ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

দেশপ্রিয়’র বাড়ি সংরক্ষণ করা হোক

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ৬ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৬:৪২, ৬ জানুয়ারি ২০২১
দেশপ্রিয়’র বাড়ি সংরক্ষণ করা হোক

দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি

গত দু’দিন ধরে চট্টগ্রামের একটি শতবর্ষী বাড়ি নিয়ে গণমাধ্যমে খুব আলোচনা হচ্ছে। রহমতগঞ্জে ১৯ গণ্ডা ১ কড়া ভূমির উপর অবস্থিত বাড়িটি গত ৪ জানুয়ারি ভূমির বর্তমান মালিক হিসেবে দাবিদার জনৈক ফরিদ চৌধুরী দখল করতে যান। বাড়িটি বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দখলের অংশ হিসেবে সে বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য বুলডোজার চালায়। তবে স্থানীয় সুধীজনের প্রতিরোধের মুখে বাড়িটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। তাঁরা দাবি তুলছেন- বাড়িটি সংরক্ষণ করা হোক।

কিন্তু এ বাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামের সুধীমহলের এতো উৎসাহ কেন? কারণ বাড়িটিকে সবাই দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি বলে জানেন। কে এই যতীন্দ্র বাবু? নামটি আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেও, এ নাম উচ্চারিত না হলে ভারতবর্ষের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যাঁর নামে কলকাতায় হয়েছে দেশপ্রিয় পার্ক। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে। যা ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর হয়ে যায় পাকিস্তানের অংশ। তারপর থেকে সাম্প্রদায়িক কারণে এই মহান নেতার নাম রাষ্ট্রীয়ভাবে এ অঞ্চলে আর নেওয়া হয়নি।

অথচ আজ থেকে ১০০ বছর আগে এই যতীন্দ্র মোহনের নামে ভূ-ভারত কাঁপত। তাঁর ডাকে মহাত্মা গান্ধী ছুটে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের শেষ কথাটা তিনিই বলতেন। ছিলেন পাঁচ পাঁচবার কলকাতার মেয়র। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁর নাম শুনলে ব্রিটিশ আইসিএস আইপিএস অফিসাররা ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। চট্টগ্রামের পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার নেলসনকে চাকরিচ্যুত করিয়েছিলেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্রেগ অবসর নিতে বাধ্য হন। লজ্জায় অপমানে পুলিশ সুপার স্যুটার আত্মহত্যা করেন।

তিনি ছিলেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। চা শ্রমিকদের ‘মুলুক চলো’ আন্দোলনে রেল কর্তৃপক্ষকে শ্রমিক পরিবহনে বাধ্য করিয়েছিলেন। চা শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট ডাকে। আড়াই মাস ধরে চলা সেই ধর্মঘটের খরচ তিনি নিজে বহন করেছিলেন। কলোনি থেকে বিতাড়িত শ্রমিকদের তাঁর বাড়ির সামনে তাঁবু গেড়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

চা শ্রমিক, রেল শ্রমিকদের পাশে যখন কেউ ছিল না, তিনি ছিলেন। ১৯৩০-এর চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। কারা অন্তরীণ বিপ্লবীদের তীক্ষ্ম যুক্তি দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন। দিয়েছেন অর্থ সাহায্য। সূর্যসেন, অম্বিকাচরণের মতো চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহীদের আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি।

যতীন্দ্রমোহন একসময় কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার ছিলেন। লাখ লাখ টাকা কামাতেন। দেশ সেবার ব্রতে নেমে সেই টাকা তিনি অকাতরে বিলি করে গেছেন। ১৯৩৩ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে দার্জিলিঙে গৃহ-অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। কিছুই রেখে যান নি তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য। বিদেশী স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তও নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার মানুষের জন্য। দেশভাগের পর নেলী সেনগুপ্ত ভারত চলে যাননি। এখানে থেকে চট্টগ্রামের মানুষের সেবা করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন পুরোভাগে। ১৯৭০ সালে চিকিৎসার জন্য কলকাতা গেলে পাকিস্তান সরকার তাদের বাড়িটি শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে। ৭২ সালে তিনি ফিরে এলেও বাড়ি পাননি। তারপর থেকে তাদের বাড়ি ঘিরে দখলের খেলা চলছে। ৭৫ সালে বাড়িটি লিজ দেওয়া হয়। জনৈক শামসুদ্দিন মো. ইছহাক লিজ নিয়ে এখানে ‘বাংলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে যা ‘শিশুবাগ’ নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

শুধু যতীন্দ্র মোহনই নন, তাঁর পিতা যাত্রা মোহন সেনও ছিলেন এক দেশহিতৈষী ব্যক্তি। এ সেনগুপ্ত পরিবারের ভূমিতে অথবা উদ্যোগে জে এম সেন হল, জে এম সেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ডাক্তার খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়, অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়, কুসুমকুমারী বালিকা বিদ্যালয়, ত্রাহিমেনকা সংগীত মহাবিদ্যালয়, বর্তমান শিশুবাগ স্কুল (যা জে এম সেনের বসতঘর), চট্টগ্রাম সংস্কৃতিক কলেজ, চন্দনাইশস্থ বরমা ত্রাহিমেনকা উচ্চ বিদ্যালয়, বরমা ডিগ্রি কলেজ, বরমা উন্নতমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরমা দাতব্য চিকিৎসালয়, ভারতের কলিকাতা ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত কলেজ, দুর্গাপুর ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও এ বাড়ির একটি সামাজিক মূল্য আছে। এই বাড়ির ভূয়সী অবদান রয়েছে চট্টগ্রাম শহরকে আলোকিত করার পেছনে। চট্টগ্রামের সর্বজনমান্য একটি পরিবার ছিল সেনগুপ্ত পরিবার। বাড়িটির বয়স শতবর্ষের ঊর্ধ্বে। চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম পুরনো ভবন। ১৯২০ সালে রেল শ্রমিকদের আন্দোলন সম্পর্কে তদন্ত করতে স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী এ বাড়িতে উঠেছিলেন। অর্থাৎ গেল বছর তাঁর এ বাড়িতে পদার্পণের একশ বছর পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ এ বাড়ির ঐতিহাসিক, সামাজিক ও স্থাপত্যিক গুরুত্ব রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷

সে হিসাবে এই ঐতিহাসিক ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু যতই ঐতিহাসিক মূল্য থাকুক না কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে তার স্বীকৃতি না মিললে রাষ্ট্র তা সংরক্ষণ করে না। এসব প্রত্নসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার ১৯৬৮ সালের প্রত্নসম্পদ আইন অনুসরণ করে। সেই আইনে প্রত্ন বা “antiquity” বলতে বলা হয়েছে-any ancient product of human activity, movable or immovable, illustrative of art, architecture, craft, custom, literature, morals, politics, religion, warfare, science or of any aspect of civilization or culture, any ancient object or site of historical, ethnographical, anthropological, military or scientific interest, and any other ancient object or class of such objects declared by the Government, by notification in the official Gazette to be an antiquity for the purposes of this Act.

অর্থাৎ প্রত্ন আইন ১৯৬৮-র মতে এই বাড়ি একটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের যোগ্যতা রাখে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শুধু ঐতিহাসিক মূল্য থাকলেই হবে না, সরকার গ্যাজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তা ঘোষণা না করলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না। এই ঘোষণার জন্য এতো দিনেও এ বাড়ি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়নি।

মজার ব্যাপার বাড়িটি ১৯৭০ সাল থেকে সরকারের দখলে। সরকারি ভাষায় অর্পিত সম্পত্তি। সরকার উদ্যোগ নিলে অনেক আগেই বিনা খরচে এটিকে প্রত্ন আইনের আওতায় আনা যেত। এই বিলম্বের কারণে বাড়িটির পেছন অংশ ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে। তাতে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সামনের অংশেও একই কাজ হয়তো করা হতো। গতকালের বাধার কারণে সেটি সম্ভব হলো না। তবে কতদিন এটা ধরে রাখা যাবে সেও এক প্রশ্নের বিষয়। তাই বিলম্ব না করে এই ঐতিহাসিক ভবনটিকে সংরক্ষণের জন্য প্রত্ন আইন ১৯৬৮ অনুসারে প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হোক।

 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়