ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’ রেখে যাওয়া এক বিপ্লবী

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫০, ১২ জানুয়ারি ২০২১  
‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’ রেখে যাওয়া এক বিপ্লবী

 

 

‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার এটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’

ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে এই কথা লিখে গিয়েছিলেন সূর্য সেন।  এই সূর্যসন্তান আজো এ দেশের নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি এই বিপ্লবীর ফাঁসির রায় চট্টগ্রাম কারাগারে কার্যকর হয়েছিল। সূর্যকুমার সেনের সঙ্গে সেদিন তারকেশ্বর দস্তিদার নামে আরেক বিপ্লবীরও ফাঁসি কার্যকর হয়। এই দুই বীর বিপ্লবীর মৃত দেহ বস্তাবন্দি করে জাহাজে বয়ে পাথর বেঁধে বঙ্গোপসাগরের অতল জলে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন বেঙ্গল আর্মড পুলিশের সদস্য পটিয়ার নাইখাইন গ্রামের নুর মোহাম্মদ এক বেতার সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, মরদেহ দুটি নিয়ে যাওয়ার সময় সূর্য সেনের লাশের বুকে জনৈক হিকস সাহেব লাথি মেরে উল্লাস প্রকাশ করছিলেন।

সূর্য সেনের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায়।  শিক্ষকতা করার কারণে সূর্য সেন ‘মাস্টারদা’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বীরযোদ্ধা ছিলেন সূর্য সেন।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সশস্ত্র অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন। এর কয়েকদিন পর ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে কয়েকশ নিয়মিত সেনা বাহিনীর সাথে বিপ্লবীদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী সাময়িকভাবে পলায়ন করে। যা ছিল দেড়শ বছরে ইংরেজ বাহিনীর এদেশের মানুষের কাছে প্রথম সুস্পষ্ট পরাজয়। 

সে রাতের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে  চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার, দামপাড়ার পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখলে আসে বিপ্লবীদের। এই আক্রমনে অংশ নেয়া বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্যসেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। সূর্যসেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে। দুই ঘন্টার প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়।

ইংরেজ প্রশাসন সূর্যসেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে।  সূর্যসেন গৈরলা গ্রামে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন।

সূর্য সেন গ্রেপ্তার হবার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্য সেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় প্রধান আসামি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। গত ১৯৩০ সাল হইতে সূর্য সেন পলাতক ছিলেন এবং তাহাকে ধরাইয়া দিবার জন্য গভর্নমেন্ট দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন’।

সূর্য সেন গ্রেপ্তার হবার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারির সাথে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই তাদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।

সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৫ জুন ১৯৩৩ এ শুরু হওয়া এ মামলায় কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। ১৪ আগস্ট ১৯৩৩ সালে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। মামলার রায় প্রদানের পর তিনজন বিপ্লবীর পক্ষে কলকাতা হাইকোর্টে আপিলের আবেদন করা হয়। ১৪ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে হাইকোর্ট প্রদত্ত রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড বহাল রাখে। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর হয়।

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়