ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মূর্তি ও ভাস্কর্যের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও কারণ আছে

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৩:৪৬, ২৭ নভেম্বর ২০২০
মূর্তি ও ভাস্কর্যের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও কারণ আছে

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বাংলাদেশ ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক বোর্ড অব গভর্নর। সম্প্রতি দেশে ভাস্কর্য বিষয়ে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে এ বিষয়ে আমরা তাঁর মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। পাশাপাশি এই কথোপকথনে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে ইসলামি দলগুলোর ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর ইসলামিক প্রজ্ঞা এবং  এ সম্পর্কিত রাষ্ট্র ভাবনা এবং বর্তমান সময়ের কথা। ইসলাম, সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এই কথোপকথনে তাঁর সঙ্গে ছিলেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা অনার্য মুর্শিদ

অনার্য মুর্শিদ: আরবের ছোট গোত্রগুলোর প্রতি বড় গোত্রগুলোর শোষণ এবং মুহাম্মদ (স.) এর অর্থনৈতিক মুক্তির দর্শনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোনো মিল কি আপনি খুঁজে পান?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: ধন্যবাদ আপনাকে। চমৎকার প্রশ্ন! আরবের শক্তিশালী গোত্রগুলোর অত্যাচার পৃথিবীর কোনো নীতি বা যুদ্ধনীতিতে পড়তো না। এরা এতো প্রতিশোধপরায়ণ ছিল যে, কোনো একটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে একবার প্রতিশোধ নিয়েই থেমে যেত না। অনেকদিন পর্যন্ত এর জের তারা টানত এবং প্রতিশোধ নিতো। 

অনার্য মুর্শিদ: খুনকা বদলা খুন...।

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: খুনের বদলা খুন হলে তো ভালোই ছিল; বিনা কারণেও খুন, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন তারা করত। তো এমন এক সময়ে ইসলাম পৃথিবীতে এলো। ইসলাম কেন এলো? মানুষের মুক্তির জন্য। কী থেকে মুক্তি?  মানুষের উপর মানুষের যে প্রভুত্ব- তা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ মানুষ মানুষের খোদা হবে না। মানুষ মানুষের উপর বে-আইনিভাবে নির্যাতন জুলুম করবে না। এই জুলুমের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব বিস্তারের বিরুদ্ধেই রাসুল (স.) এবং তাঁর সাহাবিরা মানুষকে বুঝিয়েছেন, কাজ করেছেন, আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধও করেছেন এবং মজলুম, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন।

আপনার প্রশ্ন ছিল, এই গোত্রভিত্তিক অত্যাচারের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের কোনো মিল ছিল কিনা? এটা তার চেয়েও বেশি। এজন্যই যে, আমরা উভয়েই ছিলাম মুসলমান। ১৯৩৭ সালে এই বাঙালিদের ভোটেই প্রথম পাকিস্তানের ভীত রচিত হয়। ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক একটি মুসলিম যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পক্ষে লাহোর প্রস্তাব করেন। অবশ্য যেভাবে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিয়ে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবে হয়নি, তবে এর সূচনা বা ভিত্তি ছিল পাকিস্তান। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো পাকিস্তানের জন্মের পর যে জুলুম, অত্যাচার আমাদের উপর শুরু হলো, তারা হয়ে গেল শাসক, আমরা হয়ে গেলাম শাসিত। এবং তারা হয়ে গেল শোষক, আমরা হলাম শোষিত। এই শোষণ, বঞ্চনা, জুলুম তারা যা করেছে এটা আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগের মতোই। আপনি যথার্থ বলেছেন।

অনার্য মুর্শিদ:  যুগে যুগে নবী রাসুল এবং মহামানবরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেহাদ করেছেন। যেমন মুসা এবং তাঁর সঙ্গীরা ফেরাউনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ইব্রাহিম এবং তাঁর সঙ্গীরা অত্যাচারী নমরুদের বিরুদ্ধে, মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবিরা অত্যাচারী গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে সংগ্রাম, এই সংগ্রামকে এখনো অনেক বাঙালি মুসলমান ‘জিহাদ’ বলতে রাজি নন। ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ মানে কি শুধুই ধর্মযুদ্ধ? নাকি যে কোনো অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই জিহাদ?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: খুব যুগোপযোগী প্রশ্ন। জিহাদের ইসলামি পরিভাষা কিন্তু বলছে না, শুধু ধর্মের উপর আঘাত এলেই জিহাদ করতে হবে। বরং ধর্মের উপর আঘাত ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ আছে। যেমন কোরআন শরিফে আছে: ‘তোমাদের কী হলো, যখন শিশু এবং নারীরা নির্যাতিত হয়ে কাঁদে এবং বলে- হে প্রভু আমাদের জন্য সাহায্যকারী পাঠাও। আমাদের জন্য নেতা পাঠাও। যিনি আমাদেরকে জুলুম থেকে পরিত্রাণ করবেন।’ হাদিস শরিফে আছে: ‘জিহাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম জিহাদ হলো জালেম শাসকের সামনে তার জুলুমের প্রতিবাদ করা।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর জীবনের চব্বিশটি বছর এরকম জালেম শাসকের জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন। এই জিহাদের সর্বশেষ পরিণতি ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ সে ধরনেরই একটি সংগ্রাম।

অনার্য মুর্শিদ: মুসলিম জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: আমাদের জন্মগতভাবে একটা সংস্কৃতি আছে। যেমন কুরাইশদের ছিল, আরবদের ছিল। নবী করিম (স.) আরবের সন্তান, আল্লাহ তাঁকে নবী করে পাঠালেন কী জন্য? তিনি এসে বললেন, ‘আমি এসেছি সমস্ত সৃষ্টির জন্য আর্শীবাদ হয়ে, রহমত হয়ে।’ এই রহমতগুলোর যে গুণাবলী এটা আমরা অর্জন করেছি আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। আর আমাদের যে ভাষা, আমাদের যে কালচার, এটা তো আল্লাহ নিষিদ্ধ করেননি। জন্মগতসূত্রে পাওয়া জাতীয়তাবাদ আর বিশ্বাসের সূত্রে পাওয়া ধর্ম দুটি দুই মেরুর জিনিস। একটার সঙ্গে আরেকটা গুলিয়ে ফেললে তো চলবে না। আল্লাহ প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের কাছে নবী প্রেরণ করেছেন এবং তার ভাষাতেই প্রেরণ করেছেন। আমাদের বলা হয়েছে, রাসুল (স.) এর পূর্বে যত নবী এসেছেন সবার উপর ঈমান আনার জন্য। কিন্তু কারো কালচারকে মানা, কারো ধর্মকে মানার জন্য আমাদেরকে বলা হয়নি। মোহাম্মদ (স.) শেষ নবী, তিনি বিশ্বের সকল ভাষাভাষি মানুষের নবী। বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর যারা ইসলাম অনুসরণ করেন, তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির চর্চা ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই তারা করে আসছেন। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমার জন্মসূত্রে, বিশ্বাসের সূত্রে আমি মুসলমান।

অনার্য মুর্শিদ: সম্প্রতি একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যসহ দেশের অন্যান্য ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছে। আপনি এই দাবিটি কীভাবে দেখছেন?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: মূর্তি ও ভাস্কর্যের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও কারণ আছে। এ বিষয়ে আরও আলোচনা ও গবেষণারও প্রয়োজন আছে। যারা হঠাৎ করেই ভাস্কর্য ভাঙা বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার আন্দোলনে লোকজন রাস্তায় নামাতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য সন্দেহজনক। এই মহামারির সময়ে মানুষের আবেগে উস্কানি দিয়ে জামায়াতে ইসলামী কপট রাজনীতির মাধ্যমে সরকার ও দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে কিনা এ বিষয়ে হক্বপন্থী ওলামারা ভেবে দেখবেন বলে আমি আশা করি।

অনার্য মুর্শিদ: আমাদের দেশে প্রতিবার পূজার সময় কোনো না কোনো মন্দিরে প্রতিমা ভাঙা হয়। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন।
মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: পূজা-অর্চনায় বিঘ্ন ঘটনো মুসলমানের কাজ নয়। এটা অপরাজনীতির উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করা হয়।

অনার্য মুর্শিদ: আপনি একটি ইসলামি দলের চেয়ারম্যান। সে হিসেবে একাত্তর সালে ইসলামি দলগুলোর মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতা এবং অংশগ্রহণ সম্পর্কে আপনার নিশ্চয়ই ভালো ধারণা আছে। সে সময় ইসলামি দলগুলোর ভূমিকা কী ছিল?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: ৭১ সালে ইসলামিক দলের সংখ্যা এখন যে পরিমাণ আছে এ পরিমাণ ছিল না। কয়েকটি দল ছিল। জমিয়তুল ওলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম আর মুসলিম লীগ। জামায়াতে ইসলাম এগুলোকে কখনো ইসলামিক দল হিসেবে গণ্য করতো না। জমিয়তুল ওলামায়ে ইসলামের নেতৃত্ব দিতেন প্রসিদ্ধ আলেমরা। নেজামি ইসলামের নেতৃত্বেও আলেমরাই ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ অবলম্বন করেছেন এমন ইতিহাস আমাদের জানা নেই। এমনকি প্রখ্যাত আলেম ওলামাদের মধ্যে, এখন যারা প্রসিদ্ধ বা এখন যারা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে প্রকাশ্য সমর্থন দেওয়ার লোক ছিল কম। তবে অনেক আলেম, ওলামারাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। এটা বিচ্ছিন্নভাবে, দলীয়ভাবে নয়।

অনার্য মুর্শিদ: জামায়াতে ইসলামকে কেনো আপনি ‘ইসলামিক দল’ বলে মনে করেন না?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী:  ১৯৪১ সালে ভারতের হায়দরাবাদে মওলানা মওদুদি একটা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে প্রথম জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। মওলানা মওদুদি ভারতের স্বাধীনতায়ও বিরোধীতা করেছিলেন। যারা মূল ধারার আলেম, হক্বপন্থী আলেম, সবাই ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। মওলানা হোসেইন আহমেদ মাদানি, রশীদ আহমেদ গাঙ্গুহি, দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা কাসেম নানুতুবি, জওহরলাল নেহরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মহাত্মা গান্ধী- এক মঞ্চ থেকে বক্তৃতা করেছেন। সাংঘাতিক একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি ছিল। কিন্তু মওলানা মওদুদিই প্রথম সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বললেন, ‘ভারত স্বাধীন হোক, চাই না-হোক, আমি চাই হুকুমতে এলাহি প্রতিষ্ঠা করতে।’ তখনই ভারতের মূল ধারার প্রখ্যাত আলেমগণ প্রায় একযোগেই বলেছেন, তিনি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বৃটিশের এজেন্ট হয়েই এ কাজগুলো করছেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে তিনি কায়েদে আজমের পরিবর্তে ‘কুফুরে আজম’ বলতেন। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের পাটনায় তিনি সম্মেলন করে পাকিস্তানের বিরোধীতা করলেন। কিন্তু ওই বছর আগস্ট মাসেই পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়ে গেল। এক বছর পরে তিনি পাকিস্তানে এলেন এবং লাহোর ‘দারুল ইসলাম’ নাম দিয়ে সো কল্ড ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখান থেকে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখালেখি শুরু করলেন। তখন পাকিস্তান সরকার তার এই প্রবন্ধগুলো নিষিদ্ধ করেছিল। এবং তার দল অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামকে ১৯৪৮ সালেই নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সরকার। পরবর্তীতে যখন আবার সামরিক সরকারগুলো ক্ষমতায় আসে, পাকিস্তানে লিখিত কনস্টিটিউশন তৈরি হতে অনেক দেরি হলো (পাকিস্তান হলো ৪৭ এর আগস্টে কিন্তু ৫৬ সাল পর্যন্ত কোনো সংবিধানই ছিল না)। এ সময় তিনি প্রায় একশটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন পার্লামেন্টে নারী সদস্য নির্বাচন হারাম আখ্যা দিয়ে। অথচ আইয়ুব খানের সঙ্গে যখন ফাতেমা জিন্নাহর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, তখন হঠাৎ করে তিনি ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিলেন। এরকম ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইসলামের ছদ্মাবরণে জামায়াত পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করেছিল। বঙ্গবন্ধু যখন ৭০ এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন তখন জয়লাভের ক’দিন পরেই গোলাম আজম সাহেব একটা সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ‘শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।’ আবার যখন ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তার ক’দিন পরেই গোলাম আজম সাহেব ঢাকায় আরেকটা প্রেস কনফারেন্স করলেন এবং বললেন, ‘শেখ মুজিব ভারতের দালাল, তাকে ফাঁসি দেওয়া হোক।’ এই যে দু’মুখো নীতি, ইসলামবিরোধী নীতি; যা কিছু করেছে জামায়াতে ইসলাম। অন্যান্য আলেমদের হয়ত কেউ কেউ পাকিস্তান সমর্থন করেছেন, কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময় নীরব ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু সশস্ত্রভাবে নিজের ছাত্র সংগঠন দিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা, তাদের সঙ্গে এক হয়ে নিজের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করে তাদের ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া- এটা জামায়াতে ইসলামের তাদানিন্তন ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতৃত্বে হয়েছে। কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য, পরে তারা আমাদের দেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর আশ্রয় প্রশ্রয়ে থেকে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়েছে! এমনকি সরকার গঠনেও অংশ নিয়েছে!  তারা মন্ত্রীসভার সদস্য হলো, বাংলাদেশের পতাকা তাদের গাড়িতে উড়লো- এ নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ। আপনি যেটা প্রশ্ন করেছিলেন, ইসলামিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে, এটা সত্য কথা যে দলীয়ভাবে ইসলামিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি অংশ নেয়নি এবং সমর্থনও করেনি, আমার জানা মতে।

অনার্য মুর্শিদ: আর নেজামে ইসলাম পার্টি?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: নেজামে ইসলামও তখন একটা ছাত্র সংগঠন দিয়ে ‘আল শামস বাহিনী’ গঠন করেছিল। তবে তাদের বিরুদ্ধে তুলনামূলক ব্যাপক অভিযোগ আমি শুনিনি। তবে তারা যে নামেই করেছিল, এটার ব্যাপারে একটা প্রচার আছে এবং জনগণ তাদেরও প্রত্যাখ্যান করেছে।

অনার্য মুর্শিদ: বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী শক্তি একটা বিষয় প্রচারে প্রায় সফল হয়েছে। সেটা হলো- মুক্তিযুদ্ধকে ‘মালাউনদের যুদ্ধ’ বলে অপপ্রচার। আপনার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের ব্যাপারে কী মানসিকতা পোষণ করতেন?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: দেখেন সত্যকে অপপ্রচারের মাধ্যমে ঢেকে রাখা যায় না। বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি ঈমানদার মুসলমান ছিলেন। আমাদের যে এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এর নাম ছিল ‘রেসকোর্স ময়দান’। রেসকোর্স মানে ওখানে ঘোড়দৌড় হতো, জুয়া খেলা হতো। জুয়া খেলায় ঢাকার অনেক মানুষ পথের ফকির হতো। ইসলাম জুয়া পছন্দ করে না। তিনি ক্ষমতায় এসেই এটা বন্ধ ঘোষণা করলেন। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম তাবলিগ জামায়াতের একটা টিম রাশিয়ায় প্রেরণ করলেন এবং ১৯৭৫ সালে তিনি ইসলামিক একাডেমি ও বায়তুল মোকাররম মসজিদকে নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করলেন। এ জন্য তিনি যে আইন, যে অ্যাক্ট করে গেছেন, এই অ্যাক্ট অনুযায়ী ইসলামিক ফাউন্ডেশনে এখনো চলছে। এত দূরদর্শী নেতা ছিলেন যে, আগামী একশ বছরও যদি ইসলামের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে করে তাহলে বঙ্গবন্ধুর অ্যাক্টে নতুন করে কিছু সংযোজন করতে হবে না। তিনি কী বলেছেন তাঁর অ্যাক্টে? বলেছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন করার উদ্দেশ্য হলো মসজিদ নির্মাণ করা, সংস্কার করা, ইসলামি গবেষণাগার চালানো, ইসলামের যে ফিলোসফি, শিল্প, আর্কিট্যাক্ট এ সমস্ত কিছুকে গবেষণার আওতায় নিয়ে আসা। কোরআন হাদিসের প্রকৃত অনুবাদ করা, ধর্মের সঠিক প্রচার এবং প্রসার করা। এই যে একটা অর্গানাইজেশন তিনি করে দিয়ে গেছেন, আজকে অবাক হতে হয় এই ৭৫ সালের অ্যাক্টেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন চলছে। এখন বাংলাদেশের ৮০ হাজার মসজিদের ঈমাম, মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা এবং কোরআন শিক্ষার সাথে তারা জড়িত। বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং পূর্বপুরুষও এখানে ইসলাম প্রচারের জন্যই এসেছিলেন। ধার্মিক একটা পরিবার। তাঁর আব্বা, দাদা, তাঁদের ইতিহাস যদি সংগ্রহ করেন, তাঁদের নানা, তাঁরা সবাই ইসলামের প্রতি খুব অনুগত ছিলেন। তাঁদের চরিত্র, মন-মেজাজ সবই ইসলামিক ছিল। তাহলে যারা বঙ্গবন্ধুকে ‘ইসলামের দুশমন’ বলে ব্যাখ্যায়িত করতে চান, তারা কী করে ইসলামিক হয়? এরা আসলে প্রকৃত ইসলাম মানে না। ইসলামের নামে এরা ধোঁকাবাজী করে, ভণ্ডামি করে। আজকে লক্ষ লক্ষ আলেম বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দিচ্ছে। কওমি আলেমরা এখন বুঝতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু তাদের কল্যাণ চেয়েছিলেন। এই ক’দিন আগে কাবার ঈমামকে দাওয়াত করে আনার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি, আমি, আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ সাহেব মক্কা গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, আমরা শেখ মুজিবের ব্যাপারে শুধু মিথ্যাই শুনেছি। এখন এই মিথ্যা দিয়ে কতদিন চলা যায়! বাদশা ফয়সালের সঙ্গে ইসলামি সম্মেলনে তাঁর যখন দেখা, তখন বাদশা ফয়সাল বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব, আপনি যদি বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করেন তাহলে আমি স্বীকৃতি দেব।’ তিনি বললেন, ‘মহামান্য বাদশা, আপনাকে একটা কথা বলি, আপনার দেশের নাম কিংডম অফ সৌদি আরব কেন? এটা ইসলামিক রিপাবলিক নয় কেন? আরেকটা প্রশ্ন আপনাকে করি, ইসলাম কি শুধু একটা দেশের জন্য না সমস্ত বিশ্বের জন্য?’ তখন বাদশা হতবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এই প্রশ্নেই তো বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর ইসলামিক প্রজ্ঞা কত গভীর। সুতরাং অপপ্রচার তো অপপ্রচারই; এটার অপমৃত্যু হয়েছে।

অনার্য মুর্শিদ: সংবিধানের চারটি মূলনীতি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সংঘর্ষ আছে বলে আপনার মনে হয় কী?

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: একটা চমৎকার বিষয় হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন মাস বা চার মাসের ভেতরেই আমাদের সংবিধান রচনা হয়। যে ‘জাতীয়তাবাদ’ আমাদের সংবিধানে আছে, সেটা হলো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। বাঙালি আমরা জন্মগত, সম্প্রদায়গত। হয়ত বিশ্বাসগতভাবে আমরা মেজরিটি মুসলমান। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আমাদের সংস্কৃতি বাংলা, এখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধর্মের সঙ্গে কোনো প্রকার সাংঘর্ষিক নয়। এরপরে সমাজতন্ত্র। কার্ল মার্ক্স, লেনিন তারা যে সমাজতন্ত্র অনুশীলন করেছেন এই সমাজতন্ত্র বাংলাদেশে অচল। কিন্তু আমাদের যে সমাজতন্ত্র বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সেটা হলো বৈষম্যহীন একটা সমাজব্যবস্থা। এখন এটাকে আপনি যে নামেই আখ্যায়িত করেন না কেন; ধর্মের সঙ্গে এর কোনো বিরোধ নেই। এবার আসেন ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা যে শব্দটা আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, ধর্মের সঙ্গে এর একটা বিরোধ আছে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হলো সব ধর্মের মানুষ তার নিজের রাষ্ট্রে নিরাপদে বাস করতে পারবে। আমাদের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সব ধর্মের মানুষ এই রাষ্ট্রে নিরাপদে তার ধর্ম পালন করতে পারবে। রাষ্ট্র থেকে বিশেষ ধর্মের প্রতি কোনো প্রকার বিদ্বেষ বা বিরূপভাব পোষণ করবে না। ইসলাম এটাই চায়। জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করা- এটা তো ইসলামে নিষেধ। অতএব যে উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যবহৃত হয়েছে, ইসলামের সঙ্গে তার বিরোধ নাই। মহানবী (স.) এর মদিনা নামক রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে একটাও ইসলামিক রিপাবলিক ছিল না, ধর্মরাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু ধর্মের চর্চা ছিল, ধর্মের অনুশীলন ছিল, মানুষ ধর্ম মানত। ধর্ম কার জন্য? মানুষের জন্যই তো! নবী (স.) এসেছেন কিসের জন্য? তিনি যদি শুধু মদিনাকে ইসলামিক রিপাবলিক করতেন, বিশ্বের অন্যান্য জায়গা কী হতো! এজন্য সারা বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানই একটা আজগুবি রাষ্ট্র যার নাম হলো- ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। অথচ পাকিস্তানে সবই ছিল, শুধু ইসলাম ছিল না। ওখানে চব্বিশ বছর ইসলামের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। নামটা ছিল ‘ইসলামিক রিপাবলিক’। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানে আছে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বুঝতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটা ধর্মহীনতা নয় বরং অসাম্প্রদায়িক একটা নীতি। আর গণতন্ত্র; এটার সঙ্গেও ইসালামের কোনো বিরোধ নেই। ইসলাম তো জনগণকে সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা দিয়েছে! নাকি দেয়নি? ইসলামে ‘সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ’। কিন্তু আল্লাহ তো আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেননি। আপনি অযথা কেনো এর থেকে বঞ্চিত হবেন।

অনার্য মুর্শিদ: তরুণ প্রজন্মের উদ্দ্যেশ্যে যদি কিছু বলতেন।

মিছবাহুর রহমান চৌধুরী: বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যে জানাশোনা থাকা দরকার এটা আমাদের প্রতিভাবান তরুণদের মধ্যে আছে। ভবিষ্যতে তারা এ রাষ্ট্রের হাল ধরবেন। তরুণদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, তরুণরা যত প্রযুক্তি বা অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হোক, যদি নৈতিকতা না থাকে তাহলে এই অর্থনীতি, এই প্রযুক্তি সব কিছুর মধ্যে ধ্বস নামতে বাধ্য। এটা ভালো কাজে লাগে না। সব জায়গায় সব পেশার তরুণ-তরুণীরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করছি, নৈতিকতার দিকে দিয়ে অনকটা আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। দেশব্যাপী মাদকের যে সয়লাব, ঘুষ, দুর্নীতি- এগুলোকে প্রতিরোধ করতে পারবে তরুণরাই। আমাদের বিশ্বাস আছে। তার প্রমাণ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। কত সুন্দরভাবে তারা শিখিয়ে দিলো কীভাবে রাস্তায় গাড়ি চলবে। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল- ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব। আমি কিশোরদের আহ্বান করব, তাদের অভিভাবকদের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে যদি তারা অগ্রসর হয়, তাহলে যেভাবে আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অতিক্রম করে উন্নত দেশে পরিণত হবো। জন্ম দিতে পারব একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়