ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ৩য় পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২১, ১২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৪:৩৪, ১২ ডিসেম্বর ২০২০
বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ৩য় পর্ব

সাইকেলের জন্য আলাদা লেন থাকা নিরাপদ

সাতসকালে সাইকেলের দোকানে হাজির হলাম। বলা হলো চাইলে মাউন্টেন সাইকেল নিতে পারেন, চালিয়ে আরাম পাবেন। প্রস্তাব যেহেতু পেলাম একটু চালিয়ে দেখি। না, সুবিধা করতে পারলাম না; উপুর হয়ে চালাতে হয়। আমার দরকার এমন সাইকেল যা সোজা হয়ে বসে চালানো যায়। তাতে আশপাশটা ঠিকমত দেখতে সুবিধা। সেক্ষেত্রে আগের রাতে দেখে রাখাটাই বের করে নিলাম। গিয়ারওয়ালা সাদা রঙের সাইকেল। বাঁকানো হ্যান্ডেল, সামনে জিনিসপত্র রাখার জন্য একটা ঝুরিও আছে। মূলত এটি লেডিস সাইকেল। সাধারণত শাড়ি পরা মহিলারা এই ধরনের সাইকেল ব্যবহার করেন।

ভোরের নির্মল পরশ নিয়ে ছুটতে হলো টিকিট কাউন্টারে। এরই মধ্যে শহরটা জেগে উঠেছে। জগিং শেষে সৌখিনেরা ঘরে ফিরছেন। পথে পথে ঝরে পড়া পাতা কুড়াতে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের তৎপরতা লক্ষণীয়। সাইকেলে ধাতস্ত হতে একটু সময় লাগল। তারপর সুবিধামতো গিয়ার পরিবর্তন করে এগিয়ে চললাম। পথ নির্দেশক হিসেবে সঙ্গে আছে একটা মানচিত্র আর পথচারীদের পরামর্শ। চলতে চলতে হঠাৎ আমার সমস্ত মনোযোগ গিয়ে নিবদ্ধ হলো পথের ধারের এক দৃষ্টিনন্দন বাজারে। হরেক পণ্যের মধ্যে যে জিনিসটি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তা হলো পাউরুটি। এ যেন পাউরুটির বাজার। লাঠির মতো লম্বা, চ্যাপ্টা, গোলসহ নানান আকার ও আকৃতির রুটি। বিক্রেতাগণ বাঁশের ঝুরি ভর্তি রুটি নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন। ওদিকে আমাকে যেতে হবে শহরের প্রান্ত ছেড়ে আরও দূরে। সুতরাং বাজারে বেশি সময় অতিবাহিত করার সুযোগ নেই বললেই চলে। পুনরায় পথে উঠল আমার দ্বিচক্রযান।

আঙ্কোর সিটির মূল নিদর্শন

সর্বসাকুল্যে এক ঘণ্টা পর দেখা পেলাম টিকিট কাউন্টারের। কাউন্টার তো নয়, যেন একটা প্রাসাদ। ফাঁকা জায়গার মধ্যে সুবিশাল চত্বরেরে প্রান্তে একটা বড় দালান। বেশ কয়েকটা কাউন্টার কিন্তু ভিড় একেবারেই নেই। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন টিকিট প্রত্যাশী। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যবস্থা। তাৎক্ষণিক ছবি তুলে তা টিকিটের গায়ে ছাপা হয়ে বেরিয়ে এলো, মূল্য ৩৭ ডলার। এটা এক দিনের টিকিট। এর সুবাদে একজন দর্শনার্থী চাইলে সারাদিন আঙ্কোর সিটির সমস্ত নিদর্শন দেখতে পারে। এরপর দ্বিতীয় পর্বের যাত্রা শুরু। আঙ্কোর সিটির প্রবেশ মুখে পৌঁছতে নিরিবিলি আর নির্জন পথে যেতে হলো আরও প্রায় চল্লিশ মিনিট। পথিমধ্যে এক উন্মুক্ত দোকান ‘নোম বাইন চক’-এ স্থানীয় খাবার দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। খাবারটা মূলত নুডলস-এর একটা পদ। নুডলসগুলো কিছুটা সুরুয়ায় ডুবানো। তার উপর দেওয়া হলো পেঁয়াজ কুঁচিসহ কয়েক প্রকারের সালাদ। সব শেষে আলতো করে ছড়িয়ে দেওয়া সরিষা বা অরোহর কালাইয়ের মতো কয়েকটা হলুদ ফুল। পাশে চেয়ার পাতা। ঠিক তার সামনে একটা টেবিলে চিলি ফ্লেক্স, চিলি সস নানা রঙের মসলাপাতি সাজানো। খদ্দের চাইলে স্বাদ অনুযায়ী যোগ করে নিতে পারেন।

সাতসকালে অপরিচিত মানুষ পেয়ে সমবেতদের কৌতূহল হলো। তারাই বলে দিলেন কোন জিনিস কি পরিমাণ যোগ করলে খাবার অধিক মজাদার হবে। নোম বাইন চক খেতে খেতে তাদের সঙ্গে হয়ে গেল সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাণবন্ত আড্ডা। এবার বিদায় বলে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। একা জংলী পথে নিজেকে আরো একা মনে হলো। পাশাপাশি মনের মধ্যে এক ধরনের রোমাঞ্চও খেলে গেল। কোনো যানবাহন নেই। পর্যটক ভর্তি হঠাৎ একটা কি দুইটা গাড়ি আমাকে পেছনে ফেলে ছুটে চললো একই গন্তব্যে। চেকপোস্টে টিকিট বা প্রবেশপত্র দেখিয়ে ঢুকে পড়লাম আঙ্কোরের নিরিবিলি পথে।

এ যেন পাউরুটির বাজার। লম্বা, চ্যাপ্টা, গোলসহ নানান আকার ও আকৃতির রুটি

পুরনো বৃক্ষের ঘন জঙ্গলে আবৃত পথে সাইকেল চালিয়ে যেতে আমার খুব ভালো লাগল। মনে হলো অনন্তকাল ধরে শুধু এ পথেই চলি। ঠিক সেই গানের মতো- এই পথ যদি শেষ না হয়... গানের মতো। আচমকা বানর দলের বিচরণ পথিকের জন্য কিঞ্চিৎ আঁৎকে ওঠার মতো পরিস্থিতির অবতারণা করলেও কিছুক্ষণের মধ্যে তা একটি অতি সহজ বিষয়ে রূপ নিল। ঝিরঝির বাতাস আর পাখির কলতানে মুখরিত পথ আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিল। আমিও নিশ্চিন্তে পথের সঙ্গী হলাম। পথের উভয় পাশ দিয়ে সাইকেলের জন্য সুনির্দিষ্ট আলাদা লেন থাকায় চলতি পথ আরও বেশি নিরাপদ। উপস্থিত হলাম পুরো এলাকার মানচিত্রে নির্দেশিত দুই নম্বর স্পট আঙ্কোর ওয়াট-এ। সাইকেল বা অন্যান্য যানবাহন নিরাপদে রাখার বন্দোবস্ত থাকায় নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। মূল আঙ্কোর ওয়াটে পৌঁছতে পাঁচ মিনিটের মতো হাঁটতে হলো। তার আগেই পাথর নির্মিত একতলা ভবনটিতে একটা ঢুঁ মেরে নিলাম। সিঁড়ি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতেই শরীরের মধ্যে যেন ছমছম করে উঠল। ভবনটির অপর পাশ দিয়ে বের হলে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পথ। পথের প্রান্তে চত্বরের মধ্যে একটা স্থাপনার কিয়দাংশ দৃষ্টিগোচর হলো। কাছে যেতেই চোখের সামনে সম্পূর্ণটা জুড়ে ফুটে উঠল প্রকাণ্ড স্থাপনাটির একটা বড় অংশ। আকারে এত বড় যে দৃষ্টি পরিধির মধ্যে একবারে গোটা স্থাপনা আনা যায় না। সম্পূর্ণটাই পাথর দিয়ে নির্মাণ করা। স্থাপনার মধ্যভাগের শীর্ষে পাঁচটি সুউচ্চ মঠ বা চূড়া। মাঝেরটার উচ্চতা তুলনামূল বেশি। এই পাঁচাটি বাদে পাশে আরও চূড়া ছিল, তার প্রমাণ সেগুলোর ধ্বসপ্রাপ্ত বা ভেঙে যাওয়া অংশবিশেষ।

এটাই পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মীয় স্থাপনা আঙ্কোর ওয়াট। খেমার সাম্রাজ্যের বহু অনবদ্য স্থাপনার মধ্যে একটা। নির্মাণ কাল ১২ শতক, আয়তন ১৬২.৬ হেক্টর। নির্মিত হয়েছিল দেবতা বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে। হিন্দু মন্দির হিসেবে নির্মিত হলেও ইতিহাসের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী সময়ে তা বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছিল। চারপাশ ঘুরে দেখা সম্ভব হলো না, তাতে পুরো একটা দিন এখানেই শেষ হয়ে যাবে। দুই পাশের কিছুটা অংশ দেখার পর প্রবেশ করলাম ভেতরে। বাইরে যেমন অজস্র কারুকাজ আর নকশার প্রাচুর্য, ভেতরেও তার চেয়ে কম নয়। স্থাপনার কোণায় কোণায় সুদক্ষ ও সমৃদ্ধ নির্মাণশৈলীর সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। একমাত্র পাথর বিনা অন্য কিছুর ব্যবহার চোখে পড়ল না। সামান্য কিছু অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। পাশাপাশি সংস্কার কাজও চলমান। অনেক মূর্তির অংশ বিশেষ ভাঙা। ভাঙার ধরন দেখে অনুমান করা যায় তা কোনো দৈব ঘটনা ছিল না। এত বড় স্থাপনার ছাদজুড়ে ব্যবহৃত হয়েছে শুধু পাথর।

নুডলসগুলো সুরুয়ায় ডুবানো, তার উপর দেওয়া হলো পেঁয়াজ কুঁচিসহ কয়েক প্রকার সালাদ 

ছাদের গঠন নৌকার ছাউনির মতো। অর্থাৎ খিলান স্থাপত্যশৈলীর আদলে গড়া। পাথর খণ্ডগুলো এমনভাবে কাটা হয়েছে এবং পাশাপাশি সংযুক্ত করা যে, প্রতিটি পরস্পরকে আজও ধরে রেখেছে। জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে পাথরের লচিয়া। এত চমৎকার করে কাটা যে কাঠের লচিয়াকেও হার মানাবে। দেয়ালে দেয়ালে বসানো আছে বহু চিত্র খোদিত পাথর খণ্ড। আবার কিছু দেয়াল বা মোটা খুঁটির গায়ে ফুলের পাপড়ি বা স্বর্ণলতিকার মতো নকশা কাটা। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে তার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি। পাথরের উপর এত সূক্ষ্ম আর মসৃণ শিল্পকর্ম সত্যিই অনবদ্য। বহু প্রকোষ্ঠের ভবনটিতে আছে একাধিক উন্মুক্ত উঠান। সূর্যের আলো প্রবেশ করে সহজেই তা চারদিকের ঘরগুলোতে প্রবেশ করতে পারে। উঠানের মেঝেজুড়েও পাথর বিছানো। স্থাপনা সংরক্ষণ ও সুরক্ষার কথা চিন্তা করে জায়গায় জায়গায় মূল মেঝে থেকে সামান্য উঁচু করে কাঠের পথ নির্মাণ করে দেওয়া। সিঁড়ির উপর দিয়েও একই পন্থায় কাঠের আলগা সিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া আছে।

প্রবেশ করেছিলাম স্থাপনার পেছন দিক থেকে। সম্মুখ দিকে গিয়ে দেখি আয়োজন আরও জমজমাট। দৃষ্টিনন্দন কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদের পর দীর্ঘ একটা স্থাপনা। হ্রদ আর স্থাপনার পাশাপাশি অবস্থানকে সমান্তরাল বলা যেতে পারে। স্থাপনাকে ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পূর্ণাঙ্গ আঙ্কোর ওয়াট মন্দির। বিস্তর ফাঁকা জায়গা, ঠিক তার মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেছে বড় বড় পাথর বিছানো উঁচু আর চওড়া একটা পথ। পথের উভয় ধার পাথরের মজবুত রেলিং দিয়ে বাঁধা। প্রায় আড়াইশ মিটার দীর্ঘ পথের শেষ প্রান্তে আঙ্কোর ওয়াট। (চলবে)

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়