মুন্সীয়ানা খুব কম কবি-ই দেখাতে পেরেছেন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতায় বিশ্ব সংস্কৃতির প্রভাব সব সময় লক্ষ্য করা গেছে।

‘এখন যুদ্ধ না শান্তি স্পষ্ট করে বুঝতেই পারি না
যুদ্ধ ঠিক শেষ হয়নি, অথবা এখন শান্তি শেষ’

যুদ্ধ-শান্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্ব থেকে বিদায় নিলেন কবি অলোকরঞ্জন।

‘উত্তর অতলান্তিকে বৃষ্টি হলে
তোমার এখানে কেন রৌদ্র হবে?’

রৌদ্র হয়নি আজ, এখানে। উত্তর অতলান্তিকের বৃষ্টি ঝরে পড়েছে বাংলার মাটিতে, অশ্রুকণা হয়ে ককির মৃত্যুতে। তিনি লিখেছেন:

‘আমি তো এক শখের নিছক শব্দব্যবসায়ী
আনন্দের ক্লান্তি আনে আমার চোখে ঘুম’

কবির কথা দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে হচ্ছে, আনন্দের ক্লান্তি নিয়ে চিরঘুমের দেশে পারি দিলেন তিনি। তবে বাঙালির মননে তাঁর স্থান চিরস্থায়ী।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়