ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

জয়তু রবি, জয়তু ভবানী প্রসাদ  

প্রতিভা মুৎসুদ্দী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৯, ১ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৮:১০, ১ জানুয়ারি ২০২১
জয়তু রবি, জয়তু ভবানী প্রসাদ  

পহেলা জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন। ১৯৪৪ সনের এই শুভ দিনে রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদের সংসারে কিরণ বালা দেবীর কোল আলো করে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। দিনটি ছিল রবিবার। তাই শিশুর নামকরণ করা হয় রবি- পরিবারের সূর্য সন্তান। এই পরিবারের প্রথম পুত্র সন্তান বড় খোকা জন্মগ্রহণ করে ১৯৩৪ সনে। কিন্তু এই শিশু বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছিল। বহু চিকিৎসায়ও তাকে স্বাভাবিক করা যায়নি। ইতোমধ্যে রণদাপ্রসাদের ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হওয়ায় তিনি প্রচুর উপার্জন করেন এবং কলকাতার ৮ নম্বর রসিক লাল ঘোষ লেনের একটি প্রাসাদোপম বাড়ি ক্রয় করেন। কিন্তু এর মধ্যে কিরণ বালা দেবীর আর কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি মর্মান্তিক যন্ত্রণায় কেবল কান্নাকাটি করতেন।

এদিকে গোঁসাইবাড়ির এক দিদি কিরণ বালা দেবীকে একটি গোপালের মূর্তি দিয়ে বলেন, ‘তোমার বাড়িতে এই গোপাল প্রতিষ্ঠা করো, তোমার কোলজুড়ে একটি গোপাল আসবে।কিরণ বালা দেবী বহু যত্নে এই গোপাল তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং প্রতিদিন গোপালের পরিচর্যা করে প্রার্থনা করতে থাকেন। তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো, তিনি ১৯৪৪ সালের পহেলা জানুয়ারি রবিবার একটি দেবতুল্য পুত্র সন্তান লাভ করেন। রণদার বাড়িতে আনন্দ আর ধরে না। রণদাপ্রসাদ সেবছর তাঁর মির্জাপুরের বাড়িতে শ্বেতপাথর দিয়ে একটি সুদৃশ্য মন্দির স্থাপন করেন। এই মন্দিরের পূজায় বর্তমানে প্রতি বছর শত শত দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী অংশগ্রহণ করেন।

যাইহোক, এই শিশু চন্দ্রকলার মতো বড় হতে থাকে। মাত্র ৭ বছর বয়সে সুশিক্ষার জন্য তাকে দার্জিলিং-এর সেন্ট পলস্ আবাসিক স্কুলে ভর্তি করা হয়, যাতে সে সুশিক্ষিত হয়ে পিতার কাজে অংশ নিতে পারে। এ শিশু লেখাপড়া, খেলাধুলা এবং স্কুলের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই স্কুল থেকেই সে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশের স্বনামধন্য নটরডেম কলেজে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকেই ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণ হয়।

১৯৬৩ সালে উত্থান একাদশীতে রবির পিতার জন্মদিন মহা ধুমধাম করে উদযাপন করা হবে স্থির হয়। এজন্য রবি ট্রাস্টের অফিসার প্রফুল্লবাবু, ড্রাইভার চুনিলাল গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তরুণ রবি। নভেম্বর মাসের শীতের সকাল। চারদিকে ঘন কুয়াশা। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রফুল্লবাবু তাৎক্ষণিক মারা যান। রবি এবং চুনিলাল মারাত্মকভাবে আহত হলে দুজনকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। এ খবর মির্জাপুরে পৌঁছলে জন্মদিনের উৎসব বিষাদের হাহাকারে ভরে ওঠে।

কয়েক মাস পর রবি একটু সুস্থ হলে তাকে মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। একটি বিশেষ কেবিনে, বিশেষভাবে তাকে রাখা হয়। প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক ঝাণ্ডা তার চিকিৎসা ভার নেন এবং সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলেন। এরপর তাকে বিশ্রামের জন্য কলকাতায় শোভাবাজারের বাড়িতে রাখা হয়।

১৯৬৪ সালে মিসেস জয়া পতি বিলেত যান তাঁর স্বামী ডাক্তার বি পি পতির আহ্বানে এবং সেখানে তিনি শিক্ষকতার কাজে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি সন্তান সম্ভবা হলে জেঠামণি তাঁকে দেখতে বিলেত যান আগস্ট মাসে। ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে Enemy Property ঘোষণা করে। এতে ট্রাস্টের কর্মকাণ্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস্ এবং কুমুদিনী কলেজের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এ সময় জেঠামণির জ্যেষ্ঠা কন্যা বিজয়া খান এবং তাঁর স্বামী ব্যারিস্টার শওকত আলী খান হাল ধরেন।

যুদ্ধ শেষ হলে রবি আর জেঠিমাকে দেশে আনা হয়। রবি তখন সুস্থ। জেঠামণি তাঁকে নারায়ণগঞ্জে কাজে ঢোকালেন। স্কটিশ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নারায়ণগঞ্জে ডকইয়ার্ডে কাজ করেন। জেঠামণি রবিকে তাঁর  Apprentice (শিক্ষানবীশ) হিসেবে কাজ শিখতে দিলেন। ট্রাস্টের অন্যান্য কাজও একটু দেখতে বললেন। জেঠামণি চাইতেন তাঁর ছেলেমেয়েরা তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলো দেখবে। তাই জয়াকে ভারতেশ্বরী হোমসের প্রিন্সিপাল আর বিজয়াকে ভারতেশ্বরী হোমসের সুপারিনটেন্ডেন্টের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। রবিকে  নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজে Night Session এ ভর্তি করলেন। দিনে কাজ রাতে ক্লাস। ১৯৬৭ সালে রবি  বিএ পাস করে। এই বছর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রবির বিয়ে দেবেন। পাত্রী দেখা শুরু হলো। বহু পাত্রীর ধনাঢ্য পিতা এই পাত্রের সাথে সম্পর্ক করতে অত্যন্ত আগ্রহী। তিনি তাঁর এক বন্ধু সিলেটের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী নির্মল চৌধুরীর কাছে তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন এবং একটি সুপাত্রীর সন্ধান দিতে অনুরোধ জানালেন। নির্মলবাবু তাঁর আত্মীয় সিলেটের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী সাধুবাবুর জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতীর নাম প্রস্তাব করলেন। জেঠামণির কন্যা তাদের হলো। এখন তাঁর ছোট মেয়ে জয়া এবং পাত্র রবির পছন্দ হলেই শুভ কাজ হবে।

মিসেস পতিকে বিলেত থেকে তাঁর পুত্র কন্যাসহ দেশে আনা হলো। নির্ধারিত দিনে পাত্রী দেখতে পাঠালেন মিসেস পতি, রবি, গৌরবাবু আর আমাকে। সাধুবাবুর বসার ঘরে পাত্রী দেখানো হলো। অতি সাধারণ একটি শাড়ি, চুল খোলা যাতে আবার খুলে দেখাতে না হয়, মুখে কোনো কৃত্রিম মেকআপ নাই। একটি সরল সুন্দর মিষ্টি মেয়ে। পাত্রী দেখে সবাই মুগ্ধ। এরপর উভয় পক্ষের আলোচনা শেষে শুভ বিবাহের দিন ধার্য হলো ১১ মে ১৯৬৭ সাল। শেখঘাট বাবু বিমলেন্দু দাস ওরফে সাধু বাবুর বাড়িতে মহা ধুমধামে শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো। বরযাত্রী ৩৫০ এর উপরে ছিল।

এ যেন এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সিলেটবাসীর চির স্মরণীয় অনুষ্ঠান! এদিকে বরের বাড়ি কুমুদিনী কমপ্লেক্স আর সাহেব বাড়িতে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। ৫ দিন ধরে বৌভাত আর নানা অনুষ্ঠান হলো। ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীরা নৃত্যনাট্য ‘কিন্নরী’ মঞ্চস্থ করলো। কুমুদিনী কলেজের অধ্যক্ষ ছাত্রী শিক্ষক সকলেই মহানন্দে এই উৎসবে যোগদান করলো। বর-কনে যেন লক্ষ্মী-নারায়ণ! এ এক মহা মিলন মেলা!

কুমুদিনীতে মহানন্দে দিন চলছে। মাস তিনেক পরে শুভ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো- নববধূ সন্তান সম্ভবা। ১৯৬৮ সালের ২৬ মার্চ  রবি-শ্রীমতীর পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। এখন এই শিশুর নাম কী হবে? রবি বললো, ওর নাম হবে রাজীব প্রসাদ সাহা। আমি বললাম, এর তো কোনো অর্থ হয় না। রাজীব লোচন অর্থপূর্ণ হবে। ও বললো, অত বুঝি না, আমার ছেলে হবে, দ্বিতীয় আর পি সাহা। আমাদের বাড়িতে আর পি সাহা চির জীবিত হয়ে থাকবে, তার শেষ হবে না।

এর মধ্যে ৬৯-এর গণ আন্দোলন। ৬৫ সালের পর থেকে জেঠামণির ব্যবসা খুবই মন্দা। বহু কষ্টে তিনি প্রতিষ্ঠানগুলো একইভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। ৬৭ সালের পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ যাচ্ছিল। রবি বললো, দিদি তোমরা বাবাকে মির্জাপুর রেখে দাও। আমি ঐ দিকটা সামলাবো। জেঠামণিকে ওর কথা বলাতে তিনি হেসে বললেন, এখনও দেরি আছে মা। ওর আরো কিছুদিন সময় লাগবে।

এরপর এলো ৭০-এর নির্বাচন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলো। দেশের মানুষ আশা করলো এবার পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের মানুষ সুখে ও শান্তিতে জীবন কাটাতে পারবে। সকল শোষণের অবসান হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পাক বাহিনীর আক্রমণ, বুদ্ধিজীবি হত্যা, নিরীহ মানুষ হত্যা, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। সেই থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর বিজয় দিবসের পূর্ব দিন পর্যন্ত পাকিস্তান হানাদার বাহিনী প্রায় ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে। এর মধ্যে দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহাকে পুত্রসহ গ্রেফতার করে ২৯ এপ্রিল এবং ৫ মে মুক্তি দেয়। আবার ৭ মে দানবীরের গ্রাম মির্জাপুরে গণহত্যা চালিয়ে যাবার পূর্বে সারা গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। রাতে আনুমানিক ১১ টার দিকে নারায়ণগঞ্জে তাঁর খানপুরের বাসা থেকে রণদা প্রসাদ সাহা, তাঁর পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা ওরফে রবিসহ ৫ জনকে ধরে নিয়ে গুম করে ফেলে। তাঁদের আর কোনো সন্ধান মেলেনি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রবিকে অন্তত সরিয়ে রাখার জন্য জেঠামণির বন্ধু মহল তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু রবি তার বৃদ্ধ পিতাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। ২৯ এপ্রিল থেকে  ৪ মে পর্যন্ত রবি পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ  নিজ চোখে দেখে। ফলে পিতাকে সে ত্যাগ করে কোথাও যায়নি। ৭ মে পিতা পুত্রের শেষ কোথায় কীভাবে হয়েছিল তা চির অজানা থেকে গেল।

অমিত সম্ভাবনা নিয়ে রবি এ পৃথিবীতে এসেছিল পহেলা জানুয়ারি ১৯৪৪ সালে। একটি পবিত্র ফুল অকালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কবিগুরুর কথাই মনে পড়ছে:

‘যে ফুল  না ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী  মরু পথে হারালো  ধারা
জানি হে জানি তা হয় নি সারা।’

আজ রবির শুভ  জন্মদিনে প্রার্থনা করি, রবি যেখানেই থাকুক যেন পরম শান্তিতে থাকে। আর তার একমাত্র সন্তান রাজীবকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করি, ও যেন  তাঁর ( রবির  ) সকল স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।     


লেখিকা: একুশে পদকপ্রাপ্ত, ভারতেশ্বরী হোমসের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল

 

ঢাকা/হাসনাত/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়