ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-১০)

 মোহাম্মদ তৌহিদ, চীন থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ১৪ জানুয়ারি ২০২১  
বেইজিংয়ের জানালা (পর্ব-১০)

চীনা শব্দ ‘হুথোং’ অর্থ সরু গলি। শহর বা গ্রামের প্রধান সড়কের পাশাপাশি ছোট সরু রাস্তাগুলো- যা দিয়ে লোকজন আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে, তাকেই চীনারা হুথোং বলে। 

বিশ্বের দেশে দেশে এমন গলির ছড়াছড়ি থাকলেও বেইজিংয়ের হুংথোংয়ের রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। এখন বেইজিংয়ের প্রাচীন শহুরে সংস্কৃতিকে ‘হুথোং সংস্কৃতি’ বলা হয়। নিত্যনতুন অবকাঠামো নির্মাণ, উন্নয়ন-পরিবর্তনের ছোঁয়ায় বেইজিংয়ের রূপ বদলে যাচ্ছে দ্রুত। 

প্রাচীনকালের শান্ত জীবনের চেহারা বদলে বেইজিং এখন গতিময় ও ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ একটি শহর! ঐতিহাসিক এ শহরের আদি রূপ খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ত, যদি হুথোং না থাকত। মহানগর প্রশাসন অতি যত্নে এসব গলি টিকিয়ে রেখেছে। এসব হুথোং এখন বেইজিং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

প্রাচীন চীনের ইউয়ান রাজবংশের সময় থেকে বেইজিংয়ের হুথোং দেখা যায়। এক সময় বেইজিংয়ে ৬ হাজারের বেশি হুথোং ছিল। মূলত ইউয়ান, মিং ও ছিং রাজবংশ আমলে তৈরি হুথোংগুলো রয়েছে এখনও। 

বেশিরভাগ হুথোং পূর্ব-পশ্চিমমুখী।  চওড়ায় সর্বোচ্চ ৯মিটার।  হুথোংয়ের দুই পাশ দিয়ে স্থানীয়দের বসতবাড়ি বা ঐতিহ্যবাহী ‘সি হ্য ইউয়ান’। 

সাধারণ দৃষ্টিতে হুংথোংগুলো অনেকটা একই রকম। তবে, এর কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হুথোংগুলোতে কোনো গগণচুম্বী ভবনের দেখা মিলবে না। বেশিরভাগ বাড়ি ঠিক আগের যুগের বাড়ির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে।  হুথোংয়ের জীবনযাত্রার মধ্যে আদিকালের ছাপ পাওয়া যায়। হুথোং সম্পর্কে বেইজিংবাসীর মনে আলাদা এক অনুভূতি কাজ করে। হুথোং যেন জীবন্ত জাদুঘর! হুথোংয়ের জীবনযাত্রাও খুব আন্তরিকতা পরিপূর্ণ।

বেইজিংয়ের দর্শনীয় শীর্ষ দশটি হুথোং হলো- নানলুওকুসিয়াং, ইয়ানতাইসিয়ে চিয়ে, মাওআর হুথোং, কুওজিচিয়ান চিয়ে, লিউলিছাং, জিনইয়ু হুথোং, তুংচিয়াওমিনসিয়াং, সিচিয়াওমিন সিয়াং, চ্যু’আর হুথোং ও পাতা হুথোং। 

১. নানলুওকুসিয়াং
এই হুথোং বেইজিংয়ের তোংছেং জেলার খুব প্রাচীন রাস্তা। এখানে চীনের ইউয়ান রাজবংশের সড়কের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা হয়েছে। এর দক্ষিণ দিক থিয়েন-আন-মেন পূর্ব রাস্তার সঙ্গে যুক্ত। এই গলির মোট দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটার। এটি এখন চীনের থ্রি-এ (AAA) মানের পর্যটন স্থান।

নানলুওকুসিয়াং নামটি দেওয়া হয় ছিং রাজবংশের সময়।  ধীরে হুথোংয়ে মানুষ বাড়তে থাকে, জীবনও বেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।  সেখানে শাকসবজি ও মাংসের দোকান, মদ ও ওষুধের দোকান সবই আছে। বর্তমানে এটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান।  এখানে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় খাবার ও বাহারি জিনিসপত্র পাওয়া যায়।  নানলুওকুসিয়াং দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় জায়গা।

২. ইয়ানতাইসিয়ে চিয়ে
বেইজিংয়ের সিছাহাই ঐতিহাসিক সংস্কৃতি সংরক্ষণ এলাকার কেন্দ্রে অবস্থিত ইয়ানতাইসিয়ে চিয়ে।  এই গলিটি পূর্বদিকের থিয়েন-আন-মেন রাস্তা থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমের সিছাহাই দর্শনীয় স্থান পর্যন্ত চলে গেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ মিটার। এই রাস্তাকে ২০০৭ সালে আটটি বৈশিষ্ট্যময় বাণিজ্যিক সড়কের মধ্যে অন্যতম বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। 
বর্তমানে ইয়ানতাইসিয়ে চিয়ে বেইজিংয়ের একটি দর্শনীয় স্থান। এখানকার নির্মাণশৈলীও বেশ প্রাচীন। এই হুথোংয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, রাস্তার দোকান থেকে সুন্দর সুন্দর হস্তশিল্প কেনা যায়। 

৩. মাও’আর হুথোং
মাও’আর হুথোং বেইজিংয়ের তোংছেং জেলার জিয়াওতাওখৌ রাস্তায় অবস্থিত।  এর পূর্বদিকে নানলুওকুসিয়াং থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমে থিয়েন-আন-মেন ওয়েই রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অতীতে এই হুথোংয়ের ভিন্ন নাম ছিল (ওয়েনছাংকুং হুথোং)।  এখানে আছে ওয়েনছাং নামে একটি প্রাসাদ।  ছিং রাজবংশের সময় এই হুথোংয়ে টুপি তৈরির দোকান ছিল বেশি, তাই এই হুথোংয়ের নাম হয় মাও’আর হুথোং। চীনা ভাষায় মাও য্যি মানে টুপি। 

৪. কুওজিচিয়ান চিয়ে
কুওজিচিয়ান চিয়ে পূর্ব-পশ্চিমমুখী একটি রাস্তা। এটি ইয়োংহ্য লামা মন্দির ও আনতিংমেন রাস্তার মাঝামাঝি অবস্থিত।  এই সড়ক তৈরি হয় চীনের ইউয়ান রাজবংশের প্রথম দিকে। মিং রাজবংশের সময় এই রাস্তাকে ‘কুওজিচিয়ান’ নাম দেওয়া হয়। তারপর থেকে সেই নামই বহাল আছে।  উল্লেখ্য, কুওজিচিয়ান হলো চীনের ইউয়ান, মিং ও ছিং রাজবংশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিচালনা সংস্থা। কুওজিচিয়ান শুধু দেশীয় শিক্ষার্থীই নয়, বরং বিদেশি শিক্ষার্থীও গ্রহণ করে। তাই কুওজিচিয়ান চীন ও বিদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

কুওজিচিয়ান রাস্তায় বেইজিংয়ের প্রাচীন সড়কের চেহারা ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। ১৯৮৪ সালে কুওজিচিয়ান রাস্তাকে (সড়ক/গলি/হুথোং) বেইজিংয়ের শহর পর্যায়ের পুরাকীর্তি সংরক্ষণের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে কুওজিচিয়ান বেইজিংয়ের সীমিত কিছু প্রাচীন রাস্তার অন্যতম।  দেশ-বিদেশের মানুষ এখানে প্রাচীন বেইজিংয়ের বৈশিষ্ট্য দেখতে পছন্দ করেন। 

৫. লিউলিছাং
লিউলিছাং বেইজিংয়ের হ্যপিংমেনওয়েইতে অবস্থিত।  এটি বেইজিংয়ের খুব বিখ্যাত একটি সাংস্কৃতিক সড়ক। এর দৈর্ঘ্য ৮০০ মিটার। রাস্তাটি নির্মিত হয় চীনের ছিং রাজবংশের সময়। তখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেইজিংয়ে এসে রাজকীয় পরীক্ষায় (The imperial examination) অংশগ্রহণ করত শিক্ষার্থীরা।  তারা এই লিউলিছাং-এ থাকত।  এখানে বই, কাগজ, কলমসহ বিভিন্ন জিনিস বেশি বিক্রি হয় এবং খুব ভালো সাংস্কৃতিক পরিবেশ বজায় রয়েছে।  

মিং রাজবংশের সময় লিউলিছাংয়ে তৎকালীন রাজপ্রাসাদের জন্য স্বচ্ছ ও রঙিন কাঁচ তৈরির কারখানা ছিল।

৬. জিনইয়ু হুথোং
জিনইয়ু হুথোং বেইজিংয়ের তোংছেং জেলার তেংসিখৌ রাস্তার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এর মোট দৈর্ঘ্য ৫৬৭ মিটার। এটি গলি হলেও পশ্চিম প্রান্তে ১২ মিটার চওড়া এবং পূর্ব প্রান্তের পথ চওড়া মিটার ৪৪। বেইজিংয়ের বিখ্যাত জিসিয়াং থিয়েটার এবং বিখ্যাত হালাল খাবারের রেস্তোরাঁ তুংলাইসুন রেস্তোরাঁ জিনইয়ু হুথোংয়ে অবস্থিত। বর্তমানে এই হুথোং একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, এখানকার রাতের দৃশ্য খুবই আকর্ষণীয়। এই হুথোংয়ের কাছাকাছি রয়েছে বেইজিংয়ের বিখ্যাত রাজকীয় সড়ক ও কেনাকাটার স্থান- ওয়াংফুচিং। 

৭. তুংচিয়াওমিনসিয়াং
তুংচিয়াওমিনসিয়াং হুথোংও বেইজিংয়ের তোংছেং জেলায় অবস্থিত। এটি বেইজিংয়ের থিয়েন-আন-মেন পূর্ব রাস্তা থেকে শুরু করে ছুংওয়েনমেন রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত।  মোট দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটার। 

এক সময় তুংচিয়াওমিনসিয়াং এলাকায় বেইজিংয়ের অনেক দূতাবাস ছিল। ১৮৬০ সালে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি ও বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশ তুংচিয়াওমিনসিয়াং এলাকায় দূতাবাস স্থাপন করে এবং তখন এই রাস্তা ‘দূতাবাস সড়ক’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৫৯ সালে সব দূতাবাস  বেইজিংয়ের ছাওইয়াংমেনের সানলিথুন এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। তুংচিয়াওমিনসিয়াং বর্তমানে বেইজিংয়ের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ এলাকা। এখানে রাস্তার দুই ধারে ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে, যেন একটি সড়ক জাদুঘর। 

৮. সিচিয়াওমিন সিয়াং
সিচিয়াওমিন সিয়াং বেইজিংয়ের সিছাং জেলার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এর উত্তর দিক দিয়ে ছোংওয়েনমেন সড়ক চলে গেছে। সিচিয়াওমিন সিয়াংয়ের দৈর্ঘ্য ৬.৫ কিলোমিটার। এটি বেইজিংয়ের সবচেয়ে দীর্ঘ হুথোং। সিচিয়াওমিন সিয়াং সড়ক চীনের ছিং রাজবংশ থেকে ২০ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সক্রিয় একটি আর্থিক কর্মকাণ্ডের রাস্তা। এখানে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেইজিং শাখার পুরানো কার্যালয়, চীনের কৃষি ও শ্রমিক ব্যাংকের পুরানো কার্যালয়সহ বিভিন্ন ব্যাংক আছে।

৯. চ্যু’আর হুথোং
চ্যু’আর হুথোং বেইজিংয়ের তোংছেং জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত। এটি নানলুওকুসিয়াংয়ের কাছাকাছি। মোট দৈর্ঘ্য ৪৩৮ মিটার ও ৬ মিটার চওড়া। বর্তমানে বেইজিংয়ে অবস্থানকালে চ্যু’আর হুথোংয়ে থাকতে পছন্দ করেন অনেক বিদেশি। বরাবরই এখানে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জার্মানি, ফিনল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশের মানুষ দেখা যায়। চ্যু’আর হুথোংয়ের চেহারা একদম প্রাচীন বেইজিং ধরনের, এখানে জীবনযাপনের পরিবেশও বেশ ভালো। তাই পর্যটকরা চ্যু’আর হুথোং পছন্দ করেন।  এসবের পাশাপাশি চ্যু’আর হুথোংয়ের স্থাপত্যও অনেক বৈশিষ্ট্যময়।

১০. পাতা হুথোং
পাতা হুথোং বেইজিংয়ের ছিয়ানমেন রাস্তার পশ্চিম দিকে অবস্থিত। আসলে এটি একটি হুংথো নয়, বরং আটটি ছোট হুথোংয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এই আটটি হুথোং হলো: পাইসুন হুথোং, ইয়ানজি হুথোং, হানচিয়াথান, সানসিসিয়াং, সিথৌ হুথোং, ওয়াংকুয়াংফুসিয়ে চিয়ে, চুচিয়া হুথোং ও লিসামাও হুথোং।  বেইজিংয়ের দর্শনীয় স্থান ছিয়ানমেনের কাছাকাছি হওয়ায় এখন পাতা হুথোংও একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। 

লেখক:  বিদেশি বিশেষজ্ঞ, বাংলা বিভাগ, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং, চীন।

ঢাকা/সাইফ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়