ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার ৮৪তম জন্মদিন আজ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩১, ৫ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:২২, ৫ জানুয়ারি ২০২১
ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার ৮৪তম জন্মদিন আজ

এমন যদি হতো/ইচ্ছে হলে আমি হতাম/প্রজাপতির মতো। /নানান রঙের ফুলের পরে/বসে যেতাম চুপটি করে/খেয়াল মতো নানান ফুলের/সুবাস নিতাম কতো। - সুখপাঠ্য এ ছড়াটির জনক সুকুমার বড়ুয়া। এই ছড়াকারের ৮৪তম জন্মদিন আজ। 

১৯৩৮ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার ছড়াগুলো বুদ্ধিদীপ্ত, তীক্ষ্ণ ও শানিত, কিন্তু কোমল শব্দে লেখা।

যেমন-

‘ঠিক আছে’- শিরোনামে তার আরেকটি ছড়া :

অসময়ে মেহমান/ঘরে ঢুকে বসে যান/বোঝালাম ঝামেলার/যতগুলো দিক আছে/তিনি হেসে বললেন,/ঠিক আছে ঠিক আছে। /রেশনের পচা চাল/টলটলে বাসি ডাল/থালাটাও ভাঙাচোরা/বাটিটাও লিক আছে/খেতে বসে জানালেন,/ঠিক আছে ঠিক আছে। /মেঘ দেখে মেহমান/চাইলেন ছাতাখান/দেখালাম ছাতাটার/শুধু কটা শিক আছে/তবু তিনি বললেন,/ঠিক আছে ঠিক আছে।

আবার ‘শাখা’ শিরোনামের ছড়াটি এ রকম:

ক-শাখা, খ-শাখা/গ-শাখা, ঘ-শাখা/দুপুরের ছুটিতে/নুন দিয়ে শশা খা/পরীক্ষায় ফেল হলে/হাঁ করে মশা খা।

‘ডাটা সংবাদ’ শিরোনামের আরেকটি ছড়া:

পুঁইয়ের ডাঁটা লাউয়ের ডাঁটা/বায়োডাটার ঝোল,/ডাটা প্রসেস করতে হলে/কম্পিউটার খোল। /ডাঁটার পাগল বুড়োবুড়ি/ক্যালসিয়ামে ভরা,/শজনে ডাঁটায় গুণ বেশি তাই/বাজার ভীষণ চড়া। /উচ্চতর ডিগ্রি নিতে/ডাটাই পরম ধন,/সারা বছর খেটে করেন/ডাটা কালেকশন। /ডালের সাথে মাছের সাথে/যেমন ডাঁটা চলে,/গবেষকের ডাটা আবার/অন্য কথা বলে।

সুকুমার বড়ুয়ার বাংলা ছড়া সাহিত্যে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন বৈচিত্র্য, সরস উপস্থাপনা, ছন্দ ও অন্তমিলের অপূর্ব সমন্বয়ে। তার ছড়া একেবারেই স্বতন্ত্র। বাংলার ছড়াসাহিত্যে তিনি যে অন্যতম একজন- একথা নির্দ্বিধায়ই বলে দেওয়া যায়।  

অথচ সুকুমার বড়ুয়া একজন স্বশিক্ষিত মানুষ।  পড়াশোনার হাতেখড়ি মামাবাড়ির স্কুলে।  এরপর বড়দিদির বাড়িতে এসে পড়েন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।  আর এগোয়নি।  পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় অর্থনৈতিক সংকটে।

অল্প বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন সময় মেসে কাজ করেছেন।  জীবিকা নির্বাহের জন্য ফলমূল, আইসক্রিম, বুট ও বাদাম ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করেছেন।  ১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করেন।  ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হন।  ১৯৯৯ সালে স্টোর কিপার হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন।

সুকুমার বড়ুয়া তার সৃষ্টিশীল জীবনে ২৪টি পুরস্কার পেয়েছেন।  এর মধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক অন্যতম।

তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- পাগলা ঘোড়া (১৯৭০, বাংলা একাডেমি), ভিজে বেড়াল (১৯৭৬, মুক্তধারা), চন্দনা রঞ্জনার ছড়া (১৯৭৯, মুক্তধারা),  এলোপাতাড়ি (১৯৮০, বাংলা একাডেমি),  নানা রঙের দিন (১৯৮১, শিশু একাডেমি),  সুকুমার বড়ুয়ার ১০১টি ছড়া (১৯৯১, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র), চিচিং ফাঁক (১৯৯২, ওলট পালট প্রকাশনী),  কিছু না কিছু (১৯৯৫, বিশাখা প্রকাশনী),  প্রিয় ছড়া শতক (১৯৯৭, মিডিয়া),  বুদ্ধ চর্চা বিষয়ক ছড়া (১৯৯৭, সৌগতঃ ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়), ঠুস্ঠাস্ (১৯৯৮, প্রজাপতি প্রকাশন),  নদীর খেলা (১৯৯৯, শিশু একাডেমি),  আরো আছে (২০০৩, আরো প্রকাশন), ছড়া সমগ্র (২০০৩, সাহিত্যিকা), ঠিক আছে ঠিক আছে (২০০৬, প্রবাস প্রকাশনী, লন্ডন), কোয়াল খাইয়ে (২০০৬, বলাকা, চট্টগ্রাম),  ছোটদের হাট (২০০৯, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি), লেজ আবিষ্কার (২০১০, প্রথমা প্রকাশন)।

বাবা সর্বানন্দ বড়ুয়া।  মা কিরণ বালা বড়ুয়া।  বাবা-মায়ের তিনি ১৩তম সন্তান।  চট্টগ্রামের গহিরা গ্রামের শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়ার মেয়ে ননী বালার সাথে ১৯৬৪ সালের ২১ এপ্রিল তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।  ব্যক্তিগত জীবনে তিন মেয়ে এবং এক ছেলের জনক। 

ছড়া লিখে সফল এই মানুষটির মনেও লুকানো রয়েছে বিশাল এক কষ্টের পাহাড়। তার জবানীতেই শুনুন:

ছোটবেলায় আমি খুব বোকা-সোকা টাইপের ছিলাম। সাদাসিধে বলে একটা কথা আছে না; এই সাদাসিধে আর কী! আবার হাবাগোবাও ছিলাম। সবাই শুধু কাজের ফুট-ফরমায়েশে আমায় খাটাতে চাইত। স্কুলে সহপাঠীরা মারলেও কিছু বলার সাহস পেতাম না। কারণ, আমার বাবা নেই। বাবা হারিয়ে গেছেন কোথায় যেন! কই হারালেন কেউ বলতে পারে না।

এক দিদি বলেন, তোর বাবা মারা যায়নি, নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। তখন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বাবাকে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আসলে আমি সবই হারিয়ে বসেছিলাম। এরপর একবার মামার বাড়ি, একবার বোনের বাড়ি, আবার ধর্মশালায় ধর্মগুরুর শিষ্যদের সঙ্গেসহ বিভিন্ন জায়গায় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কাটাই। '৫০ সালের পর চট্টগ্রাম শহরে চলে আসি।  শহরে দশ বছর থেকে ঢাকার পথ ধরি। সেই থেকে আজও ঢাকায়। জীবনে কত কী দেখলাম, কত কী পেলাম। এত প্রাপ্তির ভেতরও মনের হাহাকার মেটে না। বাবার হাহাকার। ছোটবেলায় হারানো বাবাকে আজও খুঁজে পাইনি। বাবার সঙ্গে আমাদের ঘরবাড়ি সবই চলে গেছে। গ্রামে যারা থাকেন তারা এসব ভালো বুঝতে পারবেন। তাই ইচ্ছা থাকলেও বাড়ি যেতে পারি না; এখনও! আমার মা কিরণ বালা বড়ূয়া '৬১ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর মা অনেক কষ্ট করেছেন। পরের বাড়িতে ধান বানার কাজ করতেন। এ ছাড়াও নানা গৃহস্থালি কাজ করে দিতেন মানুষের। এসব মনে পড়লে চোখ ভিজে আসে!

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়