ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রাজধানীতে রসের খোঁজে

সুশীল মালাকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩২, ১১ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:৩৮, ১১ জানুয়ারি ২০২১

কুয়াশার চাদরে মোড়া চারদিক। তখনও আড়মোড় ভাঙেনি এই শহর। ব্যস্ত ঢাকার অলিগলি ফাঁকা। সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই কাছি, দড়ি, হাঁড়ি, কলস নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হাঁটছেন ফরহাদ তালুকদার। গতকাল বিকেলে খেজুর গাছ কেটে যে হাঁড়ি বসিয়ে এসেছেন তা এখন রসে টইটুম্বুর। ঝাকড়া পাতার লম্বা গাছগুলোতে সুকৌশলে উঠে পড়েন ফরহাদ তালুকদার। সকাল হওয়ার আগেই গাছ থেকে নামিয়ে আনেন রসে পূর্ণ মাটির হাঁড়ি।

ফরহাদ তালুকদারের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। তিনি মগবাজারের পেয়ারাবাগে ব্যাংক কলোনীর ভেতরে দুটি খেজুর গাছ কাটেন। গাছগুলোর চূড়ায় উঠে ছাল চেছে বসিয়ে দেন মাটির হাড়ি। দুই দিন অন্তর কাজটি তাকে করতে হয়। ঢাকার মগবাজার, দিলু রোড, বেগুনবাড়ি, সিএইচডি গোডাউন- সব মিলিয়ে প্রায় ২২টি গাছ কাটেন তিনি।

তার বাবা গাছি মাজেদ তালুকদার ফরিদপুরের ভাঙ্গাতে খেজুর গাছ কাটতেন। বাবার কাছ থেকেই ফরহাদ শিখেছেন খেজুর গাছ থেকে রস বের করার কৌশল।

ফরহাদ প্রায় ২০ বছর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি শুধু খেজুর গাছই কাটেন না, তাল গাছও কাটেন। শীতের শুরুতে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর থেকে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত নির্ধারিত খেজুরগাছগুলোতে শুরু করেন প্রাথমিক কাজ। গাছ পরিষ্কার করা, ছিলা, এসব করে রস আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১০-১৫ দিন। এরপর যখন রস আসে তখন চূড়ান্ত ছিলা দিয়ে হাড়ি বসিয়ে দেন। বাদুড়সহ বিভিন্ন পাখি রাতের বেলাতে ভিড় জমায় খেজুরের রস খাওয়ার জন্য। বাদুড়ের লালার মাধ্যমে হাড়ির রসে মিশ্রিত হতে পারে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস। তাই গাছে হাড়ি বসানোর পর বেশ সুকৌশলে বাঁশের চাটাই দিয়ে মুড়ে দেন গাছি ফরহাদ তালুকদার।

পৌষ এবং মাঘ এই দুই মাস পুরোদমে তিনি খেজুর গাছ কাটেন। শীত শেষে চলে যান গ্রামের বাড়ি। সেখানে তার স্ত্রী, একটি ছোট ভাই এবং একটি বোন আছে। তাদের সঙ্গে বসন্ত কাটিয়ে আবার গ্রীষ্মের শুরুতে চলে আসেন ঢাকা। শুরু করেন তালগাছ কাটা। খেজুর গাছের চাইতে তালগাছ কাটা একটু বেশি পরিশ্রমসাধ্য। তালগাছ কাটার মৌসুম শেষ হলে তিনি আবার চলে যান ফরিদপুর নিজ বাড়িতে। অপেক্ষা করেন শীতের জন্য। এভাবেই প্রায় দীর্ঘ ২০ বছর চলছে তার জীবন চক্র।

যশোর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে জ্বাল দিয়ে তৈরি করেন খেজুরের গুড়। কিন্তু ঢাকাতে খেজুরের রসের চাহিদা এত যে তাকে গুড় তৈরির জন্য এই রস জ্বাল দিতে হয় না। প্রতিদিনই বিক্রি হয়ে যায় তার খেজুরের রস।

গাছি ফরহাদ বলেন, ‘প্রতিদিনই রসের অর্ডার থাকে। কেউ লিটার হিসেবে নেয়, কেউবা হাঁড়ি হিসেবে নেয়। প্রতি হাড়ি রস ৪০০-৬০০ টাকায় বিক্রি করি।’

ভোর না হতেই কাঁধে হাঁড়ি নিয়ে রস সংগ্রহে ছুটে চলা গ্রাম বাংলার একটি আদি শীতকালীন চিত্র। প্রতিনিয়ত দেশে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। কমে যাচ্ছে গুড় উৎপাদন। দক্ষ গাছির কারিগরি জ্ঞানটুকু ধরে রাখার মতো কেউ নেই। ফরহাদ তালুকদারের মতো যারা বাবা কিংবা চাচার কাছ থেকে শিখে রেখেছেন অভিনব এই কৌশল তাদের হাতেই এখন পর্যন্ত টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী রস উৎপাদন ব্যবস্থা।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়