ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষতি

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ০৮:৫৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০
মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষতি

প্রায় দুই বছর ভারতের বন্দিশালায় থেকে দেশে ফিরছে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা।

জুলফিকার আলি ভুট্টো জনরোষ পাকিস্তানের পরাজিত সেনাবাহিনী থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ২২টি ধনী পরিবারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের জন্য এরাই দায়ী!

 

বর্তমান পাকিস্তান, তৎকালীন পশ্চিম পকিস্তানের অর্থনীতি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পূর্বাঞ্চলের উপর নির্ভরশীল ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের বহিঃবাণিজ্য এবং অর্থনীতি দুই-ই পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে ভালো ছিল। তবে এই ‘ভালো’টাও পূর্বাঞ্চলকে পরোক্ষভাবে শোষণ করে গড়ে তোলা। পূর্বাঞ্চল ছিল পশ্চিমের কাঁচামালের উৎস। সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ করে সেটাই আবার প্রক্রিয়াজাত করে উচ্চ দামে পূর্বাঞ্চলে বিক্রি করা হতো।

১৯৭০-এর পরিসংখ্যানে দেখা যায় পশ্চিমাঞ্চলের রপ্তানি ছিল ৫১১.৭ মিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গেই ছিল ১৭৩.৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট রপ্তানির ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলের রপ্তানি ছিল ৪৪৫.৬ মিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ছিল ৯৬.৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২১ শতাংশ। তাই পূর্বাঞ্চলের রপ্তানি কম হলেও বৈদেশিক মুদ্রা আসত সবচেয়ে বেশি। এই বৈদেশিক মুদ্রার উপর ভর করে পাকিস্তানের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছিল। উন্নত অবকাঠামো ও সেচ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে পশ্চিম অঞ্চলে তুলা ও গমের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ফলে পশ্চিমাঞ্চলের বস্ত্র শিল্পের দারুণ উন্নতি হয়েছিল। সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে পূর্বাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ না করায় বন্যা, খরা এখানকার প্রতিবছরের সমস্যা ছিল। তাই খাদ্য ঘাটতি লেগে থাকত। পূর্বাঞ্চলকে পশ্চিম থেকে খাদ্য আমদানী করতে হতো। সেই আমদানীর সূত্রে পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল অর্থ যেত। পূর্বেরও পশ্চিমের উপর একটা নির্ভরতা ছিল।
 

বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডই হারায়নি, হারিয়েছিল তার নৌবাহিনীর অর্ধেক সরঞ্জাম ও সদস্য, সেনাবাহিনীর তিন ভাগের এক ভাগ আর বিমান বাহিনীর চারভাগের এক ভাগ।
 

তবে পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছিল পূর্বাঞ্চলের পাট ও চা। ১৯৭১-এর মার্চের প্রথম থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে পাট ও চা রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। ১৯৭১-এর মার্চে রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৬৪ মিলিয়ন ডলার। আগের বছর একই সময় তা ছিল ৩৪৩ মিলিয়ন ডলার। এ হিসাব কেবল নগদ অর্থে নয়, স্বর্ণ ও বৈদেশিক নিরাপত্তা বন্ডের দামও যুক্ত ছিল। ফলে নগদ অর্থের পরিমাণ আরো কম ছিল। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে আসেন। তখনই তারা ইঙ্গিত দিয়ে যায়, এভাবে চলতে থাকলে পূর্বাঞ্চল রেখে লাভ কি? তার চেয়ে একটা চূড়ান্ত ফয়সালায় যাওয়া ভালো।

ন্যাশনাল ডিফেন্স ফান্ডে টাকা দেওয়ার জন্য দেশের জনগণের কাছে হাবিব ব্যাংকের আহ্বান

এদিকে ঋণ পরিশোধের অর্থেও টান পড়ে। স্বল্প মেয়াদী পরিশোধিত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬৩ মিলিয়ন ডলার। যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয় পূর্বাভাস দেয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে নামবে। এমন অবস্থায় ২৪ এপ্রিল ইয়াহিয়া ৬ মাসের জন্য বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন। উপরন্তু সরকার জনগণের কাছ থেকে যুদ্ধের জন্য অর্থ ও রসদ সংগ্রহে নামে। ‘জিহাদের’ নাম করে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন পাকিস্তানের গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজের দেশের নাগরিককে হত্যার জন্য অন্য নাগরিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে নামে সামরিক সরকার।

১ জুন আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তান আসে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলে, পাকিস্তানকে নতুন কোনো সাহায্য দেওয়া সমীচীন হবে না। কারণ তাদের পরিশোধের ক্ষমতা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তখন উঠে-পড়ে লাগেন পাকিস্তানকে নতুন সাহায্য পাইয়ে দিতে। পাইপ লাইনে তখন ৮২ মিলিয়ন ডলারের অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল। নিক্সন সরকার ১৯৭২ সালে কংগ্রেসকে আরো ১৮৮ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য ছাড়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। এতো কিছুর মধ্যেও পাকিস্তান সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রেখেছিল। ৭১-এর ডিসেম্বরে তা ছিল ২১৫ ডলার। যা দিয়ে তিন মাসের রপ্তানি ব্যয় নির্বাহ করা যেত।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের অর্থনীতি একেবারে শেষ হয়ে যায়। শুরু হয় বেকারত্ব। মুদ্রাস্ফীতি। ১০ শতাংশ খাদ্য শস্যের উৎপাদন কম হয় ১৯৭১ সালে খরার জন্য। তবে পূর্বের বছরের খাদ্য মজুত থাকায় তেমন সমস্যা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের বিশাল বাজার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় শিল্পোৎপাদনে ধ্বস নামে। ১০ শতাংশ শিল্পের শ্রমিক বেকার হয়ে যায়। এদিকে যুদ্ধের কারণে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ভারতীয় বিমান হামলার ভয়ে বিমান বন্দরে রাষ্ট্রীয় বিমান পর্যন্ত রাখা যাচ্ছিল না। পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের ২৮টি বেসামরিক বিমান ছিল। যুদ্ধের কারণে সেসব তেহরান, লিবিয়া ও সৌদি আরবে সরিয়ে রাখে পাকিস্তান সরকার। অন্যদিকে বিদেশি বিমানগুলোর জন্য অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হতো। প্রতি টন মাল পরিবহনের জন্য পাকিস্তানকে ১২ ডলার করে ওয়ার সারচার্জ গুনতে হতো। 

ন্যাশনাল ডিফেন্স ফান্ডে টাকা দেওয়ার জন্য মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং ইউনাইটেড ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের আহ্বান

বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডই হারায়নি, হারিয়েছিল তার নৌবাহিনীর অর্ধেক সরঞ্জাম ও সদস্য, সেনাবাহিনীর তিন ভাগের এক ভাগ আর বিমান বাহিনীর চারভাগের এক ভাগ। পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণের পর পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ হাজার বর্গমাইল ভূমি ভারতীয় বাহিনীর দখলে ছিল। ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। আনার পর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত ও আহত সৈনিকদের পরিবারকে দিতে হবে পেনশন। এমন এক জটিল পরিস্থিতিতে স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার ৪ দিনের মাথায় জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ক্ষমতা দিয়ে দৃশ্যপট থেকে কেটে পড়েন।

জুলফিকার আলি ভুট্টো ক্ষমতায় বসে একের পর এক চমক দিতে থাকেন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধাঁচে মাত্র দুই দিনের মাথায় তিনি ৩০টি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করে ফেলেন। এসবের মধ্যে ছিল: লোহা ও ইস্পাত, মৌলিক ধাতু, ভারী প্রকৌশল, ভারী বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, মোটরগাড়ি জোড়া দেওয়া ও তৈরি করা, ট্রাক্টর কারখানা ও উৎপাদন ইউনিট, ভারী ও মৌলিক রসায়নিক, পেট্রো-রাসায়নিক, সিমেন্ট, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও প্রেরণসহ জনহিতকর শিল্প, গ্যাস ও তৈল শোধনাগার।

ভুট্টো ঘোষণা দেন, যাতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাই সরকারি-বেসরকারি মিশ্র ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানগুলো চলবে। এর আগে ক্ষমতায় বসেই রেডিও ভাষণে, পাকিস্তানের ধনী ২২টি পরিবারকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় তিনি বেঁধে দেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তারা সম্পদের হিসাব দিতে না পারায় ঐ ২২টি পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্ট আটক করা হয় ২২ ডিসেম্বর। এই ২২ পরিবারের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। তাছাড়া বছরে তাঁদের ৫০ কোটি টাকা করে আয় বাড়ত। এই পরিবারগুলোর আত্মীয়-স্বজন ও পোষ্যবর্গের পাসপোর্টও বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই ২২টি পরিবার পাকিস্তানের ৯৭ শতাংশ বীমা, ৮০ শতাংশ ব্যাংকিং ও দেশের ৬৬ শতাংশ শিল্প সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করত। এসব ব্যাংক ও বীমা তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করেন। জুলফিকার আলি ভুট্টো জনরোষ পাকিস্তানের পরাজিত সেনাবাহিনী থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য এই ২২ পরিবারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের জন্য এরাই দায়ী!

শুধু ২২ পরিবার নয়, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর যে ৭০টি করদ রাজ্য পাকিস্তানের মধ্যে অঙ্গীভূত করা হয়েছিল, সেসবের রাজারা বিশেষ মাসিক ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তাও বন্ধ করে দেন ভুট্টো। এর আগে ভূস্বামীরা সর্বোচ্চ ৫০০ একর ভূমি নিজের মালিকানায় রাখতে পারতেন। ভুট্টো নিজে একজন অনুরূপ ভূস্বামী ছিলেন। কিন্তু তিনি তা কমিয়ে দেড়শ একর করেন। বাকি ভূমি খাস ঘোষণা করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করে দেন।

পাকট্রাকের জিহাদী ডাক

জেনারেল ইয়াহিয়াসহ সেনাবাহিনীর ৭ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন তিনি। নৌবাহিনীর প্রধানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এসব পদক্ষেপে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাতে ক্ষেপে না যায়, তাই ৪ প্রদেশের ৪ গভর্নরকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তিনি বসিয়ে দেন। কিন্তু এসব স্টান্টবাজি খুব একটা কাজ দেয়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি যেখানে ১০.০৩ বিলিয়ন ডলার ছিল, ৭২-এ তা ৯.৪২, পরের বছর ৬.৩৮ হয়ে যায়।

অনেক চেষ্টা করেও জুলফিকার আলি ভুট্টো মুদ্রাস্ফীতি ধরে রাখতে পারেননি। ৭২ সালে ৫.১৮ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ধরে রাখতে পারলেও, ৭৩-এ তা ২৩.০৭ শতাংশ এবং ৭৪-এ ২৬.৬৬ শতাংশে দাঁড়ায়। যা আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের রেকর্ড পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতি।

পাকিস্তানিদের মাথাপিছু আয় ১৯৭১ সালে ছিল ১৭৯ ডলার। ৭৩ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১০১ ডলারে। একটা দেশের অর্থনীতি কতটা খারাপ হলে এভাবে মাথাপিছু আয় নেমে যায়! মোট কথা বাংলাদেশ নামের একটি দেশের জন্ম পাকিস্তানকে পথে বসিয়ে দেয়। সে ক্ষতিপূরণ করতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল। যতদিন না পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে হটানোর জন্য পাকিস্তানকে সামরিক খাতে বিপুল অর্থ প্রদান করে। সেই টাকায় পাকিস্তান তালেবানদের গড়ে তুলে আরেকটি অশান্তির চুল্লি প্রস্তুত করে। যার ফল এখন পাকিস্তান নিজেই ভোগ করছে। একাত্তরোত্তর অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থা এখনও পাকিস্তানে বিরাজ করছে। অথচ অতীত থেকে দেশটি কোনো শিক্ষাই নেয়নি।

তথ্যসূত্র: The dawn, Intelligence Memorandum of CIA, macrotrends.net, theprint.in
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়