ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: সূচনা পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ২৩ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:৪৪, ২৩ নভেম্বর ২০২০
বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: সূচনা পর্ব

নিরাপত্তা চেকিং-এর পর বোর্ডিং-এর অপেক্ষায় বসে আছি। কাচের দেয়ালের ওপারে একটা উড়োজাহাজ থেকে যাত্রীদের মালামাল নামানো হচ্ছে নির্দয়ভাবে; যেন একেকটা আলুর বস্তা নিক্ষেপ করা হচ্ছে! আমার ব্যাগের কথা মনে পড়ায় এক ধরনের কষ্ট অনুভূত হলো। আমার ব্যাগটাও তো ঠিক এমন করেই নামানো হবে! শরীরে আঘাত লাগলেও ক্ষতি নেই কিন্তু ওই ব্যাগটার সামান্য ক্ষতি হলে মেনে নেওয়া বড়ই কষ্টকর। এরই মধ্যে কানাডা থেকে বন্ধু নবীনের ফোন- কী খবর? বিমান ছাড়ার আর কতক্ষণ বাকি ইত্যাদি। মিনিট দশেকের আলাপে প্রধান প্রসঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিলো ব্যাগ নামানোর ব্যাপারটা। ওর অভিজ্ঞতায় চরম অব্যবস্থাপনার এই নজির বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। এরই মধ্যে উনত্রিশ তারিখ পেরিয়ে ত্রিশে অক্টোবর উপস্থিত। ফ্লাইট রাত একটা দশ মিনিটে। তার আগে আমার শ্যাওড়াপাড়ার ছোট্ট বাসা থেকে প্রথমে রিকশা, তারপর বাসে করে উপস্থিত হই বিমানবন্দর। বাসস্ট্যান্ড থেকে টুকটুক করে হেঁটেই বন্দরের ভেতর প্রবেশ করলাম।

সব আনুষ্ঠানিকতার পর বাসে সমস্ত যাত্রীকে নিয়ে যাওয়া হলো উড়োজাহাজের গোড়ায়। প্রায় সমস্ত যাত্রীই মালয়েশিয়াগামী। সেখানে তিন ঘণ্টার একটা ট্রানজিটের পর কম্বোডিয়ার নমফেন যাত্রা। সারাটা রাত একরূপ নির্ঘুম কেটে গেল। জানালা দিয়ে নিচের পৃথিবী দেখে আমার প্রাণ ভরে না। তেমন কিছু দেখা যায় না, তবুও মনে হয় সমস্ত পথে নজর বুলিয়ে যাব। মালয়েশিয়ার সময় সকাল সাতটায় কুয়ালালামপুরে অবতরণ করলাম। পরের ফ্লাইটের আগ দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে চাইলাম কিন্তু সে আর হলো না। জোর করে অনেক কিছুই হয়, ঘুমানো যায় কিনা জানি না। হাতমুখ ধুয়ে একটু সতেজ হয়ে পায়চারী শুরু করলাম। চাকচিক্য দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম কিন্তু এ যাত্রায় ওসবে আমার খুব একটা পর্তায় হলো না। তার প্রধান কারণ রাতের ঘুমটা ঠিকমতো না হওয়া। বাহ্যিকভাবে বোধ করতে না পারলেও শরীরের ভেতরটা ঠিকই ক্লান্ত। কোনো রকমে সময় কেটে গেল। বোর্ডিং পাসের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় আলাপ হয় নমফেনগামী বাংলাদেশি অপর দুই যাত্রীর সঙ্গে। মূলত বহির্গমন কার্ড পূরণে সামান্য সহযোগিতা করার সূত্রে তাদের সাথে আলাপ ও পরিচয়। গেরুয়া পোশাকি ভিক্ষু অপরজন মাহ্দী আল আমীন। দু’জনেই নিজ নিজ দাপ্তরিক কাজে কম্বোডিয়া রওনা করেছেন। জাহাজে উঠে কে কোথায় বসলাম তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কিন্তু নমফেনে অবতরণের পর মাহ্দী ভাইয়ের সঙ্গে ঠিকই দেখা হলো। মূলত তিনি আমাকে খুঁজছিলেন। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের সঙ্গে সেখানে ব্যতিক্রম আচরণ করা হয়। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এমনটাই জেনেছিলাম। সুতরাং প্রস্তুতিটাও সে অনুসারে নেওয়া ছিল। দেখা গেল খবরের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। মাহ্দী ভাইকে গাড়িতে করে নেওয়ার জন্য লোক এসেছে। সসম্মান স্বাগতম ও পরিচয় পর্বের পর আন্তরিক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা পথ তাদের সহযাত্রী হলাম। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে কর্মকর্তাটি নিজে একটি মোটরসাইকেল ডেকে আমাকে তুলে দিলেন। তাদের এই উপকার কোনোদিনই ভুলবার নয়। মোটরসাইকেলে চেপে চললাম আমার ঠিকানা কমের স্ট্রীট, পু রক হোস্টেলের দিকে। নমফেনের রাস্তায় গাড়ি আর মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় সমানে সমান। গণপরিবহণ বলতে কার আর মাইক্রোবাসের পাশাপাশি এই মোটরসাইকেল। প্রায় আধাঘন্টার যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম হোস্টেলে। 

উড়োজাহাজ থেকে দেখা ‍নিচের শহর

বড় ঘর, থাকার ব্যবস্থা দুইতলা বিছানায়। লকারের চাবিসহ বুঝিয়ে দেওয়া হলো আমার বিছানা। সর্বপ্রথম দরকার একটা প্রশান্তির গোসল। বারান্দায় মাত্র বসেছি, সামনে এসে হাজির হলেন একজন বাংলাদেশি। হোস্টেলের অভ্যর্থনায় আমাকে দেখার পর থেকেই অনুসরণ করছিলেন। নারায়ণগঞ্জের মানুষ আপাতত নমফেনেই আছেন, তবে তার আগে ইন্দোনেশিয়ায় ছিলেন, এখনও মাঝে মধ্যে সেখানে যাতায়াত আছে। তথ্যে গড়মিল বলে দেয় কম্বোডিয়ায় তিনি স্বাভাবিক কোনো পর্যটক নন। তারই মাধ্যমে পরিচয় হলো মুম্বাইয়ের ছেলে স্রেয়াজের সাথে। চঞ্চল ছেলে স্রেয়াজ কয়েকদিন পর ইন্দোনেশিয়া চলে যাবেন। পশ্চিমা দেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট ভারি করতেই তার এই ভ্রমণ। দুপুরের খাবারের বেলা প্রায় যায় যায়। তারাও খাবার খায়নি। তিনজনের উদ্দেশ্য মিলে গেল। বেরিয়ে পড়লাম। গরম বেশ, বাংলাদেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শীতল হওয়ার জন্য আগে ঠান্ডা কিছু পান করা দরকার। অদূরেই একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকে একেকজন একেকটা পানীয় নিলাম। আমি নিলাম লাচ্ছি। ঘটি আকৃতির কাঁসার পাত্রে সুন্দর করে পরিবেশিত হলো ফেনিল লাচ্ছি। তৃপ্তি করে শেষ চুমুকটি দেওয়ার পর খোঁজ নেওয়া হলো দুপুরের খাবার হিসেবে কী আছে? যা আছে তার সবই তৃপ্তিদায়ক কিন্তু দাম বেশ চড়া। অতএব, প্রস্থানপূর্বক স্রেয়াজের পরিচিত নেপালি রেস্টুরেন্টের উপর ভরসা রাখা হলো। অবেলায় তিন তিনজন খদ্দের পেয়ে স্বত্বাধিকারী বেজায় খুশি! খাবারের অর্ডার নিতে নিজেই উঠে এলেন। খাবারের পদ নির্বাচনের ভার এসে পড়ল আমার উপর। আমি শুধু বললাম, সঙ্গে কি থাকবে বা না থাকবে সেটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই; আমার চাই শুধু ভাত। পেট ভরে ভাত খেতে পারলেই শান্তি। কেউই অমত করল না। টেবিলটা পরিষ্কারই আছে, তবুও নতুন করে মুছে দিতে এগিয়ে এলো নম্র স্বভাবের এক যুবক। চেহারায় বাঙালি ছাপ, জিজ্ঞেস করতেই সানন্দে জাবাব দিলো- বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপপুর। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। পেটের দায়ে তিন বছর হলো অবৈধভাবে পড়ে আছে নমফেন শহরের এই রেস্টুরেন্টে। খায়-দায় সেখানেই ঘুমায়। মাস গেলে সন্তোষজনক বেতন পায়।

শহরের প্রধান বাহন মোটর সাইকেল

আধাঘণ্টার মধ্যে আমাদের খাবার চলে এল। জিরা ছড়ানো ভাত, পনির মাখন দিয়ে মুরগির মাংস এবং তরকারী। ভাতে যে জিরার সংযোজন হতে পারে দেখে আমি মুগ্ধ! খেতে খুবই মজা। আর পনির মাখনে তরকারীর পদ দুটোর স্বাদ কখনও ভুলব না। বলতে দ্বিধা নেই সম্পূর্ণ এই ভ্রমণে এত তৃপ্তিদায়ক খাবারের দেখা আর মেলেনি। আমার সতৃপ্ত চেহারা অবলোকন করে স্রেয়াজের মাঝে এক ধরনের সার্থকতা অথবা কৃতিত্বের ছাপ ফুটে বের হলো। খাবার শেষ হওয়ার আগেই ঘুঁচে গেল সংশয়, কৃতিত্বের নয়, তার মুখজুড়ে ফুটে বের হওয়া নির্মল অভিব্যক্তিতে। অধিকন্তু, সাধুবাদ প্রাপ্তির ক্ষীণ প্রত্যাশা। সে নমফেনে বেশ কিছুদিন অবস্থান করছে। স্বভাবিকভাবেই অনেক বিষয়ে জানাশোনা তার। কথাপ্রসঙ্গে সে জানাল এই শহরের বড় বড় প্রায় সব দালানের মালিক চায়না বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।

জিরা ছিটিয়ে দেওয়া ভাত খেতে মন্দ নয়

আলাপচারিতায় বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেল। এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। জ্বলে উঠল চারদিকের বাতি। এখান থেকে তিনজনের পরবর্তী গন্তব্য তিনদিকে। এখানে আপাতত আমার কোনো লক্ষ্য নেই। লক্ষ্য পরের দিন সকালে উত্তর-পশ্চিমের সিয়াম রেপ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। সুতরাং পথে পথে হাঁটাই আমার একমাত্র কাজ। গাড়িঘোড়া চলাচল করে রাস্তার ডান পাশ ধরে এবং শৃঙ্ক্ষালার সঙ্গে। শহরে মানুষের সংখ্যা কম। এক জায়গায় জটলা পাকানো পাঁচজন মানুষ পাওয়া মুশকিল। রাত আট কি সাড়ে আটটা পর্যন্ত এ-পথ, সে-পথ ঘুরে বুঝতে পারলাম মোটামুটি নিরাপদ শহর তবে দু’এক জনের সাবধান বাণী- ব্যাগ সাবধানে রাখবেন; হঠাৎ করে মোটরসাইকেল এসে ওটা টান দিয়ে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে যাবে! (চলবে)

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়