ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা: রূপকথার চরিত্র নাকি নিষ্ঠুর হত্যাকারী?

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ২৫ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১১:০০, ২৫ নভেম্বর ২০২০
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা: রূপকথার চরিত্র নাকি নিষ্ঠুর হত্যাকারী?

সালটা ১২৮৪। জার্মানির লোয়ার সাক্সনির হ্যামেলিন শহর। সেই বছর শহরটিতে ব্যাপকভাবে ইঁদুরের আবির্ভাব হয়। শহরের সবার উৎকণ্ঠা সেই ইঁদুর কীভাবে তাড়ানো যায়। শহরের পাইক-পেয়াদা থেকে মেয়র সবার একটাই চিন্তা। কিন্তু কেউ কোনোভাবেই এর সমাধান করতে পারছিলেন না।

কিন্তু হঠাৎ একদিন কোথা থেকে বড়সড়ো বাঁশি নিয়ে এলেন এক বাঁশিওয়ালা। তিনি মেয়রের কাছে গিয়ে এক উপায় বাতলে দিলেন। ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ইঁদুর তাড়াতে রাজি হলেন। বাঁশিওয়ালা সব ইঁদুরকে শহরের পাশের নদীতে চুবিয়ে মারলেন। এরপর মেয়রের কাছে তার প্রাপ্য চাইলেন কিন্তু মেয়র মাত্র ৫০ স্বর্ণমুদ্রা দিতে রাজি হলেন। বাঁশিওয়ালা রেগে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বেন!

হ্যামেলিন শহরের এই চার্চে শিশুরা একত্রিত হয়েছিল 

১২৮৪ সালের জুন মাসের ২৬ তারিখ। সেই দিনটিতে ছিল শহরে সেইন্ট জন-পল দিবস। সবাই ছিলেন চার্চে। সকাল ৭ টায় তিনি শিকারির সবুজ রঙ্গের পোশাকে বাঁশি হাতে মায়াবি এক সুর তুললেন। সেই সুরের মোহনীয়তায় মেয়রের মেয়েসহ ১৩০ জন শিশু বাঁশিওয়ালার সুরে সম্মোহিত হয়ে এক পাহারের আড়ালে গুহায় ঢুকে পড়ে। আর কোনো দিন ফিরে আসেনি। কিন্তু বেঁচে ফিরেছিল তিন শিশু। একজন কানে শুনতে পেতো না, তাই সুর শুনেনি। একজন ছিল জন্ম অন্ধ। তাই জানত না, কোথায় যেতে হবে। আরেকজন জ্যাকেট ফেলে যাওয়া বাসা ফিরে এসেছিলেন নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফিরে এসে কাউকে পায়নি। সেই তিন শিশুর মাধ্যমে চার্চ থেকে ফেরত মানুষজন সবাই জানতে পারল কী ঘটেছিল।

হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ার এই গল্প জানেন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। তবে এটি কী সত্যিই ঘটেছিল নাকি রূপকথার গল্প তা অনেকেই জানেন না! বলা হয়ে থাকে, জার্মানিতে এমন একটি ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে এর প্রমাণও নাকি পাওয়া গেছে। ১২৮৪ সালের ঘটনার পরেই শিশুদের স্মরণে শহরের চার্চে ‘স্টাইন্ড গ্লাস’ বা রঙ্গিন কাঁচের জানালা লাগানো হয়। আমরা যেমন খ্রিষ্টাব্দ বলি যার মাধ্যমে খ্রিষ্টের জন্মকে স্মরণ করা হয়, তেমনি হ্যামেলিন শহরের সরকারি ঐতিহাসিক রেকর্ড শুরু হয় এই ঘটনার রেফারেন্স দিয়েই। প্রথমে যে এন্ট্রি লিপিবদ্ধ করা আছে, তা ১৩৮৪ সালের। সেখানে লেখা আছে— ‘১০০ বছর হতে চলছে, আমাদের শিশুদের হারিয়েছি।’ ১৫৫৯ সালে এর বিস্তারিত ঘটনায় ইঁদুরের সেই কাহিনি পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিকদের মতে, সেই বাঁশিওয়ালা ছিলেন এক শিশুকামী। আবার কেউ কেউ বলছেন মহামারিতে মারা যাওয়ায় গ্রামবাসী এই কাহিনি বানিয়েছেন কিংবা এই শিশুদের ক্রুসেডে পাঠানো হয়েছিল, গ্রামবাসী যখন দেখল, শিশুরা আর ফিরে আসেনি, তখন এই ধাপ্পাবাজি গল্প ফেঁদে নিজেদের সান্ত্বনা দিতে।

১৩৮৪ সালে হ্যামেলিনের ডেকান লুডের কাছে থাকা বইতে লাতিন ভাষায় দাদির ভাষ্যে নিজের চোখে দেখা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ঘটনা লিখিত ছিল। সতেরো শতকে এসে বইটি হারিয়ে যায়। ১৪৪০ সালের ‘Luneburg’ পাণ্ডুলিপিতে জার্মান খোদাই করে লেখা এই অনুচ্ছেদ বলা হয়েছিল ‘১২৮৪ সালের ২৬ জুন, সেন্ট জন পল দিবসে হ্যামেলিনের জন্ম নেওয়া ১৩০ জন শিশু এক হরেক রঙ বংশীবাদকের সম্মোহনে পিছন পিছন হারিয়ে যায়। কোপেনের পিছনে কালভারিতে। কোপেন হলো হ্যামেলিনকে ঘিরে থাকা পাহাড়।’

সেই বাঁশিওয়ালাকে স্মরণ করে স্থাপন করা হয়েছে মূর্তি

১৫৫৬ সালে বলা হয়, বংশীবাদক আসলে ছিল শয়তান। কালের বির্বতনে আধুনিক যুগে এসে কেউ কেউ বলেছেন— বাঁশিওয়ালা আসলে ছিল এক এলিয়েন, কোপেন পাহাড়ের ব্যাখ্যা— মহাকাশযান করে শিশুদের নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের গ্রহে। কারণ সেখানে জনসংখ্যা বাড়ানোর দরকার ছিল। নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির সুর বাজিয়ে কখনো ইঁদুর কখনো শিশু আর্কষণ করতে পারত তার যন্ত্র দিয়ে।

বর্তমানের হ্যামেলিন শহরে কেউ বেড়াতে গেলে দেখতে পাবেন সেখানে আছে বাঁশিওয়ালার মূর্তির সাথে ইঁদুর ছবি। প্রতিবছর ২৬ জুন পালন করা হয় ‘র‌্যাট ক্যাচার’ ডে। যে রাস্তায় শিশুদের শেষ দেখা গেছিল সে রাস্তায় গান বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু কী হয়েছিল সেই ১৩০ শিশুর ভাগ্যে এবং হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার রহস্য আজও অমীমাংসিত।

সূত্র: এনসিয়েন্ট ওরিজিন ডটনেট

ঢাকা/মারুফ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়